কক্সবাংলা ডটকম(৮ জুলাই) :: অর্থশাস্ত্রের চাহিদা ও যোগান বিধি অনুযায়ী, ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য বা অলস টাকা অনেক বাড়লে ঋণের সুদের হার কমে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে তা হচ্ছে না। বর্তমানে প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্থ থাকলেও ঋণের সুদের হার ব্যাংকগুলো কমাচ্ছে না।
অর্থনীতির সূত্র অনুসারে মানুষের আয় বাড়লে সঞ্চয় বাড়ে, তখন বিনিয়োগও বাড়ে। আমাদের দেশে মানুষের আয় বাড়ছে, সঞ্চয় বাড়ছে, কিন্তু বিনিয়োগ স্থবির। অর্থনীতির একটি মৌলিক তত্ত্ব হলো— সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে অবকাঠামো উন্নত হবে।
ব্যবসায়ের খরচ কমবে। ফলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বাড়াবেন। বাংলাদেশে তাও কাজ করছে না। অনেক দিন ধরে সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। অর্থশাস্ত্র বলছে, দেশের বেশিরভাগ মানুষই রেশনাল (হিসেবি বা যৌক্তিক)।
আর এই রেশনাল মানুষ রিয়াল ইন্টারেস্ট রেট (মূল্যস্ফীতির তুলনায় আমানতের সুদ হার) নেগেটিভ (ঋণাত্মক) হলে ব্যাংকে টাকা রাখবে না। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের রিয়াল ইন্টারেস্ট রেট নেগেটিভ হওয়ার পরও মানুষ ব্যাংকের দিকেই ঝুঁকছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় অনুমান করে নেওয়া হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো—সেটেরিস পেরিবাস অর্থাত্ সূত্রের চলক ছাড়া অন্য সব অপরিবর্তিত থাকলে সূত্রটি কাজ করবে। বাংলাদেশে এই অন্যসব আর অপরিবর্তিত থাকছে না। ফলে অর্থনীতির অনেক তত্ত্বও কাজ করছে না এ দেশে। এ ধরনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে অর্থনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। তারল্য জমতে জমতে অলস অর্থের পাহাড় হলেও ব্যাংকগুলো সুদের হার কমাচ্ছে না। আমানতের সুদ কমিয়ে দিলেও ঋণের সুদ কমাচ্ছে না।
এর কারণ হিসেবে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সভাপতি আনিস এ খান বলেছেন, ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ দিন দিন বাড়ছে। আর খেলাপি ঋণ সামাল দিয়ে বছর শেষে মুনাফা ধরে রাখতে গিয়ে ঋণের সুদ কমানো যাচ্ছে না। এতে চাপ পড়ছে ভালো উদ্যোক্তাদের উপর। ভালো উদ্যোক্তাদেরকে উচ্চ সুদেই ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ১৬ শতাংশ। যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হয়েছে ২৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাত্ মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা উচ্চ হারে বাড়ছে। সঞ্চয় বাড়ার পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগও বেড়েছে এ সময়ে।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ ছিল সরকারি বিনিয়োগ। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর আগামী অর্থবছরে তা হবে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এভাবে প্রতি বছরই সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে।
সঞ্চয় বাড়ছে, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। গত প্রায় ৮ বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ শতাংশের আশ-পাশে অবস্থান করছে। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ হওয়ার প্রত্যাশা করছে সরকার।
বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে মেয়াদি শিল্প ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মেয়াদি শিল্প ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। যা আগের ছয় মাসে ছিল ৩৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। অর্থাত্ এ সময়ে মেয়াদি ঋণ বিতরণ কমেছে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হলেও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগ (আইএমইডি) এসব বিনিয়োগের অবকাঠামো নিম্নমানের হচ্ছে বলে তাদের নানা সময়ের মূল্যায়নে তুলে ধরেছে। আর অবকাঠামো নিম্নমানের হওয়ায় সরকারি বিনিয়োগের প্রভাব পড়ছে না বেসরকারি বিনিয়োগে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনেক সময় সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পর অবকাঠামো তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়তে দেরি হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটিও হচ্ছে না। কারণ দীর্ঘ সময় পরও কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো নির্মাণ হয় না। তাছাড়া যেসব অবকাঠামো তৈরি হয়, তাতে অপচয়ের কারণে খরচ অনেক বেশি হয়। ফলে সরকার যতোটা ব্যয় করছে সে অনুযায়ী অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না।
এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ে। তবে আমাদের সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হলেও এক্ষেত্রে অদক্ষতা রয়েছে। প্রতি বছরই অর্থবছরের নয় বা দশ মাস শেষ হওয়ার পরও এডিপি বাস্তবায়নের হার খুবই কম থাকে। শেষ দুই মাসে তাড়াহুড়া করে অর্থ খরচ করা হয়। এভাবে সরকারি ব্যয় বাড়ালে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা কম।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের মার্চে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ হার ৫ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাত্ রিয়াল ইন্টারেস্ট রেট ঋণাত্মক। অর্থাত্ এক বছরে ব্যাংকে জমানো টাকার মান যতটা কমছে ততটা সুদ পাওয়া যাচ্ছে না।
ফলে ব্যাংকে টাকা জমালে প্রকৃত অর্থে লোকসান হয় আমানতকারীর। এছাড়া ব্যাংকের টাকার উপর কর, শুল্ক এবং ব্যাংকের চার্জ বিবেচনায় নিলে ব্যাংকে টাকা রাখায় অনেক লোকসান গুনতে হয় আমানতকারীকে। তারপরও মানুষ ব্যাংকেই টাকা রাখছে। এর কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, আমাদের দেশে বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ খুবই কম।
এখানকার শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা কম। তাছাড়া বিনিয়োগের অন্য সুযোগ সম্পর্কেও মানুষের আস্থা নেই। বিভিন্ন সময়ে মানুষ বিভিন্নভাবে অর্থ লোপাট হতে দেখেছে। তাই মানুষ ব্যাংককেই নিরাপদ বলে মনে করে। অনেকে জমিকে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করে জমি কিনেও লোকসান করেছে। ফলে মানুষ ব্যাংক ছাড়া অন্য কোথাও আস্থা রাখতে পারছে না।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক ছাড়া শেয়ারবাজার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কিনে রাখে। আমাদের দেশের অনেকেই মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কে সে ধারণাই রাখেন না। এক্ষেত্রে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর ব্যর্থতা ও দুর্বলতাও অবশ্য দায়ী।