কক্সবাংলা ডটকম(৪ জুন) :: রাজধানী ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ পূর্বাচল খাল থেকে উদ্ধারকৃত বিপুল অস্ত্রের চালান নিয়ে সর্বত্র তোলপাড় চলছে। ২৫ কিলোমিটার দূরে দুটি স্থানে একই কায়দায় খালের মধ্যে রাখা উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ কী উদ্দেশ্যে আনল- এ প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মধ্যে। কিন্তু কেউ কোনো হিসাব মেলাতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও নেই সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য।
এখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য কিছু সূত্র দাবি করছে- এসব অস্ত্র চীনের তৈরি। আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালান সিন্ডিকেট বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে বিপুল পরিমাণ এসব অস্ত্রের চালানের গন্তব্য যেখানেই হোক না কেন দেশের জন্য তা বড় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তো বটেই।
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দারা।সবকটি গোয়েন্দা সংস্থা পৃথকভাবে এ নিয়ে তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ শনিবার বলেন, অবৈধ এসব অস্ত্র বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য আনা হয়েছে এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে এত অস্ত্র কেনার সক্ষমতাও নেই। এসব অবৈধ অস্ত্রের চালান পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের সন্ত্রাসী কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের জন্য আনা হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে এসব অস্ত্র আনছে। চোরাকারবারিরা বাংলাদেশে ছোট ছোট এজেন্টের মাধ্যমে অস্ত্র-গোলাবারুদ নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে। এসব চোরাচালান বন্ধ করতে হলে দেশের অরক্ষিত সমুদ্র ও সীমান্ত পথগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র জানায়, চীন থেকে নির্ধারিত কিছু এজেন্টের মাধ্যমে এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ বাংলাদেশে আসে, যা পার্শ্ববর্তী একটি দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের জন্য এখানে মজুদ করা হয়। পরে সুযোগমতো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ চীনের আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান চায়না নর্থ ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (নোরিনকো) তৈরি। এর আগে গত বছর রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ি খাল থেকে উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানও নোরিনকো।
প্রস্তুতকারী দেশের নাম এবং সিরিয়াল নম্বর না থাকলেও উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদের ধরন ও আকৃতি দেখে অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। তারা এক রকম নিশ্চিত যে, দিয়াবাড়ির অস্ত্রের চালান এবং রূপগঞ্জের অস্ত্রের চালানের মধ্যে বিশেষ যোগসূত্র আছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাচালানিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করছে। তারা অস্ত্র ব্যবসার রুট হিসেবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশকে। তবে এ সুযোগে এসব অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্ষুদ্র একটি অংশ বাংলাদেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাতেও চলে যাচ্ছে বলে তাদের ধারণা।
এ ছাড়া এ ধরনের অস্ত্রের চালান দেশে আরও রয়েছে বলে মনে করছেন অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে কিভাবে এত অস্ত্র দেশে ঢুকছে তা নিয়ে তারা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। তারা বলেন, এভাবে অস্ত্রের চালান ঢুকতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র বাংলাদেশের জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসী কোনো সংগঠন ব্যবহার করে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অন্য কোনো উদ্দেশ্য কিংবা ভিন্ন কোনো দেশের জন্য এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা হয়েছিল কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারা এসব আগ্নেয়াস্ত্রের আমদানিকারক তা জানতে ইতিমধ্যে তারা সব ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করেছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবৈধ ক্ষুদ্রাস্ত্র নিয়ে কাজ করা সংগঠন বিপিডিসির (বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনার সেন্টার) প্রধান শরীফ এ কাফি বলেন, চীনের আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান নোরিনকো থেকে অস্ত্র কেনা খুব কঠিন কিছু নয়। তবে নির্ধারিত কিছু এজেন্টের মাধ্যমে অস্ত্র-গোলাবারুদ কিনতে হয়।
এসব এজেন্টের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনের পর ‘সর্বশেষ ব্যবহারকারীর সনদ’ (এন্ড ইউজার্স সার্টিফিকেট বা ইইউসি) জমা দিলে কারখানা থেকেই প্রয়োজনমতো অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ পাওয়া সম্ভব।
এসব এজেন্ট অস্ত্র সংগ্রহের পর ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশে পাঠায়। পরবর্তীকালে সময় বুঝে ছোট ছোট চালানে অস্ত্র-গোলাবারুদ চলে যায় কাক্সিক্ষত ব্যক্তি ও সংগঠনের হাতে।
অস্ত্র উদ্ধার টিমের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করছেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো চীনের কারখানায় তৈরি। যদিও অস্ত্রের গায়ে উৎপাদনকারী দেশের নাম উল্লেখ নেই। তবে অস্ত্রের ধরন দেখে এগুলো চীনে তৈরি বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকও শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারকৃত অস্ত্র চীনের তৈরি বলে জানান।
বিপিডিসির প্রধান শরীফ এ কাফি আরও বলেন, চট্টগ্রামে যে অস্ত্রের চালান আটক হয়েছিল তার মধ্যে নতুনগুলো চীনের প্রতিষ্ঠান নোরিনকোতে তৈরি। এ অস্ত্র কেনার জন্য যে সনদ জমা দেয়া হয়েছে সেটাও ভুয়া ছিল বলে আমার মনে হয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের অস্ত্র চোরাচালান চক্রটি অতীতেও এ ধরনের ভুয়া সনদ দিয়ে নোরিনকো থেকে অস্ত্র কিনেছে বলে অনেক প্রমাণ আছে।
অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক চক্রটি বঙ্গোপসাগরের আকিয়াব বন্দরের অদূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ভাসমান জাহাজ থেকেই ছোট ছোট ট্রুলারে এসব আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেয়। পরে এসব আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন হাত ঘুরে বাংলাদেশে ছোট ছোট এজেন্টের কাছে আসে। এরপর সময় সুযোগমতো তা পৌঁছে দেয়া হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
বিপিডিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নজরদারি না থাকায় দেশের অন্তত দেড়শ’ অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বিভিন্ন সীমান্তের ৫৭টি পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান দেশে আনছে। পরে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে।
সংগঠনটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতীয় অস্ত্রের পাশাপাশি চীন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছরে অস্ত্রের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। এভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বাজার।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাচালানিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র পাচার বন্ধে বিজিবির মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। যদিও দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে বিজিবির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে কিছু কিছু অভিযোগের তীর তাদের দিকেও আছে। অনেকে বলেন, বিজিবি এবং পুলিশ সদস্যরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে এসব অস্ত্রের চালান রাজধানী পর্যন্ত চলে আসার কথা নয়।
প্রসঙ্গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত রূপগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ৬২টি এসএমজি, ৫১টি ম্যাগাজিন, ৫টি পিস্তল, ২টি ওয়াকিটকি, ২টি রকেট লঞ্চার, ৫৪টি গ্রেনেড, বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ডেটোনেটর উদ্ধার করা হয়। বিশেষভাবে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে দড়ি দিয়ে এসব অস্ত্র গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। এর আগে ২০১৬ সালের জুনে রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়িতে একটি খাল থেকে ৯৭টি পিস্তল, ৪৯৪টি ম্যাগাজিন ও ১ হাজার ৬০টি গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। এ ছাড়া শনিবার এই চালানের মধ্যে আরও ৫টি এসএমজি চাইনিজ রাইফেল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়।
এর আগে ২০০৩ সালের ২৮ জুন বগুড়া জেলার কাহালু এলাকায় একটি ট্রাকে আনারস দিয়ে ঢাকা অবস্থায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও ৭০ হাজার রাউন্ড তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়। ওই সব অস্ত্র-গুলি কাদের ছিল সে প্রশ্নের আজো সদুত্তর মেলেনি। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রামের সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় পুলিশ কর্তৃক আটক ১০ ট্রাক মামলার রায় হয়েছে। ওই চালান চীন থেকে ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফার জন্য আনা হয় বলে রায়ে বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আনা ওই মামলার রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী জামায়াতের তৎকালীন আমীর মতিউর রহমান নিজামী (যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে) ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া ছাড়াও ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন, অস্ত্র বহনকারী ট্রলারের মালিক হাজি সোবহান, চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মোহাম্মদ।
Posted ২:২৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৪ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta