কক্সবাংলা ডটকম(৫ জুলাই) :: আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ একবার বলেছিলেন, ‘তরুণরাই তারুণ্যের অপচয় করে।’ কথাটা আর যাই হোক, জার্মান ফুটবলের যুব প্রকল্পের সঙ্গে খাটে না।
২০০৯ অনূর্ধ্ব-১৭ ইউরো জিতে শুরু করেছিলেন মারিও গোটশে, স্কোড্রান মুস্তাফিরা। মাঝে চার বছরের বিরতির পর মারাকানায় বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির জয়সূচক গোল আসে গোটশের পা থেকে। সে বছরই অনূর্ধ্ব-১৯ ইউরো জিতে গোটশেদের পথ ধরেছিলেন জুলিয়ান ব্রান্ড, জশুয়া কিমিখরা।
তিন বছর পর এবার সেই কিমিচ ও ব্রান্ডসহ টিমো ওয়ের্নার, লার্স স্টিন্ডল, লিওন গোর্তেকাদের মতো একঝাঁক তারুণ্যে ভরসা রেখে বিশ্বকাপের ‘ড্রেস রিহার্সেল’ ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ জিতল জার্মানি। যেখানে প্রতিপক্ষ দলগুলোয় ছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, পেপে, আরতুরো ভিদাল, এদুয়ার্দো ভার্গাস, হ্যাভিয়ের হার্নান্দেজদের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা। কিন্তু তাদের পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন গড়ে ২৪ বছর বয়সী জার্মান স্কোয়াড!
জোয়াকিম লোর এ দলে ছিলেন না ম্যানুয়েল নয়্যার, থমাস মুলার, মেসুত ওজিল, ম্যাট হামেলস, জোরোম বোয়াটেং কিংবা টনি ক্রুসদের মতো পরীক্ষিত ফুটবলার। কারণ ২০১৮ বিশ্বকাপ সামনে রেখে জার্মান পাইপলাইনকে ঝালিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন লো; হেড কোচের এ চ্যালেঞ্জের জবাবটা এর চেয়ে ভালোভাবে দিতে পারতেন না ওয়ের্নার-ড্রাক্সলাররা। মজার ব্যাপার, ড্রাক্সলাররা কনফেডারেশন্স কাপ জেতার দুদিন আগে অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোও জিতে নেয় দেশটির খুদেরা। মুলার-ওজিলদের পরীক্ষিত প্রজন্ম ছাড়াই কথিত ‘বি’ দল নিয়ে লোর কনফেডারেশন্স কাপ জয় এবং তার ৪৮ ঘণ্টা আগে বয়সভিত্তিক দলের অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো জয় প্রমাণ করে দেয় জার্মান ফুটবল পাইপলাইনের সামর্থ্যকে, অর্থাত্ আগামীর জার্মানি আরো ভয়ঙ্কর!
অথচ খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, মাত্র ১৭ বছর আগেও নিদারুণ দুর্দশায় পতিত হয়েছিল জার্মান ফুটবল। ’৯৮ বিশ্বকাপে ম্যাথিয়াস-ক্লিন্সম্যানদের মতো বয়স্ক তারকাদের নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল ‘ডাই ম্যানশ্যাফট’দের। শূন্যতাটা তখনো সেভাবে কেউ টের না পেলেও দুই বছর পর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে বেরিয়ে আসে জার্মান ফুটবলের খাঁ-খাঁ দশা। একটি ম্যাচও জিততে না পারায় গ্রুপ টেবিলের তলানিতে থেকে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়! বিপদটা বুঝতে পেরেছিলেন জার্মান ফুটবল নিয়ন্তারা। বয়সভিত্তিক দলকে শক্তিশালী করে জাতীয় দলে সমৃদ্ধি আনতে যুব প্রকল্পকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। সেই প্রকল্পে অর্থ ও খাটুনি বিনিয়োগের সংমিশ্রণে অর্জিত ফসল ঘরে তুলছে জার্মানি।
২০১১ সালের মার্চে ‘টেন ইয়ারস অব একাডেমিজ: ট্যালেন্ট পুলস অব টপ লেভেল জার্মান ফুটবল’— নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মান ফুটবল লিগ (জিএফএল)। সে প্রতিবেদনে তত্কালীন জিএফএল প্রধান রেইনার্ড রউবেল জানান, ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া ফুটবলের যুব প্রকল্পে ৫২ কোটি ইউরো ঢেলেছে জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। বিশাল অংকের এ অর্থের সিংহভাগ বিনিয়োগ করা হয়েছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ক্লাবগুলোর একাডেমিতে। এসব ক্লাবের একাডেমিতে অনূর্ধ্ব ১২ থেকে অনূর্ধ্ব ২৩ বছর বয়সী দলগুলোকে আলাদা করে দেখভাল করে দেশটির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। প্রতিভা অন্বেষণের পাশাপাশি নজর দেয়া হয় খেলোয়াড়দের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও।
একপর্যায়ে দেখা গেল, একাডেমি থেকে উঠে আসা বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েট। জার্মান ফুটবলে ‘ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট মডেল’-এ খেলোয়াড়দের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কনফেডারেশন্স কাপ জয়ের পর ব্যাখ্যা করেন দেশটির সাবেক স্ট্রাইকার এবং জোয়াকিম লোর টেকনিক্যাল স্টাফের সদস্য অলিভার বিয়েরহফ, ‘আমরা কী চাই, তারা সেটা খুব সহজেই বুঝতে পারে। বয়সভিত্তিক দল কিংবা জাতীয় দলে আমরা যখন তখন ফরম্যাট পাল্টে ফেলতে পারি। ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলে এটা আপনি খুব সহজে করতে পারেন।’
যুব প্রকল্পে বিনিয়োগ ও নজরদারি বাড়ানোর ফলটা হাতেনাতে মেলে ২০১৪ বিশ্বকাপে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া ফিলিপ লাম-শোয়েনস্টেইগারদের বেশির ভাগই ঘরোয়া ক্লাবগুলোর একাডেমি থেকে উঠে আসা। সেই ধারা বহাল রয়েছে কনফেডারেশন্স কাপজয়ী ওয়ের্নার-স্টিন্ডলদের মাঝেও। স্টিন্ডল উঠে এসেছেন বুন্দেসলিগা ২-এর (দ্বিতীয় বিভাগ) ক্লাব কার্লশ্রুর যুব প্রকল্প থেকে, একইভাবে ওয়ের্নার-কিমিখ স্টুটগার্টের, জিন্টার ফ্রেইবুর্গের, ড্রাক্সলার-গোর্তেকা শালকের, এমেরে কান ফ্রাংকফুর্টের এবং স্যান্ড্রো ওয়াগনার বায়ার্নের যুব প্রকল্পের ‘প্রডাক্ট’। ২০০০ ইউরোয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা জার্মান স্কোয়াডের গড় বয়স ছিল ২৮.৫ বছর। ১৪ বছর পর বিশ্বকাপ জেতা স্কোয়াডের গড় বয়স ছিল ২৬.৩ বছর। এবার কনফেডারেশন্স কাপজয়ী দলটির গড় বয়স ২৪ বছর, যেখানে আবার মূল তারকা খেলোয়াড়রাই অনুপস্থিত।
কনফেডারেশন্স কাপ জেতায় আগামী বুধবার ফিফা র্যাংকিংয়ে ব্রাজিলকে টপকে শীর্ষস্থান দখল করবে জার্মানি। সম্ভবত এ আনন্দেই রাশিয়ায় শিরোপা হাতে লো বলেছেন, ‘এ শিরোপা জয়ের অর্থ হলো জার্মানি এখনো বিশ্বসেরা।’ লোর এ অকাট্য দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে আসা তারুণ্যের ঢেউ, যে তারুণ্যকে যৌবনের অপচয় করতে শেখানো হয়নি।
Posted ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৫ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta