কক্সবাংলা ডটকম(১৪ মার্চ) :: ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নানা দাবিতে ২০০-এর বেশি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এসব কর্মসূচি পালনের সময় গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করায় ভোগান্তি বেড়েছে নগরবাসীর। সপ্তাহের অধিকাংশ কর্মদিবসে এসব কর্মসূচির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলকে দাবি আদায়ের মোক্ষম সময় বলে মনে করেছেন আন্দোলনকারীরা।
যৌক্তিক-অযৌক্তিক ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর এসব কর্মসূচি ঘিরে দুর্ভোগও পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। টানা এসব কর্মসূচির কারণে বিরক্ত হয়ে বেসরকারি চাকরিজীবী রাজধানীর খিলক্ষেতের বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গত সোমবার বনানীতে অবরোধ করা হয়। গুগল ম্যাপে দেখলাম অফিসে যাওয়ার সব রাস্তায় রেড কালার। সর্বত্র যানজট। রোজার দিনে এসব কর্মসূচি আমাদের ভোগান্তিতে ফেলছে।’
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দাবিতে সরব নানা পক্ষ। চাকরি স্থায়ীকরণ, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ভাতা বৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তিসহ নানা দাবি জানাচ্ছেন তারা। সরকারের প্রথম ৪৬ দিনে ঢাকা শহরে ৬৪টি সংগঠনের পক্ষ থেকে ৩৬০টি দাবি উত্থাপন করা হয়। দেশের অন্য বিভাগীয় শহরগুলো বিবেচনায় নিলে দাবির সংখ্যা হাজারের বেশি।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি অবরোধ করা হয় শাহবাগ মোড়। গুরুত্বপূর্ণ এ মোড়ের আশপাশে রয়েছে একাধিক হাসপাতাল। কর্মসূচির কারণে এসব হাসপাতালের রোগীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ফেব্রুয়ারিতেই নিয়োগ বাতিল হওয়া প্রাথমিক শিক্ষক, এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক, শহিদ পরিবারের সদস্যরা শাহবাগ অবরোধ করেন। চলতি মাসেই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারীরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। চাকরি ফিরে পেতে বিডিআর সদস্যরাও শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন।
রাজধানীর একটি স্পটে অবরোধ করা হলে প্রধান সড়কের পাশাপাশি তার প্রভাব পড়ে অলিগলিতেও। কর্মসূচির কারণে সচিবালয়ে আটকা পড়েন কর্মকর্তারা। দীর্ঘ সময় আটকা পড়ে অনেকে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভোগেন। যান চলাচল বন্ধ হয়ে হওয়ার কারণে অনেকে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন। যাদের সঙ্গে মালপত্র ছিল, দ্বিগুণ হয় তাদের কষ্ট। বাধ্য হয়ে বাসেই বসে থাকতে হয়। রাতেও প্রায় একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় রাস্তায় বের হওয়া যাত্রীদের।
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের কারণে গুলশান-বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, বিজয় সরণি, জাহাঙ্গীর গেট ও মগবাজার এলাকায় তৈরি হয় ভয়াবহ যানজট। জুলাই আন্দোলনে আহতরাও পঙ্গু হাসপাতালের সামনে সড়ক অবরোধ করেন। তাদের কর্মসূচির কারণে হাসপাতালে আসা রোগীরাও হয়রানির মুখে পড়েন।
শাহবাগের পরই বেশি কর্মসূচি পালন করা হয় জাতীয় প্রেসক্লাব ও সচিবালয় এলাকায়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের আশপাশে এসব কর্মসূচি যেমন যানজট তৈরি করে, তেমনি সচিবালয়ে কর্মরতদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। একাধিকবার ঘেরাও করা হয় সচিবালয়। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা তো সচিবালয়ে অবস্থান নিয়ে পরীক্ষা বাতিল করার দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে। আবার পরীক্ষার ফলের পর ফেল করা শিক্ষার্থীরা অটোপাসের দাবি জানিয়েও সচিবালয় ঘেরাও করে।
অভ্যুত্থানের পর পরই আনসার সদস্যরা সচিবালয় ঘেরাও করলে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে দেওয়ার দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সচিবালয় অভিমুখে কর্মসূচি পালন করেন। বাদ যাননি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ট্রাস্টি বোর্ডের অনিয়ম বন্ধের দাবিতে কর্মসূচি পালন করেন প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
জাতীয় প্রেসক্লাবে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, শতভাগ উৎসব ভাতা, সরকারি কর্মচারীদের মতো একই হারে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার দাবিতে টানা আন্দোলন করেন শিক্ষকরা। পরে শিক্ষা উপদেষ্টা তাদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও টানা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন।
আন্দোলন করেন বিভিন্ন স্তরের শ্রমিকরাও। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে তারা কর্মসূচি পালন করেন। হাইকোর্টের রায় ঘিরে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা ঢাকার একাধিক পয়েন্টে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। এতেও ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয় জনসাধারণকে। প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করার দাবিতে প্যাডেলচালিত রিকশার চালকরাও রাস্তায় নামেন।
অন্যদিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা দুই দফায় ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। গাড়ির দাম ও দৈনিক জমা কমানোর দাবিতে তারা এই কর্মসূচি পালন করেন। সর্বশেষ মিটারে গাড়ি না চালালে জরিমানার বিধান বাতিলের দাবিতে তারা অবরোধ কর্মসূচি পালন করলে বিআরটিএ সেই বিধান বাতিল করে।
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সরকারি তিতুমীর কলেজের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা ছিল দেশজুড়ে। তারা সড়ক অবরোধের পাশাপাশি মহাখালীতে রেললাইনও অবরোধ করেন। শিক্ষার্থীদের ছোড়া ঢিলে রক্তাক্ত হন শিশুসহ ট্রেনের যাত্রীরা। টানা এই কর্মসূচি ঘিরে নগরবাসীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। পরে সরকার দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে তারা কর্মসূচি স্থগিত করেন। আবার সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল ইস্যুতে সংঘর্ষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজসহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাধিকার সংঘর্ষের কারণে যান চলাচল বন্ধ থাকে। ট্রেইনি চিকিৎসকরা তাদের ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে কয়েক দফায় আন্দোলনে নামেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইরশাদ মাহমুদ বলেন, রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে একপ্রকার জিম্মি করে ফেলা হচ্ছে। সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া সুশৃঙ্খলভাবে জানানো উচিত।
তবে বিশেষজ্ঞরা দাবি জানানোর বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীনের মতে, মানুষ দীর্ঘদিন দাবি-দাওয়া আদায়ের সুযোগ না পাওয়ায় সরকার পরিবর্তনে এসব বেড়েছে। তাই সরকারকে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অন্যদিকে জনদুর্ভোগ তৈরি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম। তিনি বলেন, কেউ দাবি আদায়ের নামে রাস্তা আটকাবেন না। সামনে ঈদ, সড়ক অবরোধ করে জনগণের ঈদযাত্রায় ভোগান্তি বয়ে আনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
Posted ৭:০৫ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta