কক্সবাংলা ডটকম(৯ জুন) :: ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় অনেক গ্রাহক টাকা তুলে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ টাকা তুলে নেয়ার ব্যাপারে ব্যাংকে যোগাযোগ করছেন। এই টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের হিড়িক পড়েছে।
অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর আগেই কে কত টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সব মিলে সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই কারণে ব্যাংকের আমানত তোলা হচ্ছে। প্রথমত, প্রস্তাবিত বাজেটে আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ। আগামী ২ মাস পর সঞ্চয়পত্রের এ সুদের হার কমানো হবে- সরকারিভাবে এমন ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এরই প্রভাব পড়েছে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের ওপর। নিশ্চিত নিরাপত্তার আশায় মানুষ দ্রুত ব্যাংকের আমানত ভেঙে নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখার ম্যানেজার বলেন, বাজেটের পর এ শাখার ১০ জন গ্রাহক যোগাযোগ করেছেন। দু’জন টাকা তুলেছেন। বাকিরা ডিসেম্বরের আগে আমানত তুলে ফেলবেন। তিনি বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে প্রতি বছর ডিসেম্বরে আবগারি শুল্ক কাটা হয়। এ জন্য ডিসেম্বরের আগেই অনেকে ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে ফেলছেন।
সোনালী ব্যাংকের অপর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিনই গড়ে বিপুল অংকের টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। তাই চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
প্রস্তাবিত বাজেটে এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীদের ওপর ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানতের ওপর আড়াই হাজার টাকা। এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত ১২ হাজার টাকা এবং পাঁচ কোটি টাকার বেশি হিসাব থেকে ২৫ হাজার টাকা কেটে রাখা হবে। আগামী জুলাই থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এর পরই বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী হইচই শুরু হয়। সরকারি এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরাও।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, কর পরিশোধ করার পর বৈধ টাকা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু আমানত রক্ষার পরিবর্তে আবগারি শুল্কের নামে জোর করে টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের কাজ রাষ্ট্র করতে পারে না।
জানা গেছে, আবগারি শুল্ক কার্যকরের পর নতুন অর্থবছরে আমানতের ওপর এ খাতে রাজস্ব আয় হবে মাত্র ৯২৫ কোটি টাকা। এই অর্থ মোট রাজস্ব আয়ের দশমিক ৩১ শতাংশ। আর এই খাতের আয়ের মধ্যে ৫৮৪ কোটি টাকাই আসবে স্বল্প আমানতকারীদের কাছ থেকে। অন্যদিকে নতুন প্রস্তাব কার্যকর না করলে এই খাতে আদায় হবে প্রায় ৭১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আবগারি শুল্কহার বাড়িয়ে সরকার বাড়তি আয় করবে ২১০ কোটি টাকা।
এদিকে আগামী দুই মাস পর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছে অর্থমন্ত্রী। ফলে এর আগে যারা সঞ্চয়পত্র কিনবেন, তারা বর্তমান হারে সুদ পাবেন। এ কারণে ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র কেনার হিড়িক পড়েছে। বুধবার সরকারি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় গিয়ে দেখা গেছে সঞ্চয়পত্র কিনতে মানুষ দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাইম ব্যাংকের আদমজী শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক কাজ করছে। কিছু শিক্ষিত মানুষকে বোঝাতে পারলেও সাধারণ মানুষকে বোঝানো যাচ্ছে না। তারা বলছে, ব্যাংকে টাকা রাখবে না। ঋণ আদায় বা যে কোনো বিষয়ে ফোন করলে আগে তারা জানতে চায় তাদের টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে খুব বিব্রতকর অবস্থা চলছে।
অগ্রণী ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, আবগারি শুল্ক নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন গ্রাহক যোগাযোগ করেছেন।
সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে আমানতে সুদের হার কমে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর পর প্রতি বছর কাটা হবে হিসাব পরিচালনার সার্ভিস চার্জ, এটিএম কার্ড ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং চার্জ। কোনো হিসাবে মুনাফা হলে তার ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎসে কর দিতে হয়। সব মিলে ব্যাংকে টাকা রেখে গ্রাহকের তেমন কোনো লাভ হয় না।
সরকারি ব্যাংকে আমানতকারী ফেরদৌসী আহমেদ বলেন, এত কর কাটার পর আবগারি কর কাটা হচ্ছে। এতে আমাদের মূল আমানতের ওপর হাত পড়ছে। কষ্ট করে সংসার থেকে টাকা বাঁচিয়ে সঞ্চয় করলাম এখন সেই টাকা সরকার কেটে নিয়ে যাবে। তাহলে ব্যাংকে টাকা রেখে কি হবে। বিপদের দিনের জন্যই সামান্য সঞ্চয় করি, সে টাকাই যদি চলে যায় তাহলে আমরা চলব কি করে। তিনি বলেন এ অবস্থা চললে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখার বা কষ্ট করে সঞ্চয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
জানতে চাইলে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, সরকারি এ সিদ্ধান্তে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবেন। এতে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, কোনো পণ্যকে নিরুৎসাহিত করতে আবগারি শুল্ক দেয়া হয়। ব্যাংক হিসাবে তো এ ধরনের শুল্ক হয় না। বিষয়টা প্রত্যাহার করা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, দেশের ব্যাংকগুলোতে ৮ কোটি ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৯৪৬টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে ৮ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ আছে এমন হিসাবের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯৬ লাখ। আর ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা আছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৭৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৬৯টি। ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা আছে এমন হিসাবের সংখ্যা ৯ লাখ ৬২ হাজার, ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা হিসাবের সংখ্যা ৫১ হাজার ৭৮১টি এবং ৫ কোটি টাকার বেশি আছে এমন হিসাব ১৪ হাজার ১৬টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার বছরের পর বছর ধরে অনেকটা লুকিয়েই আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক কেটে নিয়েছে। ব্যাংক গ্রাহকরা এসব জেনেও কিছু করতে পারছেন না। বিভিন্ন সময়ে বাজেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র দুবার ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপের ঘোষণা বাজেটে উল্লেখ ছিল। বাজেটের বাইরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আলাদা করেও আবগারি শুল্ক বাড়ায়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আমানতকারীদের জানানো হয়নি।
Posted ৩:১৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৯ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta