কক্সবাংলা ডটকম(১৭ জুন) :: ২০১২ সালেও ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে কমে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত তা ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এ সময়ের মধ্যে এটাই আমানতের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেলেও বাড়ছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। এর সঙ্গে তাল মেলাতে বেসরকারি অনেক ব্যাংক সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহে ঝুঁকছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, বাজেটে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে। অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনছেন, যা ঋণ ও আমানত প্রবৃদ্ধির ব্যবধান বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের আমানত প্রবৃদ্ধি হয় ২০১২ সালে। এর পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে এ প্রবৃদ্ধি। ২০১৩ সালে আমানত প্রবৃদ্ধি হয় ১৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। পরের বছর এ প্রবৃদ্ধি আরো কমে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে। ২০১৫ সালে ব্যাংক আমানতে ১৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০১৬ সালে তা দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশে। আর ২০১৭ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে আমানত প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক কমে মাত্র ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি কমলেও বাড়ছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। ব্যাংকিং খাতে গত কয়েক বছরের ঋণ প্রবৃদ্ধি পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৩ সালে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। ওই বছর ব্যাংকিং খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পরের বছরই ঋণ প্রবৃদ্ধিতে গতি ফেরে। ২০১৪ সালে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ১৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ২০১৫ সালে আবারো তা কমে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ২৬ শতাংশে। তবে গত বছর ব্যাংকিং খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
বাড়তে থাকা এ ঋণ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে বেসরকারি অনেক ব্যাংকই আমানতে বাড়তি সুদ প্রস্তাব করছে বলে জানান ব্যাংকাররা।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি বড় ব্যাংক কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়তি সুদে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে। অনেক ব্যাংক তিন মাস মেয়াদি এফডিআরে সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনলেও এখন ৭ শতাংশ প্রস্তাব করছে। এভাবে আমানতের সুদহার বাড়লে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাবে।
ব্যাংক আমানতে সুদহার বর্তমানে মূল্যস্ফীতির নিচে নেমে এসেছে। ফলে আমানতকারীরা ঝুঁকছেন সঞ্চয়পত্রে। চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার ৯৯ কোটি টাকার। শুধু এপ্রিলেই ৪ হাজার ৪৫১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকেই বর্তমানে নগদ টাকার সংকট চলছে।
নতুন প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সফিউল আজম বলেন, দেশের বেসরকারি খাতের অধিকাংশ ব্যাংকেই নগদ টাকার সংকট রয়েছে। আমাদের ব্যাংকে সংকট না থাকলেও উদ্বৃত্ত কোনো টাকা নেই। তবে নতুন অর্থবছরের বাজেট পাস হয়ে গেলে সংকট কিছুটা কেটে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৫ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণ ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে ২০১৫ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর হাতে ১ লাখ ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল। ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের এ পরিমাণ ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ১ লাখ ২৮ হাজার ৯ কোটি টাকায় নেমে আসে। আর চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার ৩১৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এপ্রিল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ ৪৫ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।
মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার যে পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে, তা ভালো সংবাদ নয়। যেসব ব্যাংক আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছিল, তারা পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানতের সুদহার বাড়াতে বাধ্য হবে। তবে এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোয় আমানতের সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। সরকারি ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, যে কারণে কলমানি মার্কেটে টাকার কোনো সংকট নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার কলমানি বাজারে গড়ে ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ সুদে লেনদেন করেছে ব্যাংকগুলো। বছরের শুরুতে কলমানি বাজারের গড় সুদহার ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ। মঙ্গলবারের কলমানি বাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক একাই ৪ শতাংশ সুদে ৮৬৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। একই দিন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক বিনিয়োগ করেছে ৪০০ কোটি টাকা। কলমানি বাজার থেকে ঋণ নেয়া সবক’টি ব্যাংকই ছিল দেশের বেসরকারি খাতের।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ঈদের আগে ব্যাংকগুলোয় স্বাভাবিকভাবেই নগদ টাকার চাহিদা বেশি থাকে। সে হিসাবে বেসরকারি কিছু ব্যাংকে নগদ টাকার কিছুটা সংকট থাকতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। ব্যাংকিং খাতে এ মুহূর্তে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে, তাতে আমানতের সুদহার বাড়ার কথা নয়। সরকার যদি ব্যাংকিং খাত থেকে টাকা নেয়া শুরু করে, তবেই আমানতের সংকট হবে।
Posted ২:২৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৭ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta