
কক্সবাংলা ডটকম(৪ অক্টোবর) :: দেশে বিগত ১৫ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১০৫ শতাংশ বলে গত বছরের ১৬ এপ্রিল তথ্য দিয়েছিল বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।
আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২০-২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে ইলিশের আহরণ কমেছে।
আহরণ কমার অর্থ হচ্ছে ইলিশের উৎপাদন কমছে। ইলিশের উৎপাদন আকাশছোঁয়া হলে দামও নিশ্চয় কম হতো। কিন্তু বাস্তবে তার চিত্র উল্টো, বাজারে সাধারণ মানুষের ইলিশ কেনার সামর্থ্য দিন দিন শেষ হয়ে আসছে।
ইলিশের উৎপাদনের পরিস্থিতিতে ৪ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন প্রজননের স্বার্থে মা ইলিশ ধরা ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
সে হিসেবে গতকাল শুক্রবার রাত থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এ সময়ে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুদ করলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
ইতঃপূর্বে এটি ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখা হতো।
সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা যে খাতা-কলমে ইলিশের উৎপাদন বেশি দেখেছি, তা কিন্তু সঠিক নয়।
তিনি মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য উল্লেখ করে জানান, চলতি বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে ইলিশ আহরণ গত বছরের তুলনায় ৩৩.২০ শতাংশ এবং ৪৭.৩১ শতাংশ কম হয়েছে।
এই দুই মাসে মোট আহরণ হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৯৩.৫০ মেট্রিক টন, যা গত বছরের তুলনায় ২২ হাজার ৯৪১.৭৮ মেট্রিক টন (৩৮.৯৩%) কম। সার্বিকভাবে ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত ইলিশ আহরণ ক্রমাগতভাবে কমেছে।
মৎস্য উপদেষ্টা বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ইলিশের মোট আহরণ ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ মেট্রিক টন। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট আহরণ হয়েছে ৫ লাখ ১২ হাজার ৮৫৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এ সময়ে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে।
এদিকে মন্ত্রণালয়টির এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, ইলিশের উৎপাদন আগেও কম ছিল। বিগত সরকার বাহবা নেওয়ার জন্য উৎপাদনের তথ্য বাড়িয়ে বলতে বাধ্য করেছে।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি- এভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাড়িয়ে কী লাভ হবে? খাতা-কলমে বেশি দেখানো হচ্ছে, কিন্তু ক্রেতারা বাজারে গিয়ে ইলিশ পাচ্ছেন না।
এই কর্মকর্তা বলেন, বছরে ৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদনের অর্থ হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি কেজি। সে হিসাবে ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যেকের ভাগে ৩ কেজি করে ইলিশ পড়ে। কিন্তু বাস্তবে কতজন ইলিশ খেতে পারছেন?
ইলিশের উৎপাদন কম হওয়ার কারণ নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ ‘স্টাডি অন দ্য ইমপেক্ট অব পায়রা পোর্ট অ্যান্ড পটুয়াখালী পাওয়ার স্টেশন অন হিলশা ফিশ’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেছে।
তাতে বলা হয়, সরকার পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল ইলিশ অভয়ারণ্যের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ শুরু করছে। এতে ইলিশের আবাসস্থল নাজুক হয়ে পড়েছে এবং এর গুরুত্বপূর্ণ প্রজননক্ষেত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এটি আন্ধারমানিক নদী এবং রানাবাদ চ্যানেল থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে। এ স্থান ইলিশের গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত।
পটুয়াখালীতে পরিচালিত জরিপভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৭.১৪ শতাংশ উত্তরদাতার নৌকা এবং জালের মালিকানা রয়েছে। ৪২.৮৬ শতাংশ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে, ৩৮.১০ শতাংশ ১০ বছর এবং ১৪.২৯ শতাংশ ২২ বছর ধরে মাছ ধরছেন।
তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষ কর্মসংস্থানের অভাবে মাছ ধরেন। ৪২.৮৬ শতাংশ জেলে সমুদ্রে যান, ৩৮.১০ শতাংশ নদীতে এবং ১৯.০৫ শতাংশ মোহনায় মাছ ধরেন। তাদের বক্তব্য- জাহাজের ঘন ঘন চলাচলের ফলে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
তা ছাড়া আন্ধারমানিকের ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণ হওয়ায় পলি জমে থাকা এবং দূষণের ফলেও ইলিশ কম ধরা পড়ছে। ৮৭.৬২ শতাংশ জেলে পায়রা বন্দর এবং পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ও ১২.৩৮ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবজাতীয় হস্তক্ষেপকে ইলিশ হ্রাসের জন্য দায়ী মনে করেন।
গবেষণায় আরও বলা হয়, সমুদ্র, নদী বা মোহনায় ইলিশ মাছের ওপর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে এবং ইলিশের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। তা ছাড়া ইটভাটা, অতিরিক্ত উন্নয়নের চাপ, খাদ্যের অভাব এবং প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ ইলিশ মাছের মজুদ হ্রাসে ভূমিকা রাখছে।
এদিকে বিএফআরআই সাগর ও নদীতে ইলিশের উৎপাদন হ্রাসের পেছনে আরও কিছু কারণ জানিয়েছে। তাতে বলা হয়, ইলিশ মাছের জীবনচক্রের জন্য সমুদ্র ও নদী উভয় পরিবেশ অপরিহার্য। পরিপক্ব মা ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে মোহনা হয়ে স্বাদুপানির নদীতে প্রবেশ করে। ডিম ফুটে লার্ভা বড় হয়ে সমুদ্রে ফিরে যায় এবং পরিপক্বতা অর্জন করে। জাতীয় উৎপাদনের প্রধান অংশ বরিশাল বিভাগ থেকে আসে, যা প্রতি বছর মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ।
ইলিশের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক মাইগ্রেশন রুটসমূহ অক্ষুণ্ন রাখা অত্যন্ত জরুরি। ভোলা-নোয়াখালী ও ভোলা-পটুয়াখালীর মধ্যবর্তী মোহনা ইলিশের বৃহত্তম প্রজনন ও মাইগ্রেশন পথ। এই মোহনায় অসংখ্য চর ও ডুবোচর রয়েছে। জোয়ারের সময় এগুলো ৪-৫ হাত পানির নিচে থাকে এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে, যা নদীর নাব্যতা ও প্রজনন পরিবেশের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।
বিএফআরআইর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু কাউসার দিদার বলেন, বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১১ শতাংশ ইলিশ। এ খাতে প্রায় ৫ লাখ জেলে সরাসরি ও ২৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে ইলিশ আহরণ, বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে জড়িত।
তিনি বলেন, নদীর নাব্য হ্রাস, পানিপ্রবাহ পরিবর্তন এবং দূষণের কারণে ইলিশের প্রজননক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হয় এবং মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে শিল্প বর্জ্য, কৃষি রাসায়নিক এবং নগর বর্জ্য নদীতে মিশে পানির মান আরও অবনতি ঘটাচ্ছে।

Posted ২:১৯ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta