কক্সবাংলা ডটকম(১২ আগস্ট) :: দেশে ইসলামি দলের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। তবে এসব দলের বেশিরভাগই নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধিত নয়। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব কিছু ভোট থাকলেও বাকিগুলোর ভোটব্যাংক শূন্যের কোঠায়। ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে হাঁকডাক দেওয়ার বাইরে এসব দলের রাজনৈতিক কার্যকলাপও নেই।
তারপরও বিশেষ অঞ্চল ও মাদ্রাসাকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা এসব দল নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন বৃহৎ দুই জোটের মধ্যে। জামায়াতকে নিয়েও চলছে টানাপড়েন। ছোট ছোট দল নিয়ে ‘বৃহৎ জোটের’ রূপরেখা ঘোষণা করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও।
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভিরু। তবে শত শত বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করে এলেও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া ধর্মীয় বিভেদ খুবই সামান্য। রাষ্ট্রচিন্তকরা বলছেন, ধর্মভিরুতা আর ধর্মীয় গোরামি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। দেশে ধর্মীয় গোরামির স্থান নেই। আর এ কারণেই দেশের আপামর মানুষের কাছে কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল শক্ত অবস্থান গড়তে পারেনি।
বিশেষ কিছু অঞ্চল আর কয়েকটি মাদ্রাসাভিত্তিকই এসব দলের কার্যক্রম। এরপরও সাম্প্রতিককালে দেশের প্রধান দলগুলোকে এসব ধর্মভিত্তিক ক্ষুদ্র দল নিয়ে টানাটানির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এসব নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্য বিবাদেও জড়িয়ে পড়ছে তারা।
জানা যায়, বর্তমানে দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন একটি জোটের বাইরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন রয়েছে আরেকটি জোট। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন রয়েছে ৫৮ দলীয় জোট। এসব জোটের প্রতিটিতেই রয়েছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ইসলামি দল। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাম ও ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে আরও বেশ কয়েকটি ছোট জোট রয়েছে।
বিভিন্ন ইসলামি দলগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি দলের জন্ম অভিবক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে। তবে দীর্ঘ দিনের এ পথচলায়ও দেশের মানুষের কাছে তারা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন বা অবস্থান গড়ে নিতে পারেনি। আবার বিভিন্ন স্বার্থের দ্বন্দ্বে অনেক দল ভেঙে খানখান হয়েছে।
জানা যায়, বর্তমানে দেশে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও তরিকত ফেডারেশনের নিজস্ব কিছু ভোটব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ইসলামি দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী।
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন মওদুদী। পরবর্তী সময়ে দেশ ভাগের পর দলটি জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচালিত হয়। এরপর স্বাধীন দেশে নামকরণ হয় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও পরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন সম্পর্কিত একটি রুলের রায়ে এই সংগঠনের নিবন্ধন অবৈধ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেন। দলটির এই ৬৮ বছরের পথচলায়ও ক্ষমতায় যেতে পারেনি কখনো। বরং ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদ- কার্যকর এবং নাশকতার অভিযোগে দল ও এর ছাত্রসংগঠনের বহুসংখ্যক নেতা গ্রেপ্তার ও কারাদ-ের ফলে বর্তমানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জামায়াত।
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন মূলত চরমোনাই পীরের অনুসারীদের রাজনৈতিক দল। এ ছাড়া খেলাফত মজলিশ, ইসলামী ঐক্যজোট ও তরিকত ফেডারেশন মূলত কয়েকটি জেলাভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন সময়ে এসব দল মূলত আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোটবেঁধে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আবারও শুরু হয়েছে জোটের খেলা। ছোট-বড় ইসলামি দলগুলো বিভিন্ন জোটে নিতে শুরু হয়েছে তৎপরতা।
ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক দল তরীকত ফেডারেশন। গত নির্বাচনে এ দলটি নিজস্ব প্রতীক বাদ দিয়ে জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকেই নির্বাচনে অংশ নেয়। তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব এমএ আওয়াল আমাদের সময়কে বলেন, আমরা ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গেই আছি। আরও কয়েকটি ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
তারাও এ জোটের অধীনে কাজ করবে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ১৪ দলের নির্দেশনা অনুযায়ী জোটের কর্মসূচি জোটগতভাবেই পালন করা হচ্ছে। ২০-দলীয় জোটের অন্যমত শরিক দল খেলাফত ইসলাম। বিএনপি জোটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে তারা। দলটির সর্বশেষ কাউন্সিলেও বলা হয়, তারা এই জোটের সঙ্গেই জোটবদ্ধ হয়ে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবে।
অন্যদিকে জোটে যোগদান নিয়ে সম্প্রতি ভাগ হয়ে গেছে ইসলামী ঐক্যজোট। দলটির একটি অংশ আবদুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোট থেকে বের হয়ে গেলেও জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রকিব একাংশের চেয়ারম্যান হিসেবে ষোষণা দিয়ে এই জোটের সঙ্গেই থেকে যান।
সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আবারও আলোচনায় এসেছে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলে বেশ নাটকীয়ভাবে দলটির মহাসচিব পদে আসেন মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী। আর মুফতি ওয়াক্কাসকে নির্বাহী সভাপতি করা হয়। তবে মুফতি ওয়াক্কাস দল থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করতে পারেন।
মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস বলেন, নতুন দল গঠনের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত করিনি। সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে আমরা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গেই আছি।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন জোটে ৫৮টি দল থাকার ঘোষণা দেওয়া হলেও এসব দলের বেশিরভাগেরই রাজনৈতিক অস্তিত্ব নেই। তারপরও জাপা চাচ্ছে আগামী নির্বাচনে এ দলগুলোকে নিয়ে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে। তবে বেশ কয়েকটি দল এরইমধ্যে এই জোট থেকে বের হয়ে গেছে। তারা আবার নতুন জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে যোগদানের জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আরও বেশ কয়েকটি ছোট ইসলামি দল। এর মধ্যে রয়েছে জাকের পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক ইসলামী ঐক্যজোট ও ইউনাইটেড ইসলামী পার্টিসহ বেশকিছু ইসলামি সংগঠন। তবে এখন পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কোনো জোটের পক্ষেই অবস্থান নেয়নি। বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি জোটের পক্ষ থেকে এই দলকে পক্ষে নিতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে সবচেয়ে বড় ইসলামি দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে ২০-দলীয় জোটে চলছে টানাপড়েন। সম্প্রতি এ নিয়ে প্রকাশ্যেই জামায়াতের বিষোদগার করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
তিনি এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন, সরকার জামায়াতের সঙ্গে গোপনে নতুন করে সম্পর্ক করতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার একদিকে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার কথা বলছে, জামায়াতের বিরুদ্ধে বলছে। অন্যদিকে গোপনে জামায়াতের সঙ্গে নতুন করে আত্মীয়তা করার জন্য জোরেশোরে চেষ্টা করছে।
সরকার জামায়াতকে বলছে, তোমরা বিএনপির সঙ্গে থাকবে কেন, আমরা আছি নাÑ মন্তব্য করেন গয়েশ্বর। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বরাবরই জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার খবর উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও জামায়াতের পক্ষ থেকে গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্যের এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
এদিকে কয়েক ইসলামি দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রমজানের আগে ইসলামী ঐক্যজোট (একাংশ), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (জাফরুল্লাহ খান), ইমাম-উলামা পরিষদ, ফরায়েজি আন্দোলনের কয়েক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন সরকারসমর্থিত তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব এমএ আউয়াল। সবাইকে নিয়ে একটি জোট গড়ার রূপরেখাও তৈরি করা হয়। তারা ১৪-দলীয় জোটের পক্ষ হয়েই কাজ করবে বলে জানা গেছে। তবে এই জোটের বিপরীত দিকে অবস্থান করছেন তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারী।
নতুন এই জোট গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব এমএ আউয়াল বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দীর্ঘদিন ধরে। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়।
Posted ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১২ আগস্ট ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta