কক্সবাংলা ডটকম(২৫ জুন) :: ঈদ কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হিসাবে, চলতি মাসেই অর্থনীতিতে অতিরিক্ত এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা যোগ হয়েছে। খাদ্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহন খাতে এই বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ, সরকারি চাকরিজীবী, দোকান কর্মচারী, পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমজীবীর বোনাস এবং সারা বছরের সঞ্চয়ের একটি অংশ এই কর্মকাণ্ডে যোগ হচ্ছে। এ ছাড়া সামনে দেশের নির্বাচন। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খরচের অর্থও এর মধ্যে আছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অংকের অর্থ ঘন ঘন হাতবদল হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন বাড়ছে, তেমনি চাঙ্গা হয়ে উঠছে গোটা অর্থনীতি। এসব কারণে মূল্যস্ফীতি ও পণ্য সরবরাহে ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরী বলেন, ঈদে সবচেয়ে বেশি টাকার প্রবাহ বাড়ে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই টাকা পোশাক, ভোগ্যপণ্য, শৌখিনতা ও ভ্রমণসহ বিনোদনমুখী খাতে বেশি ব্যয় হচ্ছে। কাজেই এটা একটা বড় ভুমিকা রাখে অর্থনীতিতে।
তিনি আরও বলেন, উৎসব অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। মানুষ এই উৎসব ঘিরে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কিছু না কিছু লাভবান হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জিডিপি হচ্ছে ২২ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। রোজা ও ঈদ উৎসবের অর্থনীতি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হেলাল উদ্দিন তার নিজস্ব একটি সমীক্ষা তুলে ধরে বলেন, রোজায় অতিরিক্ত এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন যোগ হচ্ছে।
তার সমীক্ষার হিসাব মতে, পোশাকের বাজারে যোগ হচ্ছে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নিত্যপণ্যের বাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। জাকাত ও ফিতরা বাবদ আসছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। পরিবহন খাতে অতিরিক্ত যাচ্ছে ৬৬০ কোটি টাকা। ঈদকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এর বাইরে আরও কয়েকটি খাতের কর্মকাণ্ড টাকার প্রবাহ বাড়বে। এর মধ্যে রয়েছে সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর, ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের বোনাস, যা ঈদ অর্থনীতিতে আসছে। এ ছাড়া আরও রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকা। ঈদের সময়ে প্রবাসীরা তাদের আত্মীয় স্বজনের কাছে বাড়তি ব্যয় মেটাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে থাকেন।
জানা গেছে, এক মাসেই রেমিটেন্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। টাকার অংকে যা ১৬ হাজার কোটির বেশি। এর মধ্যে শনিবার এক দিনেই রেমিটেন্স এসেছে ৭৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অতিরিক্ত চাহিদা পূরণে বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। এগুলো এখন তা খুচরা বাজারে বেচা কেনা হচ্ছে। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় নতুন পোশাক ক্রয়ে। মার্কেটগুলোতে সব বয়সী মানুষের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক বেচাকেনা হচ্ছে। এ সময় অভ্যন্তরীণ পোশাকের চাহিদা বাড়ে ব্যাপক হারে।
ঈদ উৎসব পালন করতে রোজার শেষ দিকে শহরের অধিকাংশ মানুষ গ্রামের বাড়িতে যান। ফলে অতিমাত্রায় বেড়ে যায় পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহন ও নৌযানের চলাচল। এতেও টাকার প্রবাহ বাড়ে। অন্যদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে বিনোদনের জন্য দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে এবং বিদেশেও বেড়াতে যান অনেকে। ফলে পর্যটন খাতেও যোগ হয় বাড়তি টাকার প্রবাহ। সার্বিকভাবে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য সাধারণত অন্য মাসের তুলনায় এই মাসে অতিরিক্ত অর্থের প্রভাব বেড়ে যায় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজার :
ঈদ অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হচ্ছে পোশাকের বাজার। এ সময় পোশাকের বেচাকেনা দোকানগুলোতে তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়। অভ্যন্তরীণ পোশাকের সবচেয়ে বড় জোগান আসছে পুরনো ঢাকার উর্দু রোডের অভ্যন্তরীণ পোশাক মার্কেট থেকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে দেশি পোশাক সরবরাহ হচ্ছে এখান থেকে। উর্দু রোডে আছে সাড়ে চারশ পোশাকের দোকান। চোখের দেখায় এসব দোকানের আয়তন খুবই ছোট হলেও রোজা ও ঈদ উপলক্ষে প্রায় প্রতিটিতেই কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের বুটিক ও ফ্যাশন হাউসগুলোও বেশ ব্যস্ত। ঈদের বাজার ধরতে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অতিরিক্ত পণ্য তৈরি করেছে।
ভোগ্যপণ্যের বাজার :
ঈদে সব ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভোজ্যতেল, মাংস, চিনি, ডাল, সেমাই এবং পেঁয়াজ। ফলে এসব পণ্যের আমদানিও বাড়ে। রোজা ও ঈদে ভোজ্যতেলের চাহিদা দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখ টন, চিনি সোয়া দুই লাখ থেকে পৌনে তিন লাখ টন, ডাল ৬০ হাজার টন, ছোলা ৫০ হাজার টন, খেজুর ১৩ হাজার টন, পেঁয়াজ তিন লাখ ২৫ হাজার থেকে তিন লাখ ৫০ হাজার টন, রসুনের চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব টাকার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকার জোগান দেয়া হয়।
বোনাস :
এ বছর সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী অষ্টম বেতন কাঠামোর আলোকে ঈদ বোনাস পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে তিন বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজস্ব কাঠামোতে বোনাস দিচ্ছেন। এ ছাড়া পোশাক ও বস্ত্রখাতের প্রায় ৭০ লাখ কর্মীর বোনাসও যোগ হচ্ছে, যা পুরোটাই যোগ হচ্ছে ঈদ অর্থনীতিতে।
দোকান কর্মচারী বোনাস :
ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে সারা দেশের দোকান কর্মচারীদের বোনাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে দেশে ২০ লাখ দোকান, শপিংমল, বাণিজ্য বিতান রয়েছে। গড়ে একটি দোকানে তিনজন করে ৬০ লাখ জনবল কাজ করছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলাম মন্টু বলেন, নিন্মে একজন কর্মীকে পাঁচ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেয়া হয়। ওই হিসাবে গড়ে বোনাস আট হাজার টাকা ধরে চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা বোনাস পাচ্ছে এ খাতের শ্রমিকরা, যা পুরোটাই ঈদ উৎসব অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে।
সঞ্চয় ভাঙানো :
রোজা ও ঈদ ঘিরে অর্থনীতিতে আরও যোগ হবে মানুষের সঞ্চয়ের টাকা। সারা বছর মানুষ যে সঞ্চয় করে রোজার সময়ে বাড়তি ব্যয় মেটাতে তার একটি অংশ ব্যয় করে থাকেন। যে কারণে রোজার শেষ সময়ে এসে ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট দেখা দেয়। কারণ ওই সময়ে গ্রাহকরা তাদের জমা টাকা তুলে নেন। ফলে বেড়ে যায় কলমানির সুদের হার। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বা ডিপিএস হিসাব ভাঙিয়েও অনেকে ঈদের বাড়তি খরচ মেটান।
Posted ১:২৮ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৫ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta