কক্সবাংলা ডটকম(১৮ জুন) :: ঈদুল ফিতর সামনে রেখে বাজারে নতুন নোট ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল নোট প্রস্তুতকারীরা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে চারজন হোতার অধীনে কমপক্ষে ১৫টি জাল নোট সরবরাহকারী চক্র এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রতি বছর ঈদ এলেই আর্থিক লেনদেন বেড়ে যায়। সে চাহিদা মেটাতে বরাবরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন নোট ছাড় করা হয়। আর এ সুযোগকে পুঁজি করে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল নোট প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় তিন জাল নোট সরবরাহকারীকে গত সপ্তাহে রাজধানীর শ্যামপুর ও তেজগাঁও থেকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
জানা গেছে, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৮ জুন থেকে জনসাধারণের হাতে বিভিন্ন কাউন্টারের মাধ্যমে নতুন নোট তুলে দেয়ার কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সময় রাজধানীর বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা থেকে ২ থেকে ৫০ টাকা মূল্যমানের নতুন নোট বিনিময় শুরু হয়। এর ঠিক তিনদিন পর, অর্থাত্ ১১ জুন বিকালে রাজধানীর শ্যামপুর থানাধীন ধোলাইপাড় এলাকা থেকে হারুন (৬০) ও মাসুদ (২১) নামে জাল নোট চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট উদ্ধার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হারুন ও মাসুদ জানায়, তারা মূলত আলাউদ্দিন নামে এক হোতার অধীনস্থ চক্রের সদস্য। তাদের কাজ হলো খুচরা বিক্রেতাদের কাছে জাল নোটগুলো পৌঁছে দেয়া। এজন্য তারা পারিশ্রমিক পেত প্রতি লাখে ১ হাজার টাকা।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, চারজন পরিকল্পনাকারী বর্তমানে রাজধানীতে জাল নোট প্রস্তুতকারী চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এদের অধীনে এখন সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে অন্তত ১৫টি চক্র। কয়েক ধাপে বিভক্ত এসব চক্রের সদস্যরা বাজারে জাল নোট প্রচলনের কাজ করে থাকে।
১৩ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা এলাকার সিটি ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে সাহারুল ইসলাম নামে আরেক জাল নোট সরবরাহকারীকে গ্রেফতার করে ডিবির পশ্চিম বিভাগ। এ সময় তার কাছ থেকে ২ লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়। এসব জাল নোটের সবই ছিল ৫০০ টাকা মূল্যমানের। পরে এ ঘটনায় শিল্পাঞ্চল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা রুজু করা হয়। গ্রেফতারকৃত সাহারুল লাখে ১ হাজার টাকা চুক্তিতে জাকির নামে এক হোতার অধীনে কাজ করে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর জাল নোট চক্রের মূল হোতার কাছে জাল টাকা তৈরির বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক মেশিন রয়েছে। প্রতি বছরই এরা ঈদের আগে ব্যাংকগুলোর নতুন নোট ছাড়ার অপেক্ষায় থাকে। বাজারে নতুন নোট আসার পর এরা এসব নোটের কিছু কপি সংগ্রহ করে। সংগ্রহ করা নোটের ভিত্তিতেই জাল নোট তৈরির কাজ শুরু করে মাস্টাররা। এসব নোট পাইকারি ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব চক্রের দ্বিতীয় স্তরের সদস্যদের। এক্ষেত্রে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি ১ লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি হয় ৫-৬ হাজার টাকার বিপরীতে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা
আবার এসব নোট দ্বিগুণ দামে, অর্থাত্ ১০-১২ হাজার টাকায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এসব নোট প্রতি লাখ ১৮ হাজার টাকা চুক্তিতে সংগ্রহ করে মাঠপর্যায়ের এজেন্টরা। জাল নোটের দাম নির্ধারিত হয় মূলত তা কতটা নিখুঁত— এর ভিত্তিতে। এর মধ্যে খুব ভালো মানের জাল নোটগুলো প্রতি লাখ বিক্রি হয় ১৮ হাজার টাকায়। এছাড়া নিম্নমানের নোট বিক্রি হয় প্রতি লাখ ১৬ হাজার টাকায়।
ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে অন্তত সাতটি নোট জালকারী যন্ত্র চালু রয়েছে। এগুলোয় নোট জালের মূল কাজটি করে চারজন কারিগর বা মাস্টার। এ চার মাস্টার হলো— হুমায়ুন, আলাউদ্দিন, আজিজ ও জাকির। এদের মধ্যে আলাউদ্দিন আশুলিয়া এলাকায় থাকে। আর জাকির থাকে ফার্মগেটে। বাকি দুজনের অবস্থান এখনো জানা যায়নি।
তবে এটুকু জানা গেছে, এসব মাস্টার নির্দিষ্ট এলাকায় থাকলেও এক বাসায় ১০ দিনের বেশি থাকে না। ফলে এদের গ্রেফতার করাটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। ঈদের আগেই অন্তত দুজন মাস্টারকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, বাজারে নতুন নোট আসার সঙ্গে সঙ্গেই জাল নোট প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীদের তত্পরতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দুটি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এ চক্রগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে হলে প্রস্তুতকারকদের গ্রেফতার করতে হবে। তাদের গ্রেফতার করতে পারলেই বাজার থেকে জাল নোটের ঝুঁকি দূর করা যাবে।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, নব্বইয়ের দশকে দেশে প্রথম জাল নোট প্রস্তুত শুরু করে মামুন নামে এক ব্যবসায়ী। সে মূলত টিস্যু পেপার ব্যবসায়ী ছিল। ওই ব্যবসায়ে লোকসান দেয়ার পর জাল নোট তৈরির ব্যবসা শুরু করে সে। তার সহকারী হিসেবে জাল নোট তৈরির পুরো প্রক্রিয়া রপ্ত করে নয়াবাজারের আব্দুর রহিম শেখ ও কামরাঙ্গীরচরের আব্দুল মালেক ওরফে মালেক মাস্টার। বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে ব্যবসা করার পর ২০০০ সালের শেষ দিকে মামুন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলে আব্দুর রহিম ও মালেক মাস্টার নিজেরাই জাল টাকা তৈরি শুরু করে।
এদের সহযোগী হিসেবে কাজ করত কামাল মাস্টার, হুমায়ুন মাস্টার, আলাউদ্দিন মাস্টার, আজিজ মাস্টার ও জাকির মাস্টার। এরা সবাই ২০১৪ সালে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে দেড় কোটি জাল টাকার নোট, জাল টাকা তৈরির মেশিন ও সরঞ্জামসহ গ্রেফতার হয়। পরে আইনি লড়াইয়ে জিতে মাত্র আট মাসের মাথায় কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসে তারা। এর মধ্যে কামাল মাস্টার ছাড়া আর সবাই ছদ্মবেশ ধারণ ও এলাকা পরিবর্তন করে পুরনো ব্যবসায়ে ফিরে গেছে।
Posted ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৮ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta