মোসলেহ উদ্দিন,উখিয়া(৭ সেপ্টেম্বর) :: মিয়ানমারে সহিংসতার পর ককসবাজারের উখিয়া পালংখালী নাফনদী সংলগ্ন ৩৬ কিলোমিটার সীমান্তে অসংখ্য পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গারা কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্প, অনিবন্ধিত বালুখালীও থাইখালী শরনার্থী ক্যাম্পসহ উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঝুপড়ি বেধে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এ পর্যন্ত আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
আর গত ২দিনে আরো ৩০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের বিস্তির্ন জঙ্গলকীর্ণ পাহাড়ি জনপদ এবং নাফনদী অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছে।
গত বুধবার সরেজমিনে আনজিমান পাড়াস্থ জামে মসজিদের উঠানে খোলা আকাশে নিচে পড়ে থাকা বাবার মরদেহের পাশে অঝোরধারায় কাঁদছে তার মেয়ে মোমেনা খাতুন। অপরদিকে হাউমাউ করে কাঁদছেছিল আরো চার পাঁচটি শিশু। তখন গুটি গুটি বৃষ্টি পড়ছিল।
মরদেহ গুলো বৃষ্টিতে ভিজছে। লাশগুলো কখন কোথায় দাফন করা হবে আগত রোহিঙ্গাদের আত্মীয় স্বজন কেউ জানেনা। এসময় এলাশ গুলো দাফনের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। মানবতার কি চরম বিপর্যয় এ দৃশ্য শুধূমাত্র মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের উপর।
সরেজমিনে গতকাল বিকাল ৪টায় উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের পালংখালী এলাকায় এ দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা মোমেনা খাতুন জানান, তার গ্রামের বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিদং এলাকায়। সহিংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে গত বুধবার দুপুর ১২টার দিকে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে তারা ঢুকে পড়েছিল জিরো পয়েন্ট নাফনদী এলাকায়।
এসময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী জিরো পয়েন্ট এলাকায় এসে তার বাবা ফজলু রহমান, একই বাড়ীর সৈয়দ আলম, শামসুল আলম, সুফিয়া খাতুন গুলি করে হত্যা করে। এবং পঞ্চাশোর্ধ এক ব্যাক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করে।
বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সরেজমিন কুতুপালং, বালুখালী, থাইনখালী, পালংখালীসহ নাফনদীর তীরবর্তীবর্তী এলাকায় জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শত সহস্র রোহিঙ্গা নারী পুরুষও শিশুর মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র দেখা যায়।
নাফনদী সংলগ্ন পালংখালী ইউনিয়নের পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু চিংড়ীঘেরবেড়িবাঁধ এলাকায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। এসময় সীমান্তের ওপারে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলতে দেখা যায়।
এদিকে ৭০ বছর বয়সী অসুস্থ্য মাকে কাঁধে নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসছিলেন বুচিদং এলাকার মোহামদ সালাম। তার কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের বর্ননা জানাগেল। সালাম জানান, ’জীবন বাঁচাতে গত ১২দিন ধরে মাকে কাঁধে নিয়ে কখনো পাহাড়ের ঝোপজঙ্গলে, কখনো ধানক্ষেতে লুকিয়ে চুরিচেপে নাফনদী পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। এখন কোথায় যাবে, কে তাকে আশ্রয় দেবে জানে না। সে জানায়, তার পরিবারের ৩ ছেলে ২ মেয়ে এবং ৪ ভাইকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে।
বুধবার বিকাল ৪টায় পালংখালীর আনজিমান পাড়ায় দেখা মেলে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের কুয়াঞ্চিবন পাড়া থেকে পালিয়ে আসা যুবক আবদুর রহিম। তিনি জানান, গত ১২ দিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে নাফনদী পার হয়ে এখানে এসেছি।
গত ২৯ আগস্ট তাদের বাড়িঘর ঘিরে ফেলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এসময় তারা কুয়াঞ্চিবন পাড়া থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের নিজেদের হেফাজতে নিয়ে মুসলিম নিরীহ নারী পুরুষকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ওইদিন সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা যায় পাড়ার ৩৫জন নারী পুরুষ ও শিশু। এসময় অন্তত ১১জন যুবককে একটি ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনাবাহিনীর লোকজন।
নাফনদীর সীমান্তে আনজিমান ও ধামনখালীর ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়ের আরো করুণ চিত্র দেখা গেছে। রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুরা এসব এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে। যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই অবস্থান, বসতি গাড়ছে এসব রোহিঙ্গারা।
Posted ৮:১৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta