শহীদুল্লাহ্ কায়সার(৪ জুলাই) :: কক্সবাজার শহরতলীর বড়ছড়ার ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর তো রয়েছেই। গবেষণা কেন্দ্রটি নিয়ে বড়ছড়ার লোকজনও এখন বিভক্ত দু’গ্রুপে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইন বোর্ড স্থাপন করে নির্বিচারে পাহাড় কেটে সীমানা সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি এই দ্বন্দ্বের। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ৫ একর জায়গা বরাদ্দ দেয়া হলেও বর্তমানে প্রায় শত একরের বনাঞ্চলে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড।
সবুজ অরণ্যে ঘেরা বড়ছড়ায় রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নামেই সাবাড় করা হচ্ছে এই বনাঞ্চল ও পাহাড়। এমনই অভিযোগ পরিবেশ অধিদপ্তরের। এই অভিযোগে চলতি বছরের ২৯ জুন পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মামলাও (যার নং ০৮/’১৭) করা হয়। চট্টগ্রামের পরিবেশ আদালতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই দায়ের করা হয় মামলাটি।
বড়ছড়া এলাকার লোকজন বিভক্ত হয়ে পড়েছেন দু’গ্রুপে । একদল মনে করছে এটি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ক্যাম্পাস। এখানে স্থানীয় ছেলে মেয়েদের ভর্তিতে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সড়ক হওয়ায় এলাকাটিতে এখন যানবাহন নিয়ে যাতায়াত করা যায়।
ইতোমধ্যে স্থানীয়দের মধ্য থেকে ইমাম হোছন, হিরু, ফারুক, ইমন, রবিউল, সৈকত, মমতাজসহ অন্তত ১০ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে তাদের চাকরি স্থায়ী করার আশ্বাস দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃৃপক্ষ। এ কারণে তারা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপর ক্ষুব্ধ। সরকারি এই দপ্তরের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমস্যা হচ্ছে মনে করে বেশ কিছুদিন ধরেই পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশও করছে তারা।
আরেকদল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে অখুশি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা দাবি করে দিনের পর দিন পাহাড়ের বিশাল অংশ দখল করায় তারা শংকিত। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা তাদের বসতঘর পর্যন্ত চলে এসেছে। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবির মুখে নিজেদের বসতঘর হারাতে হতে পারে। এই আশঙ্কা ভর করেছে তাদের মনে। এ কারণে তারা চাইছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে পাহাড়ের বিশাল ভূখন্ড দখলের লাগাম টেনে ধরা হোক। এটি হলে অন্তত তাদের বসতঘর রক্ষা পাবে।
১ জুলাই সরেজমিনে বড় ছড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, এলাকাটির পূর্ব অংশের কবরস্থান সংলগ্ন ফাঁকা মাঠটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কাঁটা তারে বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ইটের সড়ক। পাহাড়ের কিছু অংশ ছেটে সড়কটি নির্মাণ করা হয়। ঘিরে রাখা নির্দিষ্ট স্থানের প্রায় তিন একর জায়গা খালি রেখে দুই পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দু’টি টিন শেড ঘর। যার একটিকে অস্থায়ীভাবে কাঁকড়ার পরীক্ষামূলক গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অন্য্িটতে মোঃ রিদুয়ানুর রহমান ও হাসনাত জামি নামে দু’ছাত্র থাকেন। তাঁরা দু’জনই ভেটেরিনারি বিশ^বিদ্যালয়ের অ্যাকুয়া কালচার বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। বড় ছড়ার ঐতিহ্যবাহী বড়ছড়ার পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী বসতঘর কাম অফিসটি।
বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত ৫ একর জায়গার মধ্যে দখল বুঝে পাওয়া প্রায় ৩ একর জায়গা আগে থেকেই সমতল ভূমি। স্থানীয় ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মৃত্যু পরবর্তী জানাজার নামাজ পড়ার জন্য জায়গাটিকে সমতল করে ব্যবহার করতেন। অন্য দুই একরের কিছুটা বেশি জায়গায় পাহাড় থাকার কথা। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
শুধু উল্লিখিত অস্থায়ী গবেষণাগার সংলগ্ন এলাকায় পাহাড়ের চিহ্ন রয়েছে। বাকি জায়গাগুলোতে পাহাড় কেটে সমতল ভূমি করার কর্মযজ্ঞ চলছে। জনসাধারণ যাতে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে রাখা হয়েছে সেই ব্যবস্থাও। করা হয়েছে আট থেকে দশ ফুট প্রস্থের একটি বিকল্প সড়ক । যে সড়ক দিয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরাই চলাচল করতে পারেন।
চলাচলের এই সড়ক সংলগ্ন স্থানটি বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড়। কিন্তু ভেতরে প্রায় পুরোটাই সমতল ভূমি। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক দিয়ে বিশাল বনাঞ্চল ধ্বংস করেই এটিকে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। এই ভূমি সংলগ্ন বনাঞ্চলে যতদূর চোখ যায় কোন জনবসতির দেখা মেলে না। দেখা যায় শুধু ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড। প্রায় শত একর বনাঞ্চল জুড়ে স্থাপন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক সাইনবোর্ড। আর নির্বিচারে কাটা হয়েছে পাহাড়। পাহাড় কেটে একসময়ের বিশাল বনভূমিকে পরিণত করা হয়েছে বিশাল শূন্য প্রান্তরে। পাশাপাশি পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে ছড়া ভরাট করে পরিবর্তন করা হয়েছে ছড়ার পানির গতিপথ।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ইমাম হোসেন নামে এক যুবক শ্রমিক দিয়ে এসব পাহাড় কাটাচ্ছে। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক দিয়েই কাটানো হয় পাহাড়। এক অংশের পাহাড় কাটা সম্পন্ন হলেই অন্য অংশে লাগানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড। এরপর সেই অংশের পাহাড় কাটা হয়। এভাবে দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড লাগিয়ে বিশাল বনাঞ্চলকে পরিণত করা হচ্ছে ন্যাড়া পাহাড়ে। প্রশাসনের ভয়ে তাঁরা কিছু বলতে পারেন না।
উদাহরণ হিসেবে তারা মোল্লার পাহাড় নামক একটি জায়গার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ওই জায়গায় ৮/১০ হাত প্রস্থের একটি ছড়া ছিলো। যে ছড়াটির কারণে দু’ভাগে বিভক্ত ছিলো পাহাড়টি। কিন্তু এখন সেই ছড়াটি আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কেটে ফেলা পাহাড়ি মাটি ফেলে প্রায় ৪০/৫০ ফুট নীচের ছড়াটি ভরাট করা হয়েছে। ফলে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে হেঁটে যাওয়া যায়।
পাহাড় কাটার বিষয়টি অস্বীকার করে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. নুরুল আবছার খাঁন বলেন, “বিশ^বিদ্যালয়ের সব খরচের হিসাব দিতে হয়। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন পাহাড় কাটার জন্য বিশ^বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে কোন অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে কিনা ?”
তাহলে বিশাল অংশ জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো সাইনবোর্ড কিভাবে স্থাপন করা হলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাহাড় কেটে সুযোগ নেয়ার জন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলে আমাদের করার কিছুই নেই। আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। এ জন্য আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে সবকিছুর দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না। কেউ পাহাড় কাটলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর দায়িত্ব নেবেনা বলেও জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কক্সবাজার শহরতলীর বড়ছড়া এলাকায় ৫ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বরাদ্দকৃত জমির অনুকূলে প্রায় ২ কোটি টাকা রাজস্ব জমা দেয়ার পরই স্থানীয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জমির দখল বুঝিয়ে দেয়। বড়ছড়ার সেই জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ফ্যাকাল্টির গবেষণামূলক কাজ করা হবে। ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর উপর গবেষণা করা হবে এখানে। সেজন্য গড়ে তোলা হবে সাড়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে দু’টি হ্যাচারি এবং একটি মেরিন এ্যাকুরিয়াম।
ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ফ্যাকাল্টির মাস্টার্সের ছাত্র এবং একই অনুষদের পিএইচ.ডি গবেষকরাই যা ব্যবহার করতে পারবেন। এখানে স্থানীয়দের জন্য কোন ধরনের কোটা পদ্ধতির সুযোগ নেই। তবে স্থানীয়দের মধ্য থেকে কেউ মেধার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের যে কোন বিভাগে ভর্তি হলে পরবর্তীকালে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন এবং পিএইচ.ডি গবেষণার জন্য এখানে আসতে পারবেন।
শুধু দেশের নয়। বিদেশী ছাত্রছাত্রিরাও এখানে এসে গবেষণামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। ২০১৬ সালে এই বিষয়ে মালয়েশিয়ার তেরেঙ্গানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তূপক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। সেই স্মারকের আলোকে তেরেঙ্গানা বিশ্ববিদ্যালয় ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ জন শিক্ষার্থীরা মালয়েশিয়ায় আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে পড়ালেখা করার সুযোগ দিয়েছে।
গবেষণা অনুষদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ শেষ হলে তেরেঙ্গানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এখানে আসবেন। দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের বাসস্থানের সুবিধার জন্য গড়ে তোলা হবে বেশ কয়েকটি ভবন।
ইতোমধ্যে গবেষণা কেন্দ্রটির অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষে প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করেছে। মেরিন ড্রাইভ সড়কের দরিয়ানগর থেকে গবেষণা কেন্দ্রের সদর দরজা পর্যন্ত সড়কটির ২৫০ ফুট অংশে করা হবে সিসি ঢালাইয়ের কাজ। শিক্ষার্থীদের জন্য ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হবে ডরমিটরি ভবন। যার দরপত্র আহবান থেকে শুরু যাচাই-বাছাই এমনকি ঠিকাদার নিয়োগের কাজও শেষ হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে নির্মাণ কাজ।
অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারি পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম বলেন, “ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পাহাড় কেটে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার বিষয়ে আমাদের কাছে কোন আবেদন করা হয়নি। ফলে যেভাবে পাহাড় কাটা হয়েছে সেটি বেআইনি। সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও কারো অধিকার নেই পাহাড় কাটার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।”
বড়ছড়া সমাজ কমিটির সভাপতি আব্দুল খালেক বলেন, আমাদের সব অভিযোগ পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। চলাচলের সড়কের কাজ করার সময় ইতিপূর্বে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে গেছে কার্যালয়টি। এসব যন্ত্রপাতি এখনো ফেরত দেয়নি। ফেরত চাইলে উল্টো মামলা দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এলাকার উন্নয়নের জন্য ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এখন পাহাড় কাটার কথা বলে উল্টো স্থানীয় লোকজনকে হয়রাণি করা হচ্ছে।
বড়ছড়া সমাজ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইসমাইল বলেন, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে। সড়ক হওয়ার কারণে এলাকার লোকজন উপকৃত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে বলে শুনেছি। এলাকার একটি দুস্কৃতকারী চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
বড়ছড়া সমাজ কমিটির সহ-সভাপতি আসমত আলী সওদাগর বলেন, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় হলে এলাকার উন্নয়ন হবে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাকার ৮ জনের চাকরি হয়েছে। এখন পরিবেশ অধিদপ্তর সমস্যা সৃষ্টি করছে। কিন্তু কি কারণে সমস্যা করছে সেটি আমরা জানি না।
Posted ২:০৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৫ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta