কক্সবাংলা রিপোর্ট(৬ জানুয়ারী) :: কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র। প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপের সৈকতে হাজার হাজার মানুষের রাতদিন হাঁটাচলা, হইচই এবং আলোর কারণে হাজার মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা কচ্ছপ ডিম পাড়তে পারছে না। ডিম না পেড়ে ফিরে যাওয়ার সময় বহু মা-কচ্ছপ ক্লান্ত হয়ে মারা পড়ছে।
চলতি শীত মৌসুমে শনিবার সকালেই একটি মরা সামুদ্রিক কাছিম জোয়ারের পানিতে ভেসে এসেছে। বড় আকারের মরা কাছিমটি ভেসে দ্বীপের জেটি ঘাটের পার্শ্বে সৈকতের চরে আটকা পড়ে। সেই মরা কাছিমটি ভক্ষণের জন্য দ্বীপের কুকুরগুলো মরিয়া হয়ে উঠে।
দেশের ক্ষুদ্র ইউনিয়ন হিসাবে পরিচিত সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানান,ছয়টি লঞ্চ-জাহাজ ছাড়াও প্রতিদিন অর্ধশতাধিক কাঠের ট্রলার নিয়ে ১৫ হাজারের বেশি পর্যটক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ দ্বীপে আসা-যাওয়া করছেন। ৫৯০ হেক্টর আয়তনের ছোট্ট এ দ্বীপে বসবাসরত সাড়ে সাত হাজার মানুষের পাশাপাশি অতিরিক্ত ১৫ হাজার মানুষের বোঝা সামলাতে না পেরে দ্বীপটি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পর্যটকের ফেলা ময়লা-আবর্জনায় পুরো সেন্ট মার্টিন দ্বীপ যেন ডাস্টবিনে পরিণত হচ্ছে। এতে দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপের সৈকতে হাজার হাজার মানুষের রাতদিন হাঁটাচলা, হইচই এবং আলোর কারণে হাজার মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা কচ্ছপ ডিম পাড়তে পারছে না। ডিম না পেড়ে ফিরে যাওয়ার সময় বহু মা-কচ্ছপ ক্লান্ত হয়ে মারা পড়ছে। পর্যটকেরা ব্যাপক হারে এখান থেকে প্রবাল, শৈবাল ও ঝিনুক আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে দ্বীপে কাছিমের ডিম সংরক্ষণে নিয়োজিত ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইক্যু সিস্টেম অ্যান্ড লাইভলি হুড-ক্রেল এর স্থানীয় কর্মকর্তা খান মুহাম্মদ মুজাহিদ ইবনে হাবিব রাতে জানান- ’কাছিমের ডিম পাড়ার মৌসুমে শনিবার প্রথম একটি মরা কাছিম ভেসে আসার ঘটনা ঘটেছে। অথচ গেল বছর প্রচুর মরা কাছিম ভেসে এসেছিল চরে।’
তিনি বলেন, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত গভীর সাগরের কাছিম ডিম পাড়ার জন্য চরে উঠে আসে। এ সময় অনেক কাছিম মারা যায় নানা কারনে। দ্বীপের কুকুরগুলো তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় থাকে কাছিম ভক্ষণ করার জন্য। তবে এবার কাছিমের মৃত্যুর ঘটনা তেমন বেশি নয়। যাকে সুখবর হিসাবে দেখছেন তিনি।
তিনি আরো জানান, ২০১৪ থেকে গেল বছর পর্যন্ত দ্বীপে কাছিমের ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল ২ হাজার ৬৮১টি। এসব ডিমের মধ্যে ২ হাজার ৪০১টি ডিমের বাচ্চা ফুটানোর পর সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর চলতি মৌসুমের গত ২ মাসে ৩২০টি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব বলেন, সরকার ঘোষিত আইন অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা। এখানে ভূস্তরের পরিবর্তন, অবকাঠামো নির্মাণসহ কোনো ধরনের পরিবর্তন একেবারে নিষিদ্ধ। অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে এ নিষেধ কেউ মানছেন না। পর্যটকদের বর্জ্যে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে এখানকার প্রবালসহ জীববৈচিত্র্য। তিনি বলেন, পর্যটকের স্রোত কমাতে না পারলে সেন্ট মার্টিন অচিরেই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সাধারন সম্পাদক চঞ্চল দাশগুপ্ত জানান,উপকূলীয় ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে পরিবেশ অধিদফতর ১৯৯৫ সালে টেকনাফ সমুদ্র সৈকত ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুসারে (গেজেট ১৯৯৯) সঙ্কটাপন্ন ওই এলাকায় প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুক সংগ্রহ ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে মাছ, কচ্ছপ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো ধরনের কাজ; পাথুরে ও প্রবাল শিলা আহরণ, যে কোনো নির্মাণ কাজে পাথুরে ও প্রবাল শিলার ব্যবহার। এ আদেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যদিও এসব আইনের তোয়াক্কা করছে না কেউই। পরিবেশ অধিদফতরেরও আইন বাস্তবায়নে তেমন আন্তরিকতাও চোখে পড়ছে না কারও।
এ পরিবেশ কর্মী আরো জানান,সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের গর্ব। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দূরদর্শীতার অভাবে দ্বীপটি তার গৌরব হারাতে বসেছে। ইকো-টুরিজম বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব, তেমনিভাবে পর্যটনশিল্পেরও প্রসার ঘটানোও সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন দ্বীপের বাসিন্দা, পর্যটক ও নীতিনির্ধারকদের সচেতনতা। প্রকৃতির এই বিস্ময়কর দানকে আমাদের নিজেদেরই সংরক্ষণ করতে হবে এবং এখনই তার উপযুক্ত সময়।
Posted ১:১৬ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta