কক্সবাংলা রিপোর্ট(২৯ মে) :: ২৯ মে দুপুর পর্যন্তও পরিস্থিতি ছিলো ভিন্ন। জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ছিলেন পুরো ব্যস্ত। ঘূর্ণিঝড় মোরা’র সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি কমাতে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।শহর জুড়ে মাইকিং করে নেয়া হয় মানুষকে সজাগ করার উদ্যোগ। কিন্তু রাত আট টা পর্যন্ত সমুদ্র সংলগ্ন সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, নাজিরারটেক’র মানুষদের সজাগ করা যায়নি।
রাত ৯টার দিকে এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। আবহাওয়া অফিসের পক্ষ থেকে যখন ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে ১০ নম্বর মহা-বিপদ সংকেত জারি করা হয়। তখন এলাকা দু’টির মানুষ বুঝতে পারে ভয়ঙ্কর কোন ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে তাদের উপর। ফলে মালপত্র গুছিয়ে তারা শহরের সাইক্লোন শেল্টার এবং নিকটাত্মীয়দের বাসায় আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসতে থাকে।
মঙ্গলবার রাত ৯ টায় সমিতি পাড়া এবং কুতুবদিয়া পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, পাড়া দু’টির শিশু থেকে শুরু করে নারী পুরুষ পর্যন্ত সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে শহরের দিকে ছুটে আসছে। মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগীর মতো গবাদি পশুও সঙ্গে নিয়ে আসছে তারা।
বেশিরভাগ মানুষ আসছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া চেয়ার কোচে করে। আবার অনেকেই ব্যাটারি চালিত টমটমে নিজ খরচে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসছেন। আর খোঁজ খবর নিচ্ছেন স্বজনসহ প্রতিবেশীদের। অনেকেই সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করছেন।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলা সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, নাজিরারটেক’র প্রায় ২০ হাজার মানুষের আশ্রয় হয়েছে শহরের পাবলিক লাইব্রেরি, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবং পৌর প্রিপ্যারেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ে।সেখানেই গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন তারা। কক্সবাজার পৌরসভার পক্ষ থেকে আশ্রয়সন্ধানি এসব মানুষের জন্য সেহরির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পৌর প্রিপ্যারেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া কাজল নামে নাজিরারটেক এলাকার এক যুবক জানিয়েছেন, তাদের অনেক স্বজন এবং প্রতিবেশি ইতোমধ্যেই সাগর থেকে নাজিরার টেক এলাকায় পৌঁছেছে। অনেকেই বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে আসতে পারছে না। কিন্তু তাদের সঙ্গে মোবাইলে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় কমিশনার আকতার কামাল কক্সবাংলাকে জানান, সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, নাজিরারটেকে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের বসবাস। ঘূর্ণিঝড় মোরা’র সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির আশংকায় এলাকার ৭০ ভাগ লোক বিভিন্ন সরকারী ভবন,বোডিং এবং আত্বিয় স্বজনদের বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।তবে এখনো ১০ হাজারের মত মানুষ এলাকায় অবস্থান করছে।এছাড়া অর্ধশতাধিক মাছ ধরার ট্রলার এখনো কুলে ফিরে আসেনি।যারা ইতোমধ্যেই সমুদ্রে রয়েছে, তাদের ফিরে আসতে বলা হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সূত্রমতে, রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত জেলায় ১ লাখ ৩৫ হাজার মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।এর মধ্যে মহেশখালীতে ৫৫ হাজার,কুতুবদিয়ায় ৩০ হাজার,সদরে ২০ হাজার,উখিয়ায় ১০,পেকুয়ায় ১০ হাজার,কক্সবাজার পৌর এলাকায় প্রায় ২০ হাজার লোককে ৫৫৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কেন্দ্র আইসিসিডিআরবি’র পক্ষ থেকে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত মাইকিং করে লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলা হয়। ৩০ মে মাঝরাতে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আঘাত হানতে পারে এই বুলেটিন এবং ১০নং মহা-বিপদ সংকেত জারির কথাই মাইকিং এ বারবার বলতে শুনা গেছে। পাশাপাশি রেডক্রিসেন্ট’র কর্মীরা আশ্রয়সন্ধানি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সাহায্য করেছেন।
অবশ্য দুপুর পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। মঙ্গলবার দুপুরে শহরের সমুদ্র সংলগ্ন এলাকা সমিতি পাড়া এবং কুতুবদিয়া পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, পুরো এলাকাতেই স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। বিপদ সংকেত নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। পাড়া দু’টির অনেকেই জানে না ৭ নম্বর বিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। আবার অনেকে জানলেও বিষয়টি নিয়ে তাঁদের মাথা ব্যথা নেই। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা জানালেন, সন্ধ্যার পরই সিদ্ধান্ত নেবেন এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবেন। নাকি বসতবাড়ীতেই থাকবেন।
নাজিরার টেক সংলগ্ন নদীটি পানিতে পূর্ণ হয়ে গেছে। লোকজন ছোট্ট ডিঙি নৌকার সাহায্যে এপার থেকে ওপারে যাতায়াত করছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্ক বার্তা পৌঁছে দিতে যুব রেড ক্রিসেন্টের একটি দল গিয়েছিলো নাজিরার টেক এলাকায়। নৌকার সাহায্যে ডাঙায় আসতেই তাদের দলপতি মোঃ হোছাইনের সঙ্গে আলাপ হয়।
তিনি বললেন, আমরা যুব রেডক্রিসেন্টের ৪৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে ৩টি টিম গঠন করেছি। সাইরেন ও মাইক বাজিয়ে এবং বিপদ সংকেতের চিহ্ন স্বরূপ পতাকা দেখিয়েই মানুষকে সচেতন করার কাজ করছি। ইতোমধ্যে নতুন পাড়া, মধ্যম কুতুবদিয়া পাড়া এবং নাজিরার টেক এলাকার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু অন্যান্য বারের মতো এবার এই এলাকার মানুষের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে সন্ধানে যাওয়ার কোন অনুভূতি দেখিনি।
ওই সময় পাশে থাকা এলাকাটির একজন জানালেন, ‘জো’ (ভরাকাটাল)’র সময় সাগরের পানি ফুলে যায়। এ কারণে এলাকার লোকজন পানি থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতো। কিন্তু এখন ‘ডালা’ (মরাকাটাল) চলছে। ফলে এই এলাকার মানুষের মনে বিশ^াস জন্মেছে বড় কোন জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা নেই।
এ দিকে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র উপর সজাগ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। দেশটির টেলিভিশন, সংবাদপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম ইতোমধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র উপর প্রচার করছে বিশেষ বুলেটিন। ওইসব বুলেটিনে বলা হয়েছে, ৩০ মে এটি আঘাত হানতে পারে। গভীর রাত থেকে আঘাত হানার সম্ভাবনা বেশি।
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র কারণে ৩০ মে (আজ) বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ ভারতের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির অবস্থান পরিবর্তনের দিকে মোড় নিলে এটি ভারতের মিজোরাম, মেঘালয়, মণিপুর রাজ্যের পাশাপাশি মায়ানমারের উত্তর-পূর্ব অংশে আঘাত হানতে পারে। ওই সময় এটির ঘন্টয় গতিবেগ থাকবে ১২৫ কি.মি.।
Posted ১:২৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta