মোঃ রেজাউল করিম, ঈদগাঁও(৩ জুন) :: ৩০মে কক্সবাজার জেলার উপর দিয়ে বয়ে যায় ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’। এতে অর্ধ লক্ষাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এখনো তাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়নি। ফলে এসব পরিবারের লোকজন মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থ কক্সবাজার জেলার জন্য যে পরিমাণ চাউল ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে জানা গেছে।
সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে পূর্বে সতর্কিকরণ পূর্বাভাষ প্রচার ও নানা সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির ঘটনা আল্লাহর রহমতে অন্যবারের তুলনায় কম হয়েছে এবার। ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী সংসদ কর্তৃক কক্সবাজারে গত দুয়েকদিন যাবত বিভিন্ন উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল কাদেরের নেতৃত্বে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এম.পিসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ২ ও ৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে কক্সবাজার শহর, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও চকরিয়ায় ত্রাণ বিতরণ করেন।
কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড তথা সমিতি পাড়ায় ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের মধ্যে জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় সড়ক মন্ত্রীর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। পরে তিনি সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে শাহপরীর দ্বীপে ‘মোরা’ প্রভাবিত লোকজনের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।
অন্যান্য এলাকায় স্ব স্ব এলাকার সাংসদ, জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা ও দলীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে সরকারী সাহায্য সেবা পৌছে দেয়া হয়। তবে ‘মোরা’য় যে হারে লোকজন প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন বিতরণকৃত ত্রাণ তা চাহিদার তুলনায় অতি অল্প বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূক্তভোগী অনেকে।
দূর্যোগ পরবর্তী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপজেলা ও পৌরসভা হতে প্রাপ্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, জেলায় গাছ চাপা পড়ে ৪ জন নিহত হয়েছেন।
নিহতদের নাম ও ঠিকানা হচ্ছে সায়েরা খাতুন (৬৫), স্বামী- নুরুল আলম, সিকদার পাড়া, বড় ভেওলা, চকরিয়া, রহমত উল্লাহ (৪৫), পিতা- আবদুল জব্বার, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, শাহেনা আক্তার (১০), পিতা- শাহজাহান, গজালিয়া, ৯নং ওয়ার্ড, ইসলামাবাদ, কক্সবাজার সদর এবং আবদুল হাকিম (৬৫), পিতা- আজিজুর রহমান, ওজানটিয়া, পেকুয়া। প্রতিবেদনে কক্সবাজারের ৮ উপজেলা এবং ৪টি পৌরসভায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ বাড়ির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১৭ হাজার ২৩টি।
আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ বাড়ীর সংখ্যা হচ্ছে ৩৫ হাজার ৫১৬টি। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সংখ্যা হচ্ছে ৫২ হাজার ৫৩৯টি। নিহতের সংখ্যা ৪ আর আহতের সংখ্যা ৬০ জন। ঘুর্ণিঝড়ে কয়েক হাজার কাঁচা ঘর এবং গাছপালা বিনষ্ট হবার কথা উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া প্রায় ৩০ একর জমির ফসল ও ১৩৮২ একর পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৪৯৪ একর জমির।
উল্লেখিত ক্ষয়ক্ষতির বিপরীতে ২৯ মে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসনকে ২৮৪ মে. টনের অধিক বরাদ্ধকৃত চাল হতে তাৎক্ষনিকভাবে ১১০ মে. টন খয়রাতি চাল এবং ৯ লক্ষ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার চাহিদার আলোকে আরো চাল ও অর্থের বরাদ্ধ প্রদান প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয় সাধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আবদুর রহমান জানান, ঘুর্ণিঝড়ের দিন জেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত লোকজনের মধ্যে ৭শ প্যাকেট খাদ্য সামগ্রী, ৩ হাজার কেজি চিড়া, ২শ কেজি গুড় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়া উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছে।
তাছাড়াও ৫ হাজার প্যাকেট খাদ্য সামগ্রী চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সহায়তায় চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর মাধ্যমে সেন্টমার্টিনে পৌছানো হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এলাকার সচেতনরা মনে করছেন প্রশাসনিকভাবে ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’ এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির যে প্রতিবেদন সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় কার্যার্থে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সচিব, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর মহাপরিচালক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তার চাইতে অনেক বেশি। আর এ ক্ষতি বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ ত্রাণ পৌঁছানো ও বিতরণ করা হয়েছে তা খুবই অপ্রতুল ও নগণ্য।
এখনো ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার অনেক পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ বাড়ির মালিকরা সরকারী পুনর্বাসনের আওতায় আসেননি। নিহত ও আহতরা কোন ধরণের ক্ষতি পূরণ পাননি। বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে অনেক ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকাভূক্ত করা হয়নি।
হিসেব করলে ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। তাই তালিকার বাইরে অবস্থান করা ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার ও লোকজনকে সরকারী ত্রাণ ও সাহায্যের আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য ঐ মহলের।
এ ব্যাপারে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. লুৎফুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ কর হলে তিনি জানান, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নেতৃত্ব প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা প্রণয়ন, তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান ও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাড়তি বরাদ্ধ পাওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
সদর উপজেলার ৫নং জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ও কৃষক নুরুল আলম জানান, ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত তার ইউনিয়নে ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’ ভয়াবহ আকারে প্রভাব বিস্তার করে। বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রচন্ড আকারে। ‘মোরা’র প্রভাবে ইউনিয়নের অনেক টিনশেড বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। টিনের চালা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। প্রচুর গাছপালা ভেঙ্গে গেছে। ৫০/৬০ বছরের পুরনো গাছপালাও রক্ষা পায়নি। গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক মানুষ এখনো সরকারী ত্রাণ সহায়তা পায়নি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা নিরুপন করে তিনি ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্থদের কাছে ত্রাণ পৌছে দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে দাবী জানান।
Posted ১২:২৬ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৪ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta