কক্সবাংলা ডটকম(৯ ডিসেম্বর) :: মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত দেড় যুগ ধরে চলমান সরকারের অদম্য অগ্রযাত্রা বিশ্বস্বীকৃত। বর্তমান সরকারের সময়কালে সাফল্য পাওয়া খাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব সাফল্যে দেশের সর্বত্রই ফ্লাইওভার–এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে–সেতু–কালভার্টসহ নানামুখী ভৌতঅবকাঠামো উন্নয়ন আশাজাগানিয়া উদ্দীপনা তৈরি করেছে।
যোগাযোগের অন্যতম সহজ, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ মাধ্যম রেলপথ সম্প্রসারণ–আধুনিকায়নের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশকে রেলের আওতায় নিয়ে আনার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নেওয়া উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। অভূতপূর্ব রেলপথ সঞ্চারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক আগ্রহ দেশের আপামর জনসাধারণকে উৎসাহ–অনুপ্রেরণার মহাকাশে অত্যুজ্জ্বল করছে।
সরকার রেলপথ সম্প্রসারণ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কার, রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরকরণ, নতুন ও বন্ধ রেল স্টেশন চালু, নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু–বৃদ্ধি, লেভেলক্রসিং গেইটসমূহের সংস্কার–আধুনিকীকরণ, কম্পিউটার বেইজড সিগনালিং ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং ট্রেনের নতুন কোচ সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। নতুন নতুন জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় এনে অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ আন্তর্জাতিক রেল যোগাযোগ বিশেষ করে ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক, সার্ক রেল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা অতিশয় দৃশ্যমান।
অতিসম্প্রতি ঢাকা–কক্সবাজার রেলপথে ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ এর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের যোগাযোগ উন্নয়নসহ পর্যটন শিল্পে যুগান্তকারী মাইলফলক রচিত হয়েছে। কালের সাক্ষী হয়েছেন ১ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন থেকে আসা কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটির ১ হাজার ২০ জন যাত্রী। পরদিন সকাল বেলায় ট্রেনটি কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে পৌঁছলে ফুল দিয়ে বরণ করা হয় যাত্রীদের। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৪৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই যাত্রাপথে নিরাপদ ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন পর্যটকরা।
রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সকল টিকেট অনলাইনে অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আগামী ১০ দিনের টিকেট অগ্রিম কাটা হয়েছে। সংকট নিরসনে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সেবার মান বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রতিবছর কক্সবাজারে আসা প্রায় ৬০ লাখ পর্যটক বেশির ভাগ সময় বাসে এবং বিমানে যাতায়াত করলেও; এখন বেশির ভাগ পর্যটক ট্রেনে ভ্রমণ পছন্দ করছেন।
১১ নভেম্বর ২০২৩ চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের ৪৮তম জেলা হিসেবে পর্যটন নগরী কক্সবাজার রেল যোগাযোগে সংযুক্ত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে কক্সবাজারে পর্যটকের উপস্থিতি বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বল্প সময়–খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহন সহজতর হবে এবং পর্যটন শিল্পসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
এটি মিয়ানমার–চীনসহ এতদ অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক ব্যবসা–বাণিজ্যে বিস্তৃত করবে। তৈরি হবে নতুন নতুন বিনিয়োগ–কর্মসংস্থানের। চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে নয়নাভিরাম সবুজ বনাঞ্চল অতিক্রম করে পৌঁছেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে। এই রেলপথের যাত্রীরা চুনতি–ফাঁসিয়াখালি বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় পার্কের প্রায় ২৭ কিলোমিটার সংরক্ষিত বনভূমির অপরূপ বৃক্ষরাজির দৃশ্য অবলোকনসহ বন্য হাতির পালের সৌন্দর্য উপভোগ করে কক্সবাজারে ভ্রমণ করতে পারবেন।
যাত্রাপথে প্রাণ–প্রকৃতি ও পরিবেশের অপূর্ব মেলবন্ধ যাত্রীদের মুগ্ধ করবে। বৈচিত্র্যময় এই রেলপথ পর্যটনের নতুন দ্বার উম্মোচন করেছে। কক্সবাজারের সঙ্গে রেল সংযোগের ফলে পর্যটন শিল্পে ইতিবাচক পরিবর্তনের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এই রেল সংযোগ নির্মিত হওয়ার সুবাদে দেশের যেকোনো প্রাপ্ত থেকে সবসময় পর্যটকরা ইচ্ছা করলে সরাসরি কক্সবাজারে এসে কোনো ধরনের হোটেল ব্যবহার না করেও সমুদ্রসৈকতের আনন্দ উপভোগ করে পুনরায় ফিরে যেতে পারবেন। এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় পর্যটকস দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অপরিমেয় আগ্রহ–উৎসাহ–উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয়েছে।
উল্লেখ্য রেলপথ চালু হওয়ায় কক্সবাজারের আমাপর জনসাধারণসহ বিভিন্ন পেশাজীবী, সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ গভীর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তারা এটিকে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন এবং শত বছর ধরে স্বপ্নে লালিত রেলপথ বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
কক্সবাজারবাসীর মতে, বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রসৈকতের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগে প্রতি বছর অগণিত দেশি–বিদেশি পর্যটক কক্সবাজারে ছুটে আসেন। পর্যটকদের জন্য সরকারি–বেসরকারি খাতে আধুনিক সুযোগ সুবিধার সমাহারে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন–বিলাসবহুল বিপুল সংযখক হোটেল–মোটেল। দীর্ঘকাল ধরে কক্সবাজরের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সড়ক ও আকাশপথে যোগাযোগ থাকলেও; ছিল না রেল সংযোগ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তাচেতনার অনুপম ফসল হিসেবে কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
কক্সবাজার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি গণমাধ্যমে বলেন, ‘স্বপ্নের রেল এখন পর্যটন শহর কক্সবাজারে। এই রেল পথ বাংলাদেশের উন্নয়নে যুগান্তকারী ঘটনা। বৃটিশ, পাকিস্তানের সুদীর্ঘ সময় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশত বছরে যা হয়নি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা করে দেখালেন। এই রেল পথ কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিপূর্ণতা দেবে। সহায়ক হবে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে। শুধু শীতকাল নয়, বর্ষাসহ সারা মৌসুমে পর্যটকরা কক্সবাজার ভ্রমণে উৎসাহিত হবে।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজার–ঘুনধুম রেলপথ সম্পন্ন হলেই ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাবে। তাছাড়া কক্সবাজর–ঘুনধুম পর্যন্ত মহাসড়ক সম্প্রসারণ করে এর আরও বিস্তৃতি ঘটবে যা মিয়ানমার হয়ে চীনের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং সিটির সঙ্গে আন্তঃদেশীয় মহাসড়কে সংযুক্ত করবে বাংলাদেশকে। ফলশ্রুতিতে পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে পূর্বে চীন অবধি ঐতিহাসিক সেই ‘সিল্ক রুট’ হবে পুনরুজ্জীবিত। জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ, দক্ষিণ–পূর্ব ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যকার পূর্বমুখী (লুক ইস্ট) অর্থনৈতিক দুয়ার হবে উন্মুক্ত। বিনিয়োগ–শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক বন্ধন সহজতর হয়ে উঠবে। কৃষি–খামার ও শিল্প–কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাত এবং রপ্তানি সুবিধার প্রসার ঘটবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনসাধরণের কর্মচাঞ্চল্য ও স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে।
দৃষ্টিনন্দন এই রেলপথকে অধিকতর সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে চট্টগ্রামে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে অত্যন্ত চমৎকার নয়টি স্টেশন। তন্মধ্যে কক্সবাজারের ঝিনুক আকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যশোভিত আইকনিক স্টেশনটি দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম আকর্ষনীয় স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। স্টেশনটি দেখার জন্য প্রতিদিন পর্যটকসহ হাজার হাজার লোকের সমাগম আনন্দময় এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি করে।
কক্সবাজার শহরের পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয় তলা বিশিষ্ট এই স্টেশনটি। ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের স্টেশনটিতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা।
একদিনের জন্য আসা পর্যটকদের নিরাপদে মালপত্র রাখার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে লাগেজ লকার সিস্টেম এবং তারকা মানের আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন ও গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। এছাড়াও আছে মসজিদ, শপিং মল, শিশুযত্ন কেন্দ্র, চলন্ত সিঁড়ি, পোস্ট অফিস, কনভেনশন সেন্টার, এটিএম ও ট্যুরিস্ট ইনফেরমেশন বুথসহ অত্যাধুনিক নানা সুবিধা।
ক্লান্তিকর সড়কপথের যাত্রার বিকল্প হিসেবে নিয়মিত যাতায়াতকারী এবং দূর–দূরান্তের পর্যটকদের নিকট ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে কক্সবাজার এক্সপ্রেসের বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। কক্সবাজারকে ঘিরে দেশের পর্যটন খাতে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনায় ভবিষ্যতে ট্যুরিস্ট ট্রেনেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন পর্যটন শহরের আদলে এ বিশেষ ট্রেনে যাত্রাপথে থাকবে নানামাত্রিক সুবিধা। নতুন এই প্রকল্পে প্রতিদিন সকাল–বিকালে ঢাকা থেকে এবং সকাল–রাতে কক্সবাজার থেকে দুটি করে ট্রেন চলাচল করবে। ৫৪টি কোচের মধ্যে ২০ শতাংশ কোচ অতিরিক্ত হিসেবে যাত্রাপথের উভয় প্রান্তে মজুদ রাখা হবে।
প্রকল্পের অধীনে থাকবে ছয়টি মিটার গেজ ট্যুরিস্ট কোচ, ২২টি শতিতাপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কার, সাতটি পাওয়ার কার এবং শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কার ও গার্ড ব্রেক। প্রত্যাশিত যে, উন্নত বিশ্বের যেকোন আধুনিক রেল সংযোগ–স্টেশনের প্রয়োজনীয় নান্দনিক সকল সুবিধাদি শোভিত কক্সবাজার এক্সপ্রেস বাংলাদেশ শুধু নয়; অচিরেই দক্ষিণ এশিয়ায় যোগাযোগ উন্নয়নের অধ্যায়কে অধিকতর উচুমাত্রিকতায় পৌঁছিয়ে দেবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Posted ১:০১ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta