বিশেষ প্রতিবেদক(২৯ জুন) :: বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এখন লাখো পর্যটকের ঢল নেমেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী ও লাবণী পয়েন্টে পর্যটকের ভিড়ে ঠাসাঠাসি অবস্থা। তিল ধারণেরও যেন জায়গা নেই। বেশির ভাগ পর্যটকই সমুদ্রের পানিতে দাপাদাপিতে ব্যস্ত। কেউ কোমরসমান পানিতে, কেউ আরও দূরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। অথচ সৈকতের বালুচরে তখন উড়ছে লাল পতাকা। এর অর্থ‘এখন সমুদ্রে নামা বিপজ্জনক’। কিন্তু কেউই মানছেন না এই সতর্কবার্তা। ঝুঁকি নিয়েই গোসলে নামছেন।
আর পর্যটন মৌসুমের বিশেষ কয়েকটি দিনে গোসল করতে নেমে সমুদ্রের চোরাবালিতে আটকে পড়া, গুপ্ত খাদে পড়া ও ঢেউয়ে তোড়ে ভেসে যায় সাতাঁর না জানা পর্যটকরা। মেধাবী ছাত্রদের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটলেও এনিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই স্থানীয় প্রশাসনের ।আর গত দেড় দশকে সমুদ্র সৈকতে স্রোতে ভেসে গিয়ে শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে। নিখোঁজ হয়েছে অনেকে।
অন্যদিকে ট্যুরিস্ট পুলিশ আর লাইফগার্ডের সদস্যরা পর্যটন মৌসুমের এই বিশেষ দিনগুলোতে সৈকতে সর্বদা মাইকিং,বিপদজ্জনক পয়েন্টে পুলিশের নজরদারি,সৈকতের টিভিস্কিন ও বিলবোর্ডগুলোতে সতর্কতামূলক প্রচারণা সহ কোন গঠনমূলক তৎপরতা নেই বললেই চলে।এই দৃশ্য প্রায়ই সৈকতে দেখা যায়। আর এসব কারণেই সৈকতে মৃত্যূ এবং নিখোঁজের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, গত ২০০০ সাল থেকে চলতি ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত গত ১৫ বছরে শুধু সমুদ্রে গোসল করতে নেমে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে মারা গেছেন প্রতিভাবান ছাত্র, ক্লোজআপ তারকা, প্রবাসী, বিদেশী পর্যটক সহ ১৪৩ জন পর্যটক। মুস্তাফিজুর রহমান সুজন, ইয়াছির, আরাফাত ইসলাম রিংটো, নাজিম উদ্দিন তোশার, মোঃ শাকিল, মঈনুল হোসেন , দীপুদাশ , মিজানুর রহমান,বাদশা মিয়া , ক্লোজআপ তারকা আবিদ, আশিক, রিংকু সহ আরো অনেক পর্যটক রয়েছে।
এভাবে সাগরতটের নোনা জলে গা ভাসাতে গিয়ে স্রোতের টানে অনেকে নিখোঁজ কিংবা মৃত্যুরকুলে পতিত হচ্ছেন। বৈরী আবহাওয়া এবং সমুদ্র সৈকতে জোয়ার-ভাটার হিসাব না মেনে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে গোসল করতে নেমে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গিয়ে মৃতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ভেসে যাওয়া পর্যটকদের উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত সি-সেইফ লাইফগার্ডের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সৈকতের সুগন্ধা, কলাতলী ও লাবণী পয়েন্টের তিন কিলোমিটার অংশে গোসলে নেমে কোনো পর্যটক ভেসে গেলে উদ্ধারের জন্য সেখানে লাইফগার্ড সদস্যরা আছেন। অন্য কোনো সৈকতে তা নেই। অরক্ষিত সৈকতে নেমে অনেকে বিপদে পড়ছেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন,বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অন্তত এক লাখ পর্যটক সমুদ্রে গোসলে নেমেছেন। আগের দিন মঙ্গলবার এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি। এই বিপুলসংখ্যক পর্যটক সামাল দিতে তাঁর ৩০ জন লাইফগার্ড কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবককে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার সকালে সৈকতের সিগাল পয়েন্টে গোসলে নেমে নিখোঁজ হন ঢাকার একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সুদীপ্ত দে।বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর সন্ধান মেলেনি। গত তিন দিনে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অন্তত ৩৪ জন পর্যটককে উদ্ধার করেছেন বলে জানান লাইফগার্ড কর্মীরা।
সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও বালুচরে লাল পতাকা উড়ছে। লাইফগার্ড কর্মীরা ভাটার সময় পর্যটকদের সৈকতে না নামার জন্য বাঁশি বাজাচ্ছেন। কিন্তু পর্যটকেরা তা আমলে নিচ্ছেন না।
কলাতলী পয়েন্টে কথা হয় ঢাকার কমলাপুর থেকে আসা ব্যবসায়ী কামাল আহমদের (৪২) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এত দূর থেকে এসেছি সমুদ্রে গোসল করার জন্য। এখন বাধা-নিষেধ মানতে ইচ্ছে করছে না। তা ছাড়া আমাদের সাঁতার জানা আছে। আশা করি সমস্যা হবে না।’
সিলেটের হরিপুর থেকে আসা পর্যটক মুহিতুল আলম (৩৫) বলেন, ‘কোমরসমান পানিতে শরীরটা ভিজিয়ে উঠে যাব। বেশি দূরে যাব না। তাই নিষেধ মানছি না।’
কলাতলী পয়েন্টে পর্যটকদের নজরদারি করছেন সি-সেইফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার ও সার্ফার সাইফুল্লাহ সিফাত। তাঁর সঙ্গে আছেন আরও ছয়জন কর্মী। সাইফুল্লাহ সিফাত বলেন, লাল পতাকা থাকলে সমুদ্রে নামা যাবে না। ওই সময় থাকে ভাটা। সমুদ্রে নামা যাবে সবুজ পতাকা উড়লে। তখন জোয়ার থাকে।
বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এখন লাখো পর্যটকের ঢল নেমেছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিশাল সৈকত ভরপুর থাকছে পর্যটকের পদভারে। হোটেল মালিকেরা জানান, ঈদের দ্বিতীয় দিন (২৭ জুন) সৈকতের লাবণী পয়েন্টের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় জড়ো হয়েছিলেন অন্তত এক লাখ পর্যটক।
গতকাল এ সংখ্যা ৪০-৫০ হাজার বেড়ে দেড় লাখে পৌঁছেছে। আগামী ২ জুলাই পর্যন্ত পর্যটকের এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টের হোটেল কল্লোল-এর মহাব্যবস্থাপক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন শহরের চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও কটেজের অধিকাংশ কক্ষ খালি নেই। সামনে বৃহস্পতি ও শুক্রবার হওয়ায় পর্যটকের চাপ আরও বাড়তে পারে।
পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রায়হান কাজেমী বলেন, কয়েক লাখ পর্যটককে নিরাপত্তা দিতে ১২১ জন টুরিস্ট পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত একজন পর্যটক নিখোঁজ ছাড়া সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলছে।
এব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সী-নেটিং হলে সমুদ্র সৈকতে প্রাণহানির ঘটনা হ্রাস পাবে। সেই সাথে সৈকতে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঝুঁকি কমবে। পর্যটকদের আনন্দের ভ্রমণ বিষাদের হবে না।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, পর্যটক হয়রানি রোধে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে রয়েছেন। অতিরিক্ত কক্ষভাড়া ও খাবারের অতিরিক্ত দাম আদায়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Posted ৪:১৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta