কক্সবাংলা রিপোর্ট(২৮ আগস্ট) :: মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের তান্ডব অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি ক্রমশই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা এরই মধ্যে কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকায় ঢুকে পড়েছে।জিরো পয়েন্টে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে আরো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা।
উখিয়ার রহমতের বিল, ধামনখালী, পালংখালী, ঘুমধুম, তুমযুং, জলপাইতলী, উত্তর পাড়া, কলাবাগান, রেজু আমতলী পয়েন্ট দিয়ে গত ৩দিনে বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গা।
স্বামীকে মিয়ানমারে রেখে এসে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মংডু জেলার মাছছিল্লা পাড়ার আজিজুল হকের স্ত্রী তসলিম ফাতেমা জানান, রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে এদেশে চলে আসছে। সেনাবাহিনীর নির্যাতন নিপীড়ন ও ধর্ষনের ভয়ে ইজ্জত বাঁচাতে বেশিরভাগ নারীরা এপারে চলে আসছে।
সহায় সম্পত্তি ফেলে আসা এ রোহিঙ্গা নারী জানান, বর্তমানে যেভাবে মগ সেনারা জুলুম অত্যাচার নির্যাতন, বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে আরকান রাজ্যে মুসলিম শূন্য হয়ে পড়বে। আমিও তাই ইজ্জত বাঁচাতে এদেশে চলে এসেছি।সোমবার সকালে ঐ রোহিঙ্গা নারীর সাথে কথা হলে এসব তথ্য আবেগ আফ্লুত হয়ে জানান।
এদিকে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঢেকিবনিয়া ও তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার বিজিপি সদস্যরা সোমবার থেমে থেমে প্রচন্ড গুলি বর্ষন করছে।ওখান থেকে ২টি গুলির খোসা তুমব্রু বাজার ও তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেওয়ালে পড়েছে। সোমবার দুপুরে এ ঘটনাটি ঘটে।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ ঘটনার সত্যতা জানান,২টি গুলির খোসা তুমব্রু বাজার ও তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেওয়ালে পড়ে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি।এ ঘটনায় স্থানীয়দের সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া তিনি এ ব্যাপরটি পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের অবহিত করেছেন। নিনি আরও জানান,মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নারী-শিশু সীমান্তে জড়ো হয়েছে । এবারে শতকরা ৯০ জন নারী শিশু এবং তারা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছে।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যান্তরে গুলির শব্দ শুনেছি। স্থানীয় শাহনেওয়াজ চৌধুরী দুপুর ১ টায় ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমার বিজিপির প্রচন্ড গুলির শব্দ শুনে এলাকাবাসীর মত আমিও আতংকিত হয়ে পড়ি।
উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের জানিয়েছেন রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে থাইংখালী এলাকা থেকে ৭৫ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর কক্সবাজার ৩৪ বিজিবিকে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে ৩৪ বিজিবির সোমবার কোন এক সময়ে তাদের ফেরত পাঠানোর কথা রয়েছে।
টেকনাফ ২নং বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান,নাফ নদীর জলসীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় ১৪৫ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। সোমবার সকালে নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। ফেরত পাঠানো এসব রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশির ভাগ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।
এদিকে মিয়ানমারের মংডু এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় গুলিবিদ্ধ পাঁচজন সহ সাতজনকে কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার ডিজিটাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এর মধ্যে মংডুর নাইছিদং গরিপাড়ার আবুল কাশেমের ছেলে সাইফুল আমিন (২৮),মগনামার আবুল হোসেনের ছেলে নুরুল আমিন (৩০), বুচিদংয়ের মো. হাশিম (২২),ওসমান গণি (৩৩), জোবায়ের (৩২) ও হাকিম উল্লাহ গুলিবিদ্ধ। শামসুল আলমের ছেলে হামিদুল হক (১১), সাবেকুর নাহার (৯) আহত।
এমএসএফের (হল্যান্ড) রোগী দেখাশুনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা টিটু জানান, গুলিবিদ্ধ আহত পাঁচজন রোহিঙ্গাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ডিজিটাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কক্সবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রণজিত বড়ুয়া জানান, এমএসএফের মাধ্যমে ডিজিটাল হাসপাতালে সাতজন রোহিঙ্গাকে ভর্তি করা হয়েছে। এরা সবাই আহত।
এছাড়া গুলিবিদ্ধ ও আগুনে পোড়া আরও ৯ রোহিঙ্গাকে উখিয়ার কুতুপালং থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রবিবার (২৭ আগস্ট) গভীর রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত তাদেরকে চমেক হাসপাতালে আনা হয় বলে জানিয়েছেন কুতুপালং এর এক এনজিও কর্মকর্তা।
চমেক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯ রোহিঙ্গারা হলেন, মংডুর হাসুরমা গ্রামের বাসিন্দা মামুনুর রশিদ (২৭), একই এলাকার নুরুল হাকিম (২৬), শীলখালী গ্রামের মো. শাকের (২৭), ধুমাখালী গ্রামের মো. সাদেক (২০), একই গ্রামের জাহেদ হোসেন (২০), নাইয়্যাদং গ্রামের নুরুল সালাম (১৫), আওয়ারবিল গ্রামের পারভেজ (২০), আবুল কাশেম (২৭) ও নুরুল আমিন (২২)। এদের মধ্যে পারভেজ ও কাশেম আগুনে পুড়ে আহত হন। তাদেরকে চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।এই ৯ জনসহ গত তিন দিনে মোট ১৭ জন রোহিঙ্গা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে মুছা নামে একজনের মৃত্যূ হয়েছে।
জানা যায,বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক রয়েছে প্রায় ২০৮ কি. মি। এরমধ্যে টেকনাফে ৫২ কি. মি, উখিয়ায় ১৬ কি. মি, এবং বাকি সীমান্ত বান্দরবন জেলায়। আর বাংলাদেশে বসবাস করছে অন্তত ১০লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে উখিয়া হয়ে বান্দরবানের নেত্রাংছড়ি পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি পয়েন্ট রয়েছে। যেখানে সীমান্ত থেকে লোকালয়ের দূরত্ব মাত্র কয়েক’শ গজ।আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলেই রোহিঙ্গারা সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন রোহিঙ্গ সমস্যা সমাধানে সব চেয়ে জরুরি মিয়ানমার সরকারের স্বদিচ্ছা। আর এই স্বদিচ্ছার অভাবেই এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়নি।
Posted ৪:২০ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৮ আগস্ট ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta