মঙ্গলবার ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

মঙ্গলবার ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

কমিউনিজমের প্রতিক সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ভেঙে গিয়েছিল?

বুধবার, ১৭ মার্চ ২০২১
2364 ভিউ
কমিউনিজমের প্রতিক সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ভেঙে গিয়েছিল?

কক্সবাংলা ডটকম(১৬ মার্চ) :: ৩৭ দিনের লম্বা কর্মসপ্তাহ, ৩০ দিন টানা কাজ করবেন, একদিনও ছুটি নেই, এরপর ৭ দিন আরামসে কাটাবেন। এভাবে কাজ করতে রাজি হবেন কি? আপনি রাজি থাকুন আর না থাকুন, কর্মজীবী মানুষ হিসেবে নিজেকে ঠিক ৯০ বছর পূর্বে কল্পনা করুন, ভ্লাদিমির লেনিনের দেশে আপনাকে এভাবেই হয়তো কাজ করতে হতো।

কথা হচ্ছিলো ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস, সংক্ষেপে ইউএসএসআর, যা আমাদের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে সর্বাধিক পরিচিত, সেই দেশটি নিয়ে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বিপ্লবের পর রাশিয়ান সম্রাট বা জারের পতনের পর রাশিয়া ও আশেপাশের একই আদর্শের কয়েকটি রিপাবলিক নিয়ে গড়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯১৭ এর পরের কয়েকটি বছর গৃহযুদ্ধ ও পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ও সংলগ্ন এলাকা বেশ অস্থিতিশীল ছিল।

রাশিয়ার অভ্যন্তরে মূল সংঘাতটা চলছিল কমিউনিস্ট সমর্থক (যারা রেড নামে পরিচিতি পান) এবং জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের মাঝে (যারা হোয়াইট নামে পরিচিতি পান)। হোয়াইটদের একটি অংশ ছিল সাবেক রাজতন্ত্রের সমর্থক। শেষ অবধি রেডরা ক্ষমতা সুসংহত করতে সক্ষম হয়। ইতিহাসে এরা বলশেভিক নামেও পরিচিত। বলশেভিকরা বিভিন্ন রিপাবলিকে ক্ষমতা দখল করে ঘোষণা করে জমি, কলকারখানা ও অন্যান্য সম্পদ একটা যৌথ সমবায় ব্যবস্থার অধীনে নিয়ন্ত্রিত হবে, যা দিয়ে অভিজাততন্ত্রের স্বার্থের বদলে কৃষক ও শ্রমিক সহ সকলের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাজতন্ত্র সমর্থকদের চূড়ান্ত পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রিপাবলিকরা যুক্ত হতে শুরু করলে সোভিয়েত ইউনিয়নের আকার বড় হতে শুরু করে।

আয়তন

সোভিয়েত ইউনিয়নে মূলত রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ এবং ট্রান্স ককেশিয়ান দেশগুলো যুক্ত ছিল, যার সাথে ১৯২৪ সালে তুর্কমান ও উজবেক যোগ দেয়। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে তাজিক সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক এবং ১৯৩২ সালে কিরিগ ও কাজাখ সোভিয়েত সোশ্যালিস্টরা ইউনিয়নে যোগ দেয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ম্যাপ; Image Source: Getty Image

ট্রান্স ককেশিয়ান অংশটিকে আর্মেনিয়ান, জর্জিয়ান ও আজারবাইজান এসএসআরে বিভক্ত করা হয়। ১৯৪০ সাল নাগাদ লাটভিয়ান, লিথুনিয়ান, এস্তোনিয়ান, মালদোভাসহ বাল্টিক সাগর পাড়ের আরও কিছু অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নে যুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে এ রিপাবলিকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আয়তন ছিল ২,২৪,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার, যা সে সময়ের সর্ববৃহৎ দেশ। এই বিশাল রাষ্ট্রের মধ্যে ১১টি বিভিন্ন টাইম জোন ছিল। পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু হওয়া ইউনিয়নটি মধ্য এশিয়া হয়ে উত্তর এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার রাজধানী ছিল রাশিয়ার মস্কোতে।

শাসন ব্যবস্থা

মস্কোতে অবস্থিত সুপ্রিম কাউন্সিল অফ দ্য ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের নিকট সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল। এই কাউন্সিল দুই চেম্বারে বিভক্ত, যার ভেতর একটি ছিল ৭৫০ সদস্যের সোভিয়েত অফ দ্য ইউনিয়ন এবং অপরটি ছিল ৭৫০ সদস্যের ইউনিয়ন অফ ন্যাশনালিটিজ। উভয় কক্ষেই নিয়মিত নির্বাচন হতো। তবে নির্বাচনে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই নির্ধারণ করতো কারা কোন কক্ষের সদস্য হবেন।

কাউন্সিল অফ পিপলস ডেপুটিজ, ১৯৯১; Image Source: Getty Image

সোভিয়েত সংবিধান অনুসারে, স্থানীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে শাসন পরিচালনার জন্য একটি স্তর ছিল যাদের বলা হতো কাউন্সিল অফ পিপলস ডেপুটিজ। এ কাউন্সিলগুলো সুপ্রিম কাউন্সিল কর্তৃক নির্ধারিত সিদ্ধান্তসমূহ স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতো। সুপ্রিম কাউন্সিল দেশের মূলনীতি ও বৈদেশিক সর্ম্পকসহ সকল বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতো। রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা ছিল সুপ্রিম কাউন্সিল চেয়াম্যানের হাতে। স্ট্যালিন থেকে শুরু করে গর্বাচেভ পর্যন্ত সকল সোভিয়েত শাসকই এ চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করেছেন।

নাগরিক সুবিধা

সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত হতো কাল মার্কসের দর্শনানুসারে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত সবাই বিনামূল্যে শিক্ষা পেতো। পানি, গ্যাস, সেন্ট্রাল হিটিংসহ নাগরিক বিভিন্ন সুবিধায় রাষ্ট্র প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি প্রদান করায় নাগরিকদের এ খাতে তেমন কোনো খরচ করতে হতো না।

পেশা ও চাকুরির শর্তানুসারে, বেতন নির্ধারিত হতো। ছাত্রদেরকেও রাষ্ট্র বেতন প্রদান করতো। ‍সকল চাকুরিজীবীকে ডরমেটরিতে আবাসন প্রদান করা হতো। পরবর্তীতে সকলকেই নিজস্ব বাসা প্রদান করা হতো। খুব অল্প কিছু বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন লোককে জীবনের শুরুতেই বড় অ্যাপার্টমেন্ট প্রদান করা হতো। মূলত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ছিল সোভিয়েত সমাজের বৃহত্তর অংশ। অত্যন্ত ক্ষমতাবান গুটিকয়েক পার্টি সদস্যকে রাষ্ট্রের তরফ থেকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হতো।

সোভিয়েত ইউনিয়ন আর বর্তমান জীবনযাপন মান নিয়ে করা একটি জরিপ; Image Source: Sputnik International

অর্থনীতি

সোভিয়েত অর্থনীতি ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। ভূমি ও বাড়ির ব্যক্তিগত মালিকানা সোভিয়েত ইউনিয়নে নিষিদ্ধ ছিল। যদিও বলা হতো, সকল সম্পদের মালিক সোভিয়েত জনগণ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সম্পদের মালিক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার। পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা অনুসারে সোভিয়েত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতো। ফলে আগামী পাঁচ বছর কী পরিমাণ পণ্য কারখানায় এবং কী পরিমাণ শস্য উৎপাদন হবে তা ৫ বছর আগেই নির্ধারিত হতো। ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরির ব্যবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল না।

১৯২৮ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত জাতীয় আয়ের চিত্র; Image Source: Wikipedia Commons

আশির দশকের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি তেল ও গ্যাস রপ্তানীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তেলের মূল্য কমে গেলে তা সোভিয়েত সরকারের আমদানী ও রপ্তানী বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা বাজেট ঘাটতি তৈরি করে। অর্থনীতির করুণ দশা কাটাতে সোভিয়েত সরকার বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করার দরুণ ১৯৮০ এর দশকে সোভিয়েত অর্থনীতি মারাত্মক মন্দার মুখে পড়ে।

সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ১৯৮৫ সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনকার্য এবং অর্থনীতিতে সংস্কার শুরু করেন, যা ইতিহাসে পেরেস্ত্রোইকা (পুনর্গঠন) ও গ্লাসনস্ত (উদারীকরণ) নামে খ্যাত। এ সময় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় অর্থনীতিতে উদারীকরণের ছোঁয়া লাগে, কিন্তু ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাজার চাহিদার সাথে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মারাত্মক ঘাটতি শুরু হয়ে গেছে। ফলে বিলম্বিত উদারীকরণ খুব বেশি সুফল বয়ে আনতে পারেনি। তাছাড়া প্রতিযোগীতামূলক বাজারে পণ্য তৈরিতে বাকি বিশ্ব যেভাবে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করেছিল, তার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা খাপ খাওয়াতে না পারায় পণ্য উৎপাদন মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়।

জনগণের ক্রয় ক্ষমতার একটি চিত্র; Image Source: Wikipedia Commons

বৈদেশিক সর্ম্পক

এ সময় বিশ্ব রাজনীতি ও বৈদেশিক সর্ম্পকেও সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে শুরু করে। গর্বাচেভ পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত ব্লকভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করে দেন। ফলে তারা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ শুরু করে। তিনি একইসাথে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির একত্রীকরণকে সমর্থন করেন। ইউরোপে ন্যাটো এবং ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যে শীতল যুদ্ধ চলছিল, তা গর্বাচেভের পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত নীতির কারণে যুদ্ধে সমাপ্তি টানতে শুরু করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯২৯ সালে সাইনো-সোভিয়েত যুদ্ধে চীনকে পরাজিত করে। ১৯৩৯-৪০ সালে সোভিয়েতদের উত্তর দিকে সীমানা বৃদ্ধির ইচ্ছা থেকে শুরু হয় সোভিয়েত-ফিনিশ যুদ্ধ। সোভিয়েতরা ভেবেছিল এ যুদ্ধ তিন সপ্তাহে শেষ হবে, কিন্তু তা প্রায় দেড় বছর ধরে চলে, যা সোভিয়েত সেনাবাহিনীকে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দিকে সোভিয়েতরা জার্মানির সাথে চুক্তি করে যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকে। তবে জার্মানি চুক্তি ভঙ্গ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণ শুরু করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রপক্ষে যোগ দেয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সাথে মিলিতভাবে যুদ্ধ শুরু করে।

সোভিয়েত-ফিনিশ যুদ্ধ চলাকালীন একটি ছবি, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায়ও যোদ্ধারা মারা যায়;
Image Source: Rare Historical Images

১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে কমিউনিস্ট শাসন অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্তি প্রয়োগ করে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এমন আচরণের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বকে এ বার্তা দেয় যে, তারা তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য যেকোনো আচরণ করতে পারে। ১৯৬৮ সালে প্রাগ বসন্তকে দমনের জন্য সোভিয়েত সেনারা চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রবেশ করে, যা বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় তোলে।

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে প্রবেশ করে, যার ফল সদূরপ্রসারী। এই অনুপ্রবেশ থেকে আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে যে টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা থেকে পরবর্তীতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সহিংসতার জন্ম হয়, যা এখনও চলছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে এ যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

ভাঙন

১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর (জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ২৫ অক্টোবর) লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাশিয়ার তৎকালীন অস্থায়ী সরকারকে পদচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। একে ইতিহাসে ‘অক্টোবর বিপ্লব’ বা ‘বলশেভিক বিপ্লব’ নামে অভিহিত করা হয়। এর আগে একই বছরের মার্চে আরেক বিপ্লবের মাধ্যমে জারের পতন ঘটানো হয়েছিল। বলশেভিকদের ক্ষমতা দখলের পর তাদের বিরুদ্ধে ডানপন্থী, লিবারেল এবং সাম্রাজ্যবাদীরা একজোট হয়ে গঠন করে ‘হোয়াইট আর্মি’। এরপর রেড আর্মি (বলশেভিক আর্মি) ও হোয়াইট আর্মির (বলশেভিক বিরোধী আর্মি) মধ্যে শুরু হয় রাশিয়ান গৃহযুদ্ধ।

গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর আরো কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র একত্রিত হয়ে গঠন করে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিকস (ইউএসএসআর) বা সোভিয়েত ইউনিয়ন। কয়েক মাস পর ১৯২৩ সালের ১৬ জুন শেষ হয় গৃহযুদ্ধ; যুদ্ধে বলশেভিকদের রেড আর্মি জয়লাভ করে। কমিউনিস্ট মতবাদ ক্রমেই পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় বিস্তার লাভ করতে থাকে। আরো কয়েকটি প্রজাতন্ত্র যোগদান করে সোভিয়েত ইউনিয়নে। এর ফলে এক বিশাল রাষ্ট্রে পরিণত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল ভূখন্ডের মধ্যে প্রায় একশোটি ছোট বড় জাতির বসবাস ছিল; image source: britannica.com 
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল ভূখণ্ডের মধ্যে প্রায় একশোটি ছোট-বড় জাতির বসবাস ছিল; image source: britannica.com 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজম ও পশ্চিমা ক্যাপিটালিজম মতবাদের মধ্যে শুরু হয় স্নায়ু যুদ্ধ। সামরিক, মহাকাশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সোভিয়েতরা পশ্চিমাদের সাথে সমান তালে চলেছিল। কিছুক্ষেত্রে এগিয়েও গিয়েছিল। মহাকাশে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ ও পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কোনো প্রাণী (লাইকা নামক কুকুর) পাঠানোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এগিয়ে ছিল।

কিন্তু এই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮০’র দশকের শেষের দিকে এসে হঠাৎ করে দুর্বল হতে থাকে। ১৯৯১ সালে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুড়ান্ত পতন ঘটে। এতটা সহজে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ইউনিয়ন ভেঙে এর থেকে তৈরি হয় ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শান্তিপূর্ণভাবে স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়। প্রায় চার দশকের স্নায়ু যুদ্ধে উত্তেজনা কখনো কখনো এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, পৃথিবী পারমাণবিক হলোকাস্টের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু কেন একটি পরাশক্তির এমনভাবে পতন হলো, কেনই বা ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন?

গর্বাচেভের নতুন নীতি

একসময়ের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছিল মূলত সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত নেতা হিসেবে তার প্রায় সাড়ে ছয় বছরের শাসনামলে যে বিপুল পরিমাণে সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিলেন তার কারণে। তার করা সংস্কারগুলোকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮৫ সালের ১১ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আরোহণ করেন মিখাইল গর্বাচেভ। ইতোমধ্যে সোভিয়েত জনগণ কমিউনিস্টদের অত্যাচার, নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নতুন নেতা গর্বাচেভ অন্যান্য সোভিয়েত শাসকদের থেকে আলাদা ছিলেন। তিনি গতানুগতিক সোভিয়েত ধারার বাইরে গিয়ে নতুনভাবে ইউনিয়নকে সাজাতে চেয়েছিলেন।

সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন; image source: time.com
সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেন; image source: time.com

গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৮৬ সালে গ্লাসনস্ত (স্বচ্ছতা) এবং পেরেস্ত্রোইকা (পুনর্গঠন) নীতি গ্রহণ করেন। গ্লাসনস্ত অনুযায়ী সোভিয়েতরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা পায়। প্রায় সাত দশকের সোভিয়েত শাসনে নাগরিকরা যে স্বাধীনতাহীনতায় ভুগেছে তার অবসান ঘটে। মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা ও মুক্ত আলোচনার অধিকার পায়। এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্রের অবসানের মাধ্যমে নাগরিকদের ভোটাধিকার ও কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে গিয়ে দল গঠন ও নির্বাচনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

আর পেরেস্ত্রোইকা অনুযায়ী ভঙ্গুর সোভিয়েত অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা করা হয়। নতুন নীতি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনেকটা বর্তমান চীনের মতো ক্যাপিটালিজম এবং কমিউনিজমের সংমিশ্রণে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে যে রাষ্ট্রীয় আধিপত্য ছিল তা অবসানের পরিকল্পনা করা হয়।

গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা নীতি সোভিয়েত জনগণকে অধিকতর স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করে; image source: tvvn.org
গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা নীতি সোভিয়েত জনগণকে অধিকতর স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করে; image source: tvvn.org

উক্ত নীতিদ্বয়ের মাধ্যমে গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সার্বজনীন ভোটাধিকার, গণতন্ত্রীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতির পরিবর্তে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এই নীতিগুলোর ফলে মানুষ খাঁচা থেকে মুক্ত পাখির মতো উড়তে থাকে। প্রায় সাত দশক ধরে চলা কমিউনিস্ট নির্যাতন থেকে চিরস্থায়ীভাবে বাঁচার প্রয়াস পায় তারা। এর ফলে নাগরিকরা উন্নত জীবনযাপন, আরো স্বাধীনতা ও কমিউনিজমের অবসানের পথ উন্মুক্ত হয়।

গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত গর্বাচেভের সংস্কারগুলোই সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার বদলে ধ্বংস করে দেয়।

গর্বাচেভের নীতিগুলোকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য দায়ী করা হয়; image source: banyan tree
গর্বাচেভের নীতিগুলোকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য দায়ী করা হয়; image source: banyan tree

গর্বাচেভের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে স্নায়ু যুদ্ধের শীতল সম্পর্কে কিছুটা উষ্ণতা আসে। স্নায়ু যুদ্ধ সমাপ্তিতে তার উদ্যোগের স্বীকৃতি সরূপ ১৯৮৮ সালে টাইম ম্যাগাজিন গর্বাচেভকে ‘ম্যান অভ দ্য ইয়ার’ মনোনীত করে। পরের বছর টাইম ম্যাগাজিন গর্বাচেভকে ‘দশকের সেরা ব্যক্তি’ হিসেবে মনোনীত করে। ১৯৯০ সালে গর্বাচেভ ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন।

অর্থনৈতিক কারণ

সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অন্যান্য দেশ থেকে আলাদা ছিল। সেখানে সম্পদের কোনো ব্যক্তি মালিকানা ছিল না অর্থাৎ সকল সম্পদের মালিক ছিল রাষ্ট্র। তবে আইনগতভাবে সম্পদের মালিক রাষ্ট্র হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করতো কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা রাষ্ট্রীয় সম্পদে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে থেকেছে। সোভিয়েত অর্থনীতি কমাণ্ড সিস্টেমের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ছিল। অর্থনীতি এমন এক ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয় যেখানে শিল্প স্থাপন থেকে শুরু করে কৃষি উৎপাদন ও শ্রমিকদের মজুরি প্রদান সবই রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করতো। কেমন উৎপাদন হবে বা কী কী পণ্য উৎপাদন হবে তা নির্ধারণ করতো কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত পলিটব্যুরোরা (কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নীতিনির্ধারণী কমিটি)। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকায় প্রচুর উৎপাদনও হতো।

১৯২৮ থেকে ১৯৮৭ সালের পর্যন্ত সোভিয়েত জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির চিত্র; image source: wikiwand.com
১৯২৮ থেকে ১৯৮৭ সালের পর্যন্ত সোভিয়েত জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির চিত্র; image source: wikiwand

সত্তরের দশকে সোভিয়েত অর্থনীতির স্বর্ণযুগ ছিল। ১৯৯০ সালেও সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি ছিল। তখন মার্কিন অর্থনীতির ৬০ শতাংশ ছিল সোভিয়েত অর্থনীতি। ১৯৯১ সালের হিসেব অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের জিডিপি ছিল ২.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং গড় আয় ছিল ৮৭০০ মার্কিন ডলার। এতো ভালো অর্থনীতি হওয়ার পরও ব্ল্যাক মার্কেটের কারণে সোভিয়েত অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। ধারণা করা হয়, সোভিয়েত ব্ল্যাকমার্কেটের আয়তন ছিল সোভিয়েত জিডিপি’র প্রায় ১০ শতাংশ। কমিউনিস্ট নেতা ও পলিটব্যুরোরা তাদের অত্যাধিক ক্ষমতার ফলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। নেতা ও পলিটব্যুরোদের সীমাহীন দুর্নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছিল।

জোসেফ স্ট্যালিন তার আমলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের চেয়ে ভারী শিল্প বিশেষ করে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের দিকে জোর দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পেট্রোলিয়াম উৎপাদনে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বে প্রথম সারিতে ছিল। পেট্রোলিয়াম সোভিয়েত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছিল। জার্মান আক্রমণের পর ১৯৪২ সালে সোভিয়েত জিডিপি ৩৪ শতাংশ কমে যায় ফলে তা সোভিয়েত শিল্পদ্রব্য উৎপাদনকে পঙ্গু করে দেয়। যুদ্ধ শেষে অর্থনীতিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে ষাটের দশক পর্যন্ত সময় লেগেছিল।

সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ স্নায়ুযুদ্ধকে চরম মাত্রায় নিয়ে যান; image source: onthisday.com
সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ স্নায়ুযুদ্ধকে চরম মাত্রায় নিয়ে যান; image source: onthisday.com

স্ট্যালিন পরবর্তী সোভিয়েত নেতারাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তারাও সামরিক ব্যায় ও অস্ত্র উৎপাদন কমায়নি, উপরন্তু বাড়িয়ে দিয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধের ফলে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্প কারখানাগুলোতে অস্ত্র উৎপাদন উর্ধ্বমূখী হতে থাকে। ১৯৬৪ সালে নতুন সোভিয়েত শাসক লিওনিদ ব্রেজনেভ অর্থনীতিতে কিছুটা সংস্কার আনার চেষ্টা করেন। তার সংস্কারের ফলে অর্থনীতি অনেকটা গতিশীল হয়। তবে গোড়ায় গলদ থেকেই যায়। ব্রেজনেভের সংস্কারের পরও সোভিয়েত অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকরা ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ায়নি।

সোভিয়েত ইউনিয়নে যত শিল্পদ্রব্য উৎপাদন হতো তার ৭০ শতাংশই সামরিক সরঞ্জাম। এ সময় স্নায়ু যুদ্ধের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশাল অর্থনীতির সাথে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সাধারণ মানুষের জীবনমানের দিকে দৃষ্টিপাত না করে ব্রেজনেভ স্নায়ুযুদ্ধে মেতে ওঠে। স্নায়ু যুদ্ধের ফলে পশ্চিমারা একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে তেল ও গ্যাস রপ্তানি নির্ভর সোভিয়েত অর্থনীতি ভঙ্গুর হতে থাকে। অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মধ্যেও কমিউনিস্ট নেতাদের দুর্নীতি বন্ধ ছিল না বরং বৃদ্ধি পেতে থাকে। দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হতে থাকে। ফলে তরুণ সোভিয়েতরা ক্রমেই কমিউনিস্ট মতাদর্শের উপর থেকে আস্থা হারাতে থাকে। তারা সংস্কার দাবি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সোভিয়েতরা ভোগ্যপণ্যের চেয়ে অতিরিক্ত সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করে যা অর্থনীতিকে ভেঙে দেয়; image source: coldwar.weebly.com
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সোভিয়েতরা ভোগ্যপণ্যের চেয়ে অতিরিক্ত সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করে যা অর্থনীতিকে ভেঙে দেয়; image source: coldwar.weebly.com

বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক স্থবিরতা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেতর থেকে অচল করে দিয়েছিল। সোভিয়েত অর্থনীতি ঘুনে ধরা এক অর্থনীতিতে পরিণত হয় যাকে স্পর্শ করলেই ভেঙে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে গর্বাচেভ এসে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ নীতির মাধ্যমে অবস্থার সংস্কার করে কিন্তু এ সংস্কার সোভিয়েত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের বদলে আরো ভেঙে দেয়। নতুন নীতির মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় অর্থনীতিতে উদারীকরণ করা হয়, কিন্তু ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাজার চাহিদার সাথে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মারাত্মক ঘাটতি শুরু হয়ে গেছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের বিষয়ে অজ্ঞতা ও অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক বাজারে টিকতে পারেনি। তাছাড়াও প্রতিযোগীতামূলক বাজারে পণ্য তৈরিতে বাকি বিশ্ব যেভাবে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করেছিল, তার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা খাপ খাওয়াতে না পারায় পণ্য উৎপাদন মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়।

উপরন্তু গর্বাচেভ এসে কর্মচারীদের মজুরি বাড়িয়ে দেন। ব্যায় নির্বাহের জন্য তিনি নতুন অর্থ ছাপানো শুরু করেন। বেতন বৃদ্ধি ও অর্থ ছাপানোর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বহুগুণ বেড়ে যায়। সেইসঙ্গে ফিসকাল পলিসির অব্যবস্থাপনা দেশটিকে আরো ভেঙে দেয়। সেই সময় মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে যখন ১৯৮৬ সালে তেলের দাম কমে যায়। যা সোভিয়েত অর্থনীতির ভীত পুরোপুরি ভেঙে ফেলে। তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক মার্কিন বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। এভাবে ১৯৯০ সালে এসে অর্থনীতি এতটাই ভেঙে যায় যে, এতো বড় একটা রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চালানো আর সম্ভব হচ্ছিল না।

চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয়

২৬ এপ্রিল ১৯৮৬, কিছু বুঝে উঠার আগেই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার একটি ঘটে যায়। এটি এমন এক দুর্ঘটনা যা একটি সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। চেরনোবিল পাওয়ার স্টেশনের অবস্থান ছিল বর্তমান ইউক্রেনের প্রাইপিয়াত অঞ্চলে। দুর্ঘটনাটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ছিল হিরোশিমায় পারমাণবিক হামলার ৪০০ গুণেরও বেশি। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরো পশ্চিমাঞ্চল ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর উপর পড়েছিল।

চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করে; image source: e-ir.info
চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করে; image source: e-ir.info

এই দুর্ঘটনার কিছুদিন আগেই গর্বাচেভ গ্লাসনস্ত নীতি গ্রহণ করেছিল। দুর্ঘটনার পর সোভিয়েত জনগণ গ্লাসনস্ত নীতির বাস্তবতা সম্পর্কে বুঝতে পারে। গ্লাসনস্ত অনুযায়ী সোভিয়েত প্রশাসনের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে ও খোলামেলাভাবে এই ঘটনা জনগণকে জানানো। কিন্তু বিস্ফোরণ সম্পর্কে অবহিত করার পরিবর্তে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তারা জনগণের কাছে এই বিপর্যয় এবং এর বিপদ সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য লুকিয়ে রাখে। কমিউনিস্ট পার্টি এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সকল তথ্যকে পশ্চিমা প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেয়।

দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরেই ছিল মে ডে। দুর্ঘটনার ফলে তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কিত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে পরিকল্পনা অনুযায়ীই মে ডে প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো সোভিয়েত প্রশাসনের চরম দায়িত্বহীনতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। সাধারণ জনগণ সোভিয়েত প্রশাসনের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে।

দুর্ঘটনার ১৮ দিন পর ১৪ মে গর্বাচেভ প্রথমবারের মতো এ সম্পর্কে বিবৃতি দেন। যাতে তিনি চেরনোবিলকে দুর্ভাগ্য বলে অভিহিত করেন। সেইসঙ্গে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদনগুলোকে দূষিত মিথ্যাচারের চরম অনৈতিক প্রচার বলে অভিহিত করেন। কিন্তু দুর্ঘটনা কবলিত অঞ্চলগুলোতে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ভোগান্তিতে থাকা মানুষগুলোর মন্তব্য কমিউনিস্ট পার্টির মিথ্যাচারকে উন্মোচিত করে। ফলে সরকার ও গ্লাসনস্ত নীতির উপর থেকে জনগণের আস্থা চুরমার হয়ে যায়।

সমস্ত ইউরোপে চেরনোবিল দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পড়ে; image source: pinterest 
সমস্ত ইউরোপে চেরনোবিল দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পড়ে; image source: pinterest 

চেরনোবিল দুর্ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে। কয়েক বছর পরে, গর্বাচেভ এই দুর্ঘটনার বার্ষিকীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার পেরেস্ত্রোইকা নীতি প্রবর্তনের চেয়েও চেরনোবিল সম্ভবত দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আসল কারণ ছিল।”

১৯৮৯ সালে সংঘটিত বিপ্লবসমূহ

গর্বাচেভ মনে করতেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনোন্মুখ অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে বাকি বিশ্বের সাথে বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে আরো স্পষ্ট করে বললে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। ১৯৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানের সাথে বৈঠকে সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভ পরমাণু অস্ত্রের লড়াই থেকে বেরিয়ে আসার এবং আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন। এক বছর পর তিনি ওয়ারশো চুক্তিভুক্ত দেশগুলোতে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেন।

পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলোর জনগণ সোভিয়েত বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে; image source: financial times 
পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলোর জনগণ সোভিয়েত বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে; image source: financial times 

সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু দেশ ছিল যাদেরকে সোভিয়েত স্যাটেলাইট স্টেট বলা হয়। এই দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ না হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা প্রভাবিত এবং সেখানে সোভিয়েত আজ্ঞাবহ কমিউনিস্ট সরকার বিদ্যমান ছিল। ১৯৮৯ সালে গর্বাচেভের নতুন সামরিক নীতি অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপের স্যাটেলাইট দেশগুলো সোভিয়েত বলয় থেকে বের হয়ে যেতে চাইলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই দেশগুলোতে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না।

এই সিদ্ধান্ত সোভিয়েত জোটকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ভেঙে চুরমার করে দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই এই দেশগুলোতে কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কিছুদিন পর পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট বিরোধী ট্রেড ইউনিয়নবাদীরা কমিউনিস্ট সরকারকে স্বচ্ছ নির্বাচন প্রদানে বাধ্য করে। নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দুই জার্মানি এক হয়ে যায়। এরপর চেকোস্লোভাকিয়ায় ‘ভেলভেট ডিভোর্স’ বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানকার কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করা হয়।

ভেলভেট ডিভোর্সের মাধ্যমে চেকোস্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের পতন ঘটে; image source: prague morning
ভেলভেট ডিভোর্সের মাধ্যমে চেকোস্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের পতন ঘটে; image source: prague morning

ডিসেম্বরে, রোমানিয়ার কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক নিকোলাই সিউসেস্কু এবং তার স্ত্রী এলেনাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে  মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে সংঘটিত এই বিপ্লবগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য প্রজাতন্ত্রগুলোকে উৎসাহিত করেছে। পরবর্তীতে তারাও স্বাধীনতার দাবি তোলে। এই বিপ্লবগুলোর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার আন্তর্জাতিক প্রভাব হারায়। আন্তর্জাতিক অনাস্থা ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ অনাস্থায় রূপ নেয়। এর রেশ ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা দাবির সাহস করে। এই বিপ্লবগুলোই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের প্রথম ধাপ।

বার্লিন প্রাচীরের পতন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। মার্কিন-সোভিয়েত প্রতিযোগিতায় বলির পাঁঠা হয় অনেক দেশ। জার্মানিও এই ফাঁদে পড়ে। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর জার্মানিকে পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করা হয়। পূর্ব জার্মানি ছিল কমিউনিস্টদের অধীনে, সোভিয়েত ইউনিয়নের আজ্ঞাবহ। আর পশ্চিম জার্মানি ছিল পুঁজিবাদী এবং গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত।

একইভাবে জার্মানির রাজধানী বার্লিনকেও ভাগ করা। ১৯৬১ সালে বার্লিন শহরের মাঝে পূর্ব ও পশ্চিমকে আলাদা করার জন্য দেয়াল নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে বার্লিন দেয়াল জার্মানিকে সোভিয়েত-কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানি এবং গণতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানিতে বিভক্ত করে। প্রাচীরটি কমিউনিস্ট শাসনে অসন্তুষ্ট পূর্ব জার্মানদের পশ্চিমে স্বাধীনতার জন্য পালিয়ে যেতে বাধা দেয়। কিন্তু মন কী আর বাঁধা মানে? শত বাঁধা অতিক্রম করেও অনেক জার্মান পূর্ব থেকে দেয়াল টপকে পশ্চিমে গিয়েছে। দেয়াল অতিক্রমের সময় ১৯৬১ ও ১৯৯১ এর মধ্যে প্রায় ২০০ জন জার্মান নিহত হয়। জার্মানরা একত্রিত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

১৯৮৭ সালের ১২ জুন পশ্চিম জার্মানিতে দেওয়া এক বক্তব্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভকে প্রাচীরটি ভেঙে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এ সময়ের মধ্যে, রিগ্যানের কমিউনিস্টবিরোধী ‘রিগ্যান ডকট্রিন’ পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েতের প্রভাবকে দুর্বল করে দিয়েছিল এবং সেইসঙ্গে জার্মান পুনর্মিলনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় পূর্ব জার্মানিতেও আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমদিকে আন্দোলনকারীরা পশ্চিম জার্মানিতে চলে যাওয়ার দাবি তুললেও পরবর্তীতে তারা পূর্ব জার্মানিতে থেকেই সরকার পতনের দাবি তুলে। আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হতে থাকে।

প্রবল আন্দোলনের মুখে পূর্ব জার্মানির দীর্ঘকালীন নেতা এরিক হোনেকার ১৯৮৯ সালের ১৮ ই অক্টোবর পদত্যাগ করেন এবং এদিন নতুন নেতা হিসেবে অ্যাগন ক্রেঞ্জ তার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বরে নতুন পূর্ব জার্মানি সরকার ও জনগণ সত্যিই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলে। এর মাধ্যমে তিন দশকের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয় জার্মানরা।

বার্লিন প্রাচীর পতনের উদযাপন করছে জার্মানরা; image source: Steve Eason/Hulton Archive/Getty Images 
বার্লিন প্রাচীর পতনে উদযাপন করছে জার্মানরা; image source: Steve Eason/Hulton Archive/Getty Images 

১৯৯০ সালের অক্টোবরের মধ্যে জার্মানি পুরোপুরি একত্রিত হয়। জার্মানির পুনর্মিলন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোকে আন্দোলিত করে। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আফগানিস্তান যুদ্ধ ও সামরিক কারণ

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি তার সামরিক বাহিনীও অনেকাংশে দায়ী ছিল। সাবেক সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ ক্ষমতায় আসার পর স্নায়ু যুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুরু হয় অস্ত্র প্রতিযোগিতা। বহির্বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অনেক দেশে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে সোভিয়েত সামরিক ব্যায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অর্থনীতির সাথে সামরিক ব্যায়ের বিশাল তফাত তৈরি হয়। বাজেটে অন্যান্য খাত থেকে সামরিক খাতে অত্যাধিক ব্যায় করা হয়। ধারণা করা হয়, সোভিয়েত জিডিপির ১০ থেকে ২০ ভাগই ব্যায় হতো সামরিক খাতে। এরই মধ্যে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। আফগান যুদ্ধ ধুঁকতে থাকা সোভিয়েত অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে দেয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান কমিউনিস্ট প্রভাব কমাতে রিগ্যান ডকট্রিন প্রকাশ করেন; image source: whitehouse.gov
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান কমিউনিস্ট প্রভাব কমাতে রিগ্যান ডকট্রিন প্রকাশ করেন; image source: whitehouse.gov

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগ্যান ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়। রিগ্যান কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রোনাল্ড রিগ্যান সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘ইভিল এম্পায়ার’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি কমিউনিজমের ধ্বংস ও স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তির লক্ষ্যে কমিউনিস্ট বিরোধী ‘রিগ্যান ডকট্রিন’ প্রকাশ করেন। প্রথমদিকে তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে সোভিয়েত সামরিক বাজেট আরো বৃদ্ধি করতে হয়। যা ভাংতে থাকা সোভিয়েত অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে দেয়। গর্বাচেভ ক্ষমতায় আসার পর তিনি স্নায়ু যুদ্ধ সমাপ্তির পথে হাঁটেন। তার নেওয়া নতুন নীতি অনুযায়ী তিনি সামরিক ব্যায় কমানোর পরিকল্পনা নেন। গর্বাচেভ সামরিক বাজেট ও সামরিক বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা কয়েক লক্ষ কমিয়ে আনেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনার জন্যও চুক্তি করেন।

গর্বাচেভ ও রিগ্যান ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস চুক্তি করেন; image source: Reuters
গর্বাচেভ ও রিগ্যান ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস চুক্তি করেন; image source: Reuters

আফগানিস্তান যুদ্ধ তখনো চলছে। দশ বছর (১৯৭৯-১৯৮৯) ধরে চলা আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত অর্থনীতি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই যুদ্ধে ৬ লক্ষাধিক সোভিয়েত সেনা অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে ১৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্য নিহত হয় এবং হাজার হাজার সৈন্য আহত হয়। এই যুদ্ধে দুই থেকে আড়াই লক্ষ আফগান মুজাহিদিন নিহত হয়। শুধু সামরিক বাহিনী নয় এই যুদ্ধে দশ লক্ষাধিক আফগান বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। যুদ্ধ যখন শুরু হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক ও মিডিয়া তখন সরকার কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবে গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত (স্বচ্ছতা) নীতির ফলে জনগণ ও মিডিয়ার উপর থেকে কঠোরতা উঠে যায়। ফলে মিডিয়ায় প্রচারিত যুদ্ধের ভয়াবহতা সোভিয়েত জনগণকে সচেতন করে তুলে। সোভিয়েত সৈন্যরা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও যুদ্ধকালীন যে অপব্যবহারের শিকার তারা হয়েছে তা প্রকাশ্যে বলতে থাকে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নে যুদ্ধবিরোধী জনমত বৃদ্ধি পেতে থাকে।

আফগান যুদ্ধ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ; image source: weebly.com 
আফগান যুদ্ধ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম কারণ; image source: weebly.com 

ইউরোপীয় প্রজাতন্ত্রগুলোর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিভাজন ছিল আরও নাটকীয়। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বাল্টিক অঞ্চলের প্রজাতন্ত্রগুলো আফগানিস্তান যুদ্ধকে তাদের নিজেদের দেশে রাশিয়ার দখলের সাথে তুলনা করে দেখছিল। এই যুদ্ধ ১৯৯০ সালে তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনার জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।

১৯৮৯ সালে মিখাইল গর্বাচেভ আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ফলে শেষ হয় ভয়াবহ আফগান যুদ্ধ। কিন্তু এর রেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটিয়ে শেষ হয়। এরই মধ্যে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে সোভিয়েত সৈন্যরাও তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। দুর্বল সোভিয়েত সেনাবাহিনী জর্জিয়া, আজারবাইজান এবং লিথুয়ানিয়া প্রজাতন্ত্রগুলোতে সোভিয়েত বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করতে অক্ষম ছিল। যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আফগান যুদ্ধ শেষে সোভিয়েত বাহিনী ফিরে যাচ্ছে, তবে তারা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিল; image source: Russia beyond 
আফগান যুদ্ধ শেষে সোভিয়েত বাহিনী ফিরে যাচ্ছে। নসিকভাবে তারা ছিল বিধ্বস্ত; image source: Russia beyond 

সোভিয়েত সেনাবাহিনীর এমন নাজুক অবস্থার জন্য কট্টর কমিউনিস্ট সমর্থক সেনা সদস্যরা গর্বাচেভের নীতি (গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা)-কে দায়ী করে। তারা গর্বাচেভকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। কিন্তু তিন দিনের মধ্যে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। এই অভ্যুত্থান চেষ্টার ফলে সোভিয়েত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিশৃঙ্খলা এবং অবিশ্বাস দেখা যায়। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আরো ত্বরান্বিত হয়। এজন্য আফগান যুদ্ধকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

রাজনৈতিক কারণ

মিখাইল গর্বাচেভ ক্ষমতায় আসার পর তিনি সোভিয়েত রাজনীতিতেও সংস্কার আনেন। ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিলের পরিবর্তে ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ গঠন করা হয়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রকে আলাদা করার পরিকল্পনা করেন। নতুন পদ্ধতিতে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছাড়াও অন্যান্য নাগরিকদের নির্বাচন করার সুযোগ তৈরি হয়। নতুন কংগ্রেসে শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের জন্য কিছু আসন রাখা হয়। পরিবর্তিত পদ্ধতি অনুযায়ী কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা ছিল ২,২৫০ জন, যারা উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতো। এই পিপলস ডেপুটিজদের ভেতর থেকে ৫৪২ সদস্য বিশিষ্ট নতুন সুপ্রিম কাউন্সিল গঠিত হয়, যার চেয়ারম্যান হতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট।

সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। এমনকি সোভিয়েত কেন্দ্রীয় কমিটিতেও পরিবর্তন আনা হয়। গর্বাচেভ সোভিয়েত নীতিনির্ধারণী কমিটিতে অনেক নতুন সদস্যকে জায়গা দেন। ১৯৮৫ সালের ১ জুলাই তিনি পলিটব্যুরো থেকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রেগরি রোমানভকে সরিয়ে দেন এবং বরিস ইয়েলৎসিনকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেন।

একই বছরের ডিসেম্বরে গর্বাচেভ ইয়েলৎসিনকে মস্কো কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি পদে ভিক্টর গ্রিশিনের স্থলাভিষিক্ত করেন। ১৯৮৭ সালে গর্বাচেভ কয়েক ডজন রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেন। ১৯৮৭ সালে বরিস ইয়েলৎসিন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি গর্বাচেভের সমালোচনায় মেতে ওঠেন। এর মাধ্যমে ইয়েলৎসিনের উত্থান ঘটে। পরবর্তী চার বছরে গর্বাচেভ-ইয়েলৎসিন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বড় ভূমিকা রাখে।

একসময় গর্বাচেভ ও ইয়েলৎসিনের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল; image source: rt.com
একসময় গর্বাচেভ ও ইয়েলৎসিনের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল; image source: rt.com

১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাল্টিক, ককেশাস ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে গণতন্ত্র ও কিছু অঞ্চলে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ইতোমধ্যে সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে দল গঠন করে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর সিএনএন কোনো বিদেশি চ্যানেল হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে সংবাদ প্রচারের অনুমোদন পায়। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত নির্বাচনে ৬টি প্রজাতন্ত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ভরাডুবি হয়, সেখানে জাতীয়তাবাদীরা জয়লাভ করে। সেখানকার জাতীয়তাবাদীরা কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স দিতে অস্বীকার করে। ফলে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়।

১৯৯০ সালের ১২ জুনের সুপ্রিম সোভিয়েত নির্বাচনে রাশিয়ান প্রজাতন্ত্রে বরিস ইয়েলৎসিন জয়লাভ করেন। বিপরীতে গর্বাচেভের পছন্দসই প্রার্থী বিশাল ব্যবধানে হারে। ফলে রাশিয়ান ফেডারেশন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইয়েলৎসিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দেওয়ার জন্য অন্যান্য প্রজাতন্ত্রগুলোর সাথে আলোচনা করতে থাকেন।

১৯৯১ সালের লিথুয়ানিয়ার গণভোট ৯৩.২ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়; image source: wikipedia 
১৯৯১ সালের লিথুয়ানিয়ার গণভোট ৯৩.২ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়; image source: wikipedia 

১৯৯১ সালের শুরুতে কয়েকটি প্রজাতন্ত্রে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে গর্বাচেভ সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হ্রাস করার পরিকল্পনা করেন।

১৯৯১ সালের ২০ আগস্ট রাশিয়ান ফেডারেশন একটি নতুন চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়, চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো মিলে একটি ফেডারেশন গঠন করবে। সামরিক ও পররাষ্ট্র দপ্তর থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, অন্যান্য সকল বিষয়ে আঞ্চলিক সরকার পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো একে সমর্থন করে।

অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যে শত শত ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তায় নামে সামরিক বাহিনী; image source: themoscowtimes.com
অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যে শত শত ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তায় নামে সামরিক বাহিনী; image source: themoscowtimes.com

এমন পরিস্থিতিতে ১৯ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঠেকাতে কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, কেজিবির প্রধান ও অন্যান্য কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিলে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। গর্বাচেভের উদারপন্থী নীতির বিপরীতে তারা আবারো আগের কঠোরতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন এবং গর্বাচেভ ও বরিস ইয়েলৎসিনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেন।

সাধারণত কোনো অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানকারীরা জরুরি অবস্থা জারি করে। সোভিয়েত ইউনিয়নেও তারা চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ীই রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা জারি করে। এ সময় গর্বাচেভ ক্রিমিয়ায় ছিলেন, সেখানে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। অভ্যুত্থানকারীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অধিকাংশ সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে। কিন্তু রাশিয়ান পার্লামেন্টের সামনে অভ্যুত্থানের বিরোধীতা করে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে মস্কোয় রাশিয়ান পার্লামেন্টের সামনে বিশাল জনসমাবেশ করা হয়।

অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করার জন্য ইয়েলৎসিন মস্কোতে বিশাল জনসমাবেশ করেন- মাঝখানে কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি ইয়েলৎসিন; image source: britannica.com 
অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করার জন্য ইয়েলৎসিন মস্কোয় বিশাল জনসমাবেশ করেন (কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি); image source: britannica.com 

তিন দিন পর ২১ আগস্ট অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই অভ্যুত্থানচেষ্টা সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে। ২৪ আগস্ট গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকেন। গর্বাচেভ সরকার ও পার্টিকে আলাদা করার উদ্দেশ্যে সরকারের অভ্যন্তরে পার্টির সকল কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন, সেইসঙ্গে নতুন কিছু পদ তৈরি করেন। একই দিনে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে।

কয়েকদিনের মধ্যে সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিল সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির সকল কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্য শেষ হয়। ৫ সেপ্টেম্বর গর্বাচেভ স্টেইট কাউন্সিল অব দ্যা সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করেন। এমন পরিস্থিতিতে ১৭ সেপ্টেম্বর এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া (যারা ইতোমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছে) জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।

বাম দিক থেকে: ইউক্রেনের লিওনিদ ক্রাভচুক, বেলারুশের স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচ এবং রাশিয়ার ইয়েলৎসিন; image source: bbc.com
বাম দিক থেকে: ইউক্রেনের লিওনিদ ক্রাভচুক, বেলারুশের স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচ ও রাশিয়ার ইয়েলৎসিন; image source: bbc.com

১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর পূর্ব বেলারুশের এক বিলাসবহুল বাড়িতে বৈঠকে বসলেন তিনটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের (রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেন) নেতারা। বৈঠকটি ডেকেছিলেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচ। ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক আর রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন যোগ দিলেন তার সঙ্গে। ইউক্রেন কিছুদিন আগেই স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছে।

তাদের এই বৈঠক সোভিয়েত ইউনিয়নের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। বৈঠকে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির বিষয়ে একমত হন। “আন্তর্জাতিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আর কোনো অস্তিত্ব নেই” এ বক্তব্য দিয়ে বলে তিন নেতা ঐতিহাসিক বেলাভেজা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। উক্ত চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লেন। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হলো। পুরো পরিকল্পনাটির পেছনে স্বয়ং বরিস ইয়েলৎসিন ছিলেন। সেই রাতেই ইয়েলৎসিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশকে ফোন করে চুক্তির বিষয়ে জানান।

বেলাভেজা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বেলারুশ, ইউক্রেন ও রাশিয়ার নেতারা; image source: euromaidanpress.com
বেলাভেজা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বেলারুশ, ইউক্রেন ও রাশিয়ার নেতারা; image source: euromaidanpress.com

১২ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়ান প্রজাতন্ত্রের সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিল এই চুক্তির অনুমোদন দেয়। একই দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিল থেকে রাশিয়ান ডেপুটিজদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের অবশিষ্ট ১২টি প্রজাতন্ত্রের ১১টির প্রতিনিধিরা (জর্জিয়া ছাড়া) ‘আলমা-আতা প্রটোকল’ চুক্তির মাধ্যমে ঘোষণা দেয় যে তারা আর সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকবে না, পরিবর্তে তারা স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো মিলে একটি কমনওয়েলথ গঠন করবে। তিনটি বাল্টিক প্রজাতন্ত্র (লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং এস্তোনিয়া) ইতোমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। তারা এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। এমন পরিস্থিতিতে গর্বাচেভের পদত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা ও বিচ্ছেদে হতাশ হয়ে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দেবেন বলে ঘোষণা দেন।

২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১, শেষবারের মতো মস্কোর ক্রেমলিনে সোভিয়েত পতাকা উড়ে। সেদিন সন্ধ্যা ৭:০২ মিনিটে সোভিয়েত পতাকা নামিয়ে সেখানে রাশিয়ার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ দিন (২৫ ডিসেম্বর) সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ “আমরা এখন একটি নতুন পৃথিবীতে বাস করছি” বলে পদত্যাগ করেন। এরপর গর্বাচেভ রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিনের কাছে ক্ষমতা (পারমাণবিক অস্ত্রের কোড ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়) হস্তান্তর করেন।

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের খবর; image source: nytimes.com 
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের খবর; image source: nytimes.com 

১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পক্ষে ভোট দেয়। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। ৬৯ বছর আগে গঠিত হওয়া বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

শেষ কথা

১৯৮৬ সালে সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিলের পরিবর্তে কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ গঠন করা হয়। পরিবর্তিত কংগ্রেসে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছাড়াও অন্যান্য নাগরিকদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ছিল। তাছাড়া নতুন কংগ্রেসে বিজ্ঞানী ও পন্ডিতদের জন্যও নির্দিষ্ট কিছু আসন সংরক্ষণ করা হয়। কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা ছিল ২,২৫০ জন, যারা উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতো। এই পিপলস ডেপুটিজদের ভেতর থেকে ৫৪২ সদস্য বিশিষ্ট নতুন সুপ্রিম কাউন্সিল গঠিত হয়, যার চেয়ারম্যান হতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ।

১৯৯১ এর আগস্টে গর্বাচেভের সংস্কারের বিরুদ্ধচারী কট্টরপন্থীরা বিদ্রোহ করার চেষ্টা চালায়, যা ব্যর্থ হয়। তবে এ ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাঠামোকে একেবারে নাজুক করে তোলে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রিপাবলিকসমূহ নিজ নিজ অঞ্চলের জন্য আরও বেশি স্বাধীনতা দাবী করতে শুরু করে। ১৯৯১ এর ডিসেম্বরে দ্য ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এর অফিস বিলুপ্ত হয়।

একইসাথে গর্বাচেভ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত আলাদা রিপাবলিকগুলো নিয়ে একটি কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটসের প্রস্তাব দেন। লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া প্রস্তাবিত কমনওয়েলথে ঢুকতে অস্বীকৃতি জানায় এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার ঘোষণা দেয়। ১৯৯১ সাল ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ বছর।

লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। বাকি ১২টি সার্বভৌম দেশ কমনওয়েলথ অব ইনডিপেন্ডেন্ট স্টেটসে যোগ দেয়। অপরদিকে, জর্জিয়া কমনওয়েলথ থেকে বের হয়ে যায়। বাকি ১১টি সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিক নিজেদের ভেতর নতুন বলয় তৈরি করতে শুরু করে, যা নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য কোনো একক কারণকে দায়ী করা যায় না। অনেকগুলো কারণ যখন একে অপরের সঙ্গে মিলেছে তখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে এর পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় গর্বাচেভের নীতিগুলোকে। তবে গর্বাচেভের নীতিগুলো প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকলেও এর পতনের শেকড় আরো গভীরে।

চূড়ান্ত বিশ্লেষণে অনুযায়ী, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী গর্বাচেভের পূর্বসূরি লিওনিড ব্রেজনেভ, যিনি সোভিয়েত নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করার পরিবর্তে আমেরিকার বিরুদ্ধে অযাচিত অস্ত্রের লড়াইয়ে দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নেই কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটায়নি বরং কমিউনিজমের অস্তিত্বের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের রেশ ধরে আরো কয়েকটি দেশে কমিউনিজমের পতন ঘটে।

2364 ভিউ

Posted ২:৫৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৭ মার্চ ২০২১

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : Shaheed sharanee road, cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com