এম.জিয়াবুল হক,চকরিয়া(৪ জুলাই) :: ৩দিনের টানা ভারী বৃষ্টি ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার উপজেলার নিন্মাঞ্চল। তলিয়ে গেছে উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক। উপজেলার শতাধিক গ্রামের ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। পেকুয়া ও মহেশখালী উপজেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
মঙ্গলবার পর্যন্ত ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় এবং পাহাড় থেকে পানি নিচের দিকে নেমে আসায় মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদ সামীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চকরিয়া শহরক্ষাবাধঁ হুমকির মূখে রয়েছে, যে কোন মূহুর্তে বড় ধরনের বিপদ আশংক্ষা রয়েছে বলে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। মাতামুহুরীর নদীর তীরভর্তি ঘুণিয়া এলাকায় ৬টি বাড়ী নদীর গর্তে বিলীন হয়ে গেছে।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী জানিয়েছেন, পৌরসভার ৯নম্বর ওয়ার্ডের ক্ষেত্রপাল মন্দির এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মানাধীন তীর সংরক্ষন কাজ যথাসময়ে (জুন মাসে) শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। নদীতে ব্লক বসাতে দেরী করার কারনে গতকাল মঙ্গলবার ওই এলাকার পানির প্রবল ধাক্কায় অন্তত ৬টি বসতঘর নতুন করে মাতামুহুরীর নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে।
মেয়র বলেন, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার কারনে একদিকে বৃষ্টির পানি , অপরদিকে পাহাড়ি ঢলে পৌরসভার প্রতিটি এলাকায় জনগনের মাঝে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে কাউন্সিলর ও এলাকার লোকজনের সহায়তায় দুর্গত এসব এলাকার বিভিন্ন স্থানে মাটি ও বালু বস্তা ফেলে জনসাধারণের বসতঘর নদী থেকে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে উপজেলার চিংড়ি জোনের মৎস্য প্রকল্পসমূহ পানিতে তলিয়ে গিয়ে বিপুল পরিমাণ মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ার আশংকা দেখা দেবে। বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার ও কোনাখালী ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার, কায়ছার ও ডুলাহাজারার চেয়ারম্যান নুরুল আমিন জানান, ৩ দিনে বিরামহীন টানা বৃষ্টিতে আমাদের এলাকার বেশীরভাগ নিম্মাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীন সড়কগুলোও পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এতে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা মারত্মক ব্যাহত হচ্ছে ।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম জানিয়েছেন, সোমবার সকাল থেকে তার ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ইউনিয়নের বেশিরভাগ নীচু এলাকা পানিতে ভাসছে। কাকারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান বলেন, তিনদিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে তাঁর ইউনিয়নের নদীর তীরবর্তী এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। বর্তমানে ইউনিয়নের প্রপার কাকারা, সাকের মোহাম্মদ চর ও মাঝেরফাড়ি এলাকার বেশির ভাগ লোকজন বাড়ি ছেঁড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
কৈয়ারবিল ইউপি চেয়ারম্যান মক্কি ইকবাল হোছেন জানান, টানা বৃষ্টিতে কৈয়ারবিলের বেশীরভাগ এলাকা পানিতে তলিযে গেছে। ইউনিয়েনের খিলছাদক, ভরন্যারচর, বানিয়ারকুম গ্রামের মানুষ পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে ।
চকরিয়া পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুজিবুল হক জানান, টানা বৃষ্টিতে এই ওয়ার্ডের শতাধিক পরিবার জলাবদ্ধতার কাছে জিন্মি হয়ে পড়েছে । মাতামুহুরী নদীর পানি ইতিমধ্যে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে । এইভাবে বৃষ্টি ও পাহাড় থেকে পানি আসলে চকরিয়া শহরক্ষাবাধঁ হুমকির মূখে হতে পারে। এতে এই এলাকাসহ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহের সম্ভবনা রয়েছে।
চকরিয়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র বশিরুল আইয়ুব, ১নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মকছুদুল হক মধু ও ২নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজাউল করিম জানিয়েছেন, তিনদিনের ভারী বর্ষণে এবং মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারনে তাদের এলাকার অন্তত ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জনসাধারণ গত দুইদিন ধরে বাড়ির রান্নাঘরে আগুন জ¦ালাতে পারছেনা। এ অবস্থার কারনে অনেক পরিবার উপোষ থাকছে।
লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার বলেন, তার ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুর্গত এলাকার লোকজনের মাঝে খিচুড়ী বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলার পুর্ববড় ভেওলা ইউনিয়নে দুর্গত জনপদের কয়েক হাজার পরিবারের মাঝে নিজের অর্থায়নে খিচুড়ি তৈরী করে বিতরণ করেছেন আওয়ামীলীগ নেতা খলিল উল্লাহ চৌধুরী।
তিনি বলেন, এলাকার জনপ্রতিনিধিরা সরকারি বরাদ্ধের দিকে চেয়ে থাকলেও আমি জনগনের বিপদের সময় দুর্ভোগ দেখে ব্যক্তিগত ভাবে তাদের মুখে সামান্য খাবার তুলে দিতে চেষ্ঠা করেছি।
জানা গেছে, গত রবিবার থেকে চকরিয়া, পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা ও আলীকদমে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। এই বৃষ্টির পানি রাতের দিকে মাতামুহুরী নদী দিয়ে নেমে আসে। এসময় নদীর দু’কুল উপচিয়ে সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, সাহারবিল, চিরিংগা, কৈয়ারবিল ও পৌরসভার একাংশসহ বেশ ক’টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায় ।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম জানান, বন্যা মোকাবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। শুকনো খাবারের চাহিদা চেয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে দূর্যোগ মোবাবেলায় বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের লোকজন সর্বাক্ষণিক নজর রাখছে।
বন্যা পরিস্থিতি ও বেড়িবাঁধ পরিদর্শনে এমপি ও পাউবো
———————————-
চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় তিনদিনের টানা ভারী বৃষ্টিপাত ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটেছে। এ অবস্থার কারনে দুই উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার এলাকার অন্তত ৪লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
মঙ্গলবারও সারাদিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার কারনে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমা ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থায় দুই উপজেলার হাজার হাজার পরিবার পানিতে ভাসছে। পাশাপাশি নদীর পানির গতিবেগ প্রবল হওয়ার কারনে চরম ঝুঁিকর মধ্যে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেশির ভাগ বেড়িবাঁধ।
ফলে দুর্গত এলাকার এসব বেড়িবাঁধ ও বন্যা পরিস্থিতি দেখতে মঙ্গলবার সরেজমিন পরির্দশন করেছেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ ইলিয়াছ ও কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সবিবুর রহমান।
পরির্দশনকালে উপস্থিত ছিলেন পাউবো’র উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ইমান আলী, শাখা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী, তারেক বিন সগীর, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এমপির ব্যক্তিগত সহকারি নাজিম উদ্দিন।
দুর্গত এলাকা পরির্দশন শেষে হাজি মোহাম্মদ ইলিয়াছ সাংবাদিকদের বলেন, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটেছে। হাজার হাজার পরিবার পানিতে ভাসছে। বসতঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ পরিবার রান্নাঘরে আগুন দিতে পারছেনা। এ অবস্থায় দুর্গত জনপদের মানুষ না খেয়ে অনাহারে মানবেতর দিনযাপন করছে।
এমপি ইলিয়াছ জরুরী ভিত্তিতে দুর্গত মানুষের জন্য সরকারি ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রশাসনের কাছে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষনার দাবি জানিয়েছেন।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সবিবুর রহমান বলেন, তিনদিনের টানা ভারী বর্ষণ এবং মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারনে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বেশির ভাগ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বর্তমানে নদীর পানি প্রবাহের গতিবেগ প্রবল হওয়ায় দুই উপজেলার একাধিক স্থানে বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁিকর মধ্যে রয়েছে। তবে বন্যার পানি না নামা পর্যন্ত বেড়িবাঁেধর কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছেনা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দুর্গত এলাকায় সার্বক্ষনিক নজরদারিতে রয়েছে।
Posted ১১:৫৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৪ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta