কক্সবাংলা ডটকম(৭ সেপ্টেম্বর) :: দেশের চালের বাজার আবারও টালমাটাল। এক লাফে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা।
আর পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালে দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। অথচ এবারের বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে, তাই ধানের কোনো সংকটও নেই দেশে। তবুও চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে।
এ দফায় চালের দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা অজুহাত দেখাচ্ছেন দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যা এবং বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ হিসেবে চাল দেওয়াকে।
তাদের যুক্তি-সরকারিভাবে, বিভিন্ন সামাজিক ও দাতব্য সংস্থার উদ্যোগে এবং ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে বন্যার্তদের মাঝে প্রচুর চাল দেওয়া হচ্ছে।
এতে বাজারে চালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তার প্রভাবও পড়েছে চালের দামে।
তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ব্যবসায়ীদের খোঁড়া অজুহাত। এখন চালের দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিই দায়ী।
এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘বিগত ১৬ বছর ধরে মুনাফার নামে ব্যবসায়ীরা যেভাবে লুটপাট করেছে, সে অভ্যাস তো এখনও বদলায়নি ব্যবসায়ীদের।
সেই লুটপাটের মনোভাবেই এখন চালের দাম একবারে কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা চালের দাম বৃদ্ধির জন্য বন্যা ও ত্রাণের অজুহাত দিচ্ছেন।
কিন্তু এটা যে তাদের খোঁড়া অজুহাত তার প্রমাণ-বন্যা হচ্ছে কিন্তু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। ওই অঞ্চলে কিন্তু ধান-চালের চাতাল খুব বেশি নেই, যে বন্যার কারণে চাল উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হবে।
দেশের সিংহভাগ ধান-চালের চাতাল দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। সেদিকে তো আর বন্যা হয়নি। তাহলে বন্যার অজুহাত কেন দেওয়া হচ্ছে।
আবার ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রমে প্রচুর চাল দেওয়া হচ্ছে। এতে বাজারে চালের সংকট তৈরি হওয়ায় দাম বেড়েছে। আসলে এগুলো ব্যবসায়ীদের খোঁড়া অজুহাত। চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে এগুলো কোনো কারণ না, দাম বাড়ছে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে।’
রাজধানীর ঢাকার বাজারে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা। বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা, যা সপ্তাহ খানেক আগে ছিল ৫০ থেকে ৫২ টাকা। মাঝারি চাল ৫৮ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া মানভেদে সরু চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে। যেমন মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়, নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়। অর্থাৎ চিকন-মোটা সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা ও জননী রাইস এজেন্সির ম্যানেজার কবীর হোসেন বলেন, ‘মিল বা চাতাল পর্যায়েই বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৫০ টাকার বেশি।সেখান থেকে পাইকারি বাজারে এসে বাড়ছে বস্তায় আরও ১০০ টাকা।
এভাবে বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়ে গেছে চালের দাম। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। হঠাৎই চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরাও বিপাকে পড়েছি। ক্রেতারা এসে যত রাগ-ক্ষোভ ঝাড়ছেন আমাদের ওপরে। কিন্তু আমরা কী করব? আমাদের তো বেশি দামে কিনে আনতে হচ্ছে।’
এদিকে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে সরু চাল (মিনিকেট) ৪.৩৫ শতাংশ, মাঝারি চাল ২.৬৮ শতাংশ এবং মোটা চাল ২.৮৮ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
চালের জোগানের অন্যতম বড় জেলা কুষ্টিয়া। চালের দাম বাড়ার বিষয়ে বাংলাদেশ অটো রাইস মেজর ও হাস্কিং মিল মালিক সমিতির কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবদিন সময়ের আলোকে বলেন, ‘চালের দাম বেড়েছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এখন দাম বৃদ্ধির জন্য মূলত দুটি প্রধান কারণ রয়েছে।
প্রথমত বাজারে ধানের দাম বেড়েছে মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। কিছু দিন আগে প্রতি মণ ধান আমরা ১ হাজার ২৮০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় কিনতে পেরেছি, এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। এ ছাড়া চলমান বন্যার প্রভাবেও চালের দাম বেড়েছে। তবে আমরা আশা করছি চালের দাম কমে আসবে আগামী সপ্তাহে।’
নওগাঁয় বেড়েছে চালের দাম
নওগাঁর খুচরা বাজার ঘুরে জানা যায়, স্বর্ণা-৫ মোটা জাতের চাল এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৭ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। কাটারি জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকায়, জিরা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৪ টাকায়, যা আগে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায় এবং ৪৯ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকায়, যা আগে বিক্রি হয়েছে ৫৪ টাকায়।
প্রতি বছর এ সময়ে ধান এবং চালের বাজার ঊর্ধ্বগতি হয়। মৌসুমে ধান কাটা-মাড়াই অনেক আগেই শেষ হয়েছে। বড় জোতদার কৃষকদের ঘরে কিছু ধান রয়েছে। হাট-বাজারে ধানের সরবরাহ কম হওয়ায় প্রতি মণ ধানে বেড়েছে ১০০ টাকা। স্বর্ণা-৫ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে মনে ১ হাজার ৩৬০ টাকা থেকে ১ হাজার ৩৮০ টাকা। ধানের দাম বাড়ার অজুহাতের প্রভাব পড়েছে চালের বাজারেও। পাইকারি মোকামে প্রকারভেদে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ১০০-১৫০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়ে স্বর্ণা-৫ চাল ৪৮-৫০ টাকা কেজি, জিরাশাইল ৬২-৬৪ টাকা এবং কাটারিভোগ ৬৬-৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়ার কথা স্বীকার করে নওগাঁ পৌর খুচরা বাজারের সাধারণ সম্পাদক উত্তম সরকার বলেন, পাইকারিতে চালের দাম বাড়লেও খুচরা বাজারে এখনো চালের দাম বাড়েনি। আমরা আগের দামেই চাল বিক্রি করছি। আমাদের কাছে যেসব চাল আছে তা অবিক্রীত। এসব চাল বিক্রি হলে পাইকারি মোকাম থেকে চাল কেনা হবে। সেসব চাল বাজারে এলে কিছুটা দাম বাড়বে।
নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, বর্তমানে কৃষকের ঘরে ধান নেই, ফলে হাটগুলোতে ধানের চাহিদার তুলনায় আমদানি কম। ফলে একটি মিল চালাতে যে পরিমাণ ধানের প্রয়োজন সেটি পাচ্ছেন না মিলাররা। অন্যদিকে পরিবহন শ্রমিক এবং বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। সব মিলিয়ে প্রভাব পড়েছে ধান-চালের দামে। প্রতি বছর এ মৌসুমে ধান-চালের দাম কিছুটা বাড়ে।
দিনাজপুরে বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত : দিনাজপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর রাজ্জাক জানান, দিনাজপুরে আবারও বেড়েছে চালের বাজার। গত সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত। আমনের মৌসুম শেষ হয়েছে মাত্র কদিন আগে। বাজারে ধানের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকা উচিত। কিন্তু মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে ধানের দাম বাড়ায় বেড়েছে চালের দাম। তবে বাজারে মোটা ধানের সরবরাহ একেবারে নেই বললেই চলে।
দিনাজপুর শহরের সবচেয়ে বড় চালের বাজার বাহাদুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে কেজিতে প্রকারভেদে ৩ থেকে ৫ টাকা করে মোটা ও মাঝারি ধরনের চালে। বর্তমান এ জেলার খুচরা বাজারে আটাইশ চাল প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯৫০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ২৭৫০ টাকা। মিনিকেট চাল প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৩০০ টাকা, গত সপ্তাহে ছিল ২ হাজার ৯০০ টাকা। মোটা গুটি স্বর্ণা চাল গত সপ্তাহে ছিল ২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকা। আর এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। তবে পাইকারি বাজারে ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত।
জেলা চাল কল মালিক গ্রুপের সভাপতি মো. মোছাদ্দেক হুসেন জানান, দিনাজপুরে মোটা ধানের আবাদ স্বাভাবিকভাবে কম হয়ে থাকে আর বর্তমানে সরকারের ধান সংগ্রহ অভিযান চলমান থাকায় বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ধানের বাজারজাত কম তাই চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরও জানান, ধানের বাজারের ওপর নির্ভর করে চালের দাম নির্ধারণ করা হয়। আর ধান না পাওয়া ও দাম বেশি হওয়ায় বাজারে চালের দাম বেশি বলে জানান এ মিল মালিক নেতা।
বন্যার অজুহাতে ঊর্ধ্বমুখী :
বন্যার অজুহাতে চট্টগ্রামের খুচরা ও পাইকারদের আড়তে চালের দাম বেড়েই চলেছে। মানভেদে ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজিতেই চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। তবে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকার মিল মালিক মোহাম্মদ আলী সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের কাছ থেকে পাইকারদের আড়তে সরবরাহ যায় চালের। আবার খুচরা পর্যায়েও চালের সরবরাহ যায়। কিন্তু শুক্রবারসহ গত দুদিনের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বলতে পারি চালের কোনো সংকট নেই। তাই কেন দাম বাড়ল বুঝতে পারছি না। আমাদের কাছ থেকে সস্তায় কিনে নিয়ে বড় বাজারের বিক্রেতারা বেশি দামে বিক্রি করছেন বলে আমরা খবর পেয়েছি।
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট কাঁচা বাজারের আরজু স্টোরে পাইকারি হারে চাল বিক্রি করা হয় খুচরা দোকানি ও ক্রেতাদের কাছে। দোকানের মালিক মাহবুবুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। ২৫ কেজির চালের বস্তা মানভেদে বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। ৫০ কেজির একই মানের চালের বস্তা মানভেদে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। প্রতি কেজিতেই চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা।
তিনি বলেন, রহমান কাটারি নামে পরিচিত পাইজার প্রতি ২৫ কেজির চালের বস্তা গত সপ্তাহেও ১ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়। গেল এক সপ্তাহ ধরে একই মানের চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯৫০ টাকা। একই মানের চালের ৫০ কেজির বস্তায় আগের চেয়ে অন্তত ২৫০ টাকা দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে।
কুষ্টিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাজী মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যা বাড়ার দুই থেকে তিন দিন আগে থেকে পাইজাম চালের দাম ১ হাজার ৩৮৫ টাকা এবং এসিআই কোম্পানির ১ হাজার ৩৮৫ টাকা এবং বন্যার কারণে ধানের দাম বেশি। এ কারণে চালের দামটাও বেশি হচ্ছে। কোম্পানিগুলো ওই চালের দাম ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৪৬০ টাকা রাখছে।
Posted ৩:২১ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta