কক্সবাংলা ডটকম(১৭ জুন) :: সরকারি গুদামে চালের মজুদ তলানিতে নেমেছে। পর্যায়ক্রমে কমতে কমতে মজুদ এখন মাত্র ১ লাখ ৯১ হাজার টন। মজুদ না থাকায় সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। বর্তমানে ওএমএস বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বিভিন্ন অজুহাতে ঘন ঘন দাম বাড়াচ্ছেন। চালের দাম বাড়তে বাড়তে এযাবৎকালের রেকর্ড দরে বিক্রি হচ্ছে। মোটা চালের দাম এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। এতে করে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে সবচেয়ে বিপাকে। তাদের আয়ের বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে চাল কিনতে।
এদিকে বোরো মৌসুমে ধানের মিলগুলোতে পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। মিল মালিকরা দাবি করছেন, হাওরে বন্যা ও অন্য এলাকায় ব্লাস্ট রোগের কারণে বোরো উৎপাদন কম হওয়ায় ধানের দাম বেড়েছে। এ কারণে বাড়তি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার বোরোর উৎপাদন কমবে মাত্র সাড়ে ৭ লাখ টন। এ কারণে চালের বাজারে সংকট হওয়ার কথা নয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল রয়েছে মাত্র ১ লাখ ৯১ হাজার টন। ২০১১-১২ অর্থবছরের একই সময়ে চালের মজুদ ছিল ৯ লাখ ৯৮ হাজার টন।
২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ৬ লাখ ৯৯ হাজার টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল ৬ লাখ ৫৮ হাজার টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই সময়ে ছিল ৬ লাখ ৯৬ হাজার টন। এবারই প্রথম চালের মজুদ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে থেকে নজরদারি না থাকায় চালের মজুদ পর্যাপ্ত রাখতে পারেনি সরকার। এ কারণে গত দুই মাস চালের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকারের সংস্থাগুলো। ফলে চাল কিনতে চড়া দাম দিতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বর্তমানে বাজারে সর্বনিম্ন দামে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়। মাঝারি মানের চাল বিআর আটাশ ও লতা ৫১ থেকে ৫২ টাকা ও পাইজাম ৫০ থেকে ৫১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চাল মিনিকেট ও নাজিরশাইলের কেজি এখন ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা। তবে ভালো মানের নাজির ৬০ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া আতপ চাল এখন কেজি ৫০ টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। সরু চালের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।
চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী স্বীকার করে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দাম বৃদ্ধির পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, মিল মালিক, মজুতদার কারসাজি করে চালের দাম অতিরিক্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশে এখন চালের সংকট নেই। এর জন্য দায়ী অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার চাল আমদানি করছে। খুব দ্রুত চালের দাম কমবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
বিআইডিএসের সম্মাননীয় ফেলো, কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান মনে করেন, সরকারের মজুদ তলানিতে নেমে যাওয়াই চালের বাজারের অস্থিরতার মূল কারণ।
তিনি বলেন, চালের উৎপাদন খুব একটা কমেনি। এ ছাড়া বেসরকারি খাতেও কিছু আমদানি হয়েছে। সুতরাং মিল মালিক কিংবা অন্যান্য পর্যায়ে চালের সংকট আছে বলে মনে হয় না। কৃত্রিম মজুদ হচ্ছে কি-না তা এখনই খতিয়ে দেখা উচিত।
তিনি বলেন, চালের বাজারে জরুরি অবস্থা চলছে। কিন্তু সরকার কেন এ পরিস্থিতি মেনে নিচ্ছে তা বোধগম্য নয়। দুই মাস আগে যখন সাড়ে তিন লাখ টন মজুদ ছিল, তখনই দ্রুত ব্যবস্থা নিলে এখন এ অবস্থা হতো না। এখনও সময় আছে, সরকারের উচিত জরুরিভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে সমস্যার বাস্তব সমাধান করা। বাজার থেকে কারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে, মিল মালিকদের কাছে কতটুকু চাল আছে এবং কেউ কারসাজি করছে কি-না এসব বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করা উচিত। অবশ্য সরকার দ্রুত চালের বাজার নজরদারিতে নামবে বলে জানা গেছে।
ড. আসাদুজ্জামান মনে করেন, চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে অন্তত ১০ শতাংশ কমালেও বাজারে দাম কমানো যাবে। বর্তমানে যে শুল্ক রয়েছে তাতে ভারত থেকে এনে এবং পরিবহন খরচ মিলিয়ে ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা পড়ে যায়। সরকারের উচিত শুল্ক কমানো। মোট কথা চালের বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীদের কারসাজি ঠেকাতে সরকারের আগেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। এবার বোরো মৌসুমে ব্লাস্ট ও হাওরে বন্যায় ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। এ বিষয়টি আগে থেকেই গুরুত্ব দিলে এখন মজুদ পরিস্থিতি এমন হতো না। সরকারের গুদামে চালের মজুদ সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসেছে। ব্যবসায়ীদেরও কারসাজি রয়েছে। তারা চাল সংগ্রহ বন্ধ রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আমদানি করে ঘাটতি মেটাতে হবে। সরকার ১০ লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে আড়াই লাখ টন আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে এটা অনেক দীর্ঘ মেয়াদে। এতে অনেক সময় লাগবে। এখন অস্থির বাজার স্বাভাবিক করতে ভারতসহ যে কোনো দেশ থেকে হোক অতি দ্রুত চাল আমদানি করতে হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যা বাজারে ছাড়া সম্ভব হয়।
গোলাম রহমান বলেন, সরকারের এখন অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের জন্য মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল কেনা বন্ধ ঘোষণা করা উচিত। একই সঙ্গে মিল মালিকদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধে চাপ দিলে বাজারে পর্যাপ্ত চাল আসবে। এতে দাম কমে যাবে। তবে তিনি বলেন, চালের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে রাখতে হবে। যাতে কৃষক ও ক্রেতা উভয়ে বাঁচে।
ব্যবসায়ীরা যা বলেন :
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. ইউনুস বলেন, সরকারের গুদামে মজুদ কম রয়েছে। এতে ১৫ টাকা কেজিতে সাধারণ মানুষ চাল পাচ্ছে না। এ কারণে মিলগুলো বাড়তি দামে চাল বিক্রির সুযোগ পেয়েছে। ফলে দুই মাস ধরে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে চালের দাম। এই সময়ে ক্রমান্বয়ে কেজিতে চালের মানভেদে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
গত দুই মাসে শুধু খুচরা নয়, পাইকারি ও মিল গেট সব পর্যায়ে একই হারে দাম বেড়েছে বলে জানান মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মো. স্বপন। তিনি বলেন, মৌসুমের আগে চালের দাম প্রতি বছর বাড়লেও এই সময়ে এসে কমে যায়। কিন্তু এবার চড়া দামেই বেচাকেনা হচ্ছে। এই দাম বৃদ্ধির পেছনে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কিছু করার নেই। তা নির্ভর করে মিল মালিকদের ওপর।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, চালের দাম ওঠানামার ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। মিল থেকে কেনা দামের সঙ্গে প্রতি কেজিতে ১ টাকা পরিবহন ব্যয় ও ১ টাকা অন্যান্য খরচ ধরা হয়। এর পরে ৫০ কেজির বস্তায় ১৫ থেকে ২০ টাকা লাভে বিক্রি করেন তারা। এতে মোটা চাল পাইকারিতে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন।
দর এখনই সর্বোচ্চ :
বাজারে চালের দর এখনই সবচেয়ে বেশি। এর আগে ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে দেশে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকায় উঠেছিল। তখন সরু চালের কেজি হয়েছিল ৫৬ টাকা। স্বাধীনতার পর তখন ছিল চালের সর্বোচ্চ দর। এবার সে দর ছাড়িয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম ওঠানামা করলেও চালের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। মোটা চালের কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, আর সরু চাল ৪৫ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে ছিল। এই সময়ে চালের মজুদ ভালো ছিল। কিন্তু এখন সরকারের চালের মজুদ কমে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংগ্রহ পরিস্থিতি :
এবারের বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৮ লাখ টন নির্ধারণ করেছে সরকার। প্রতি কেজি ধান ২৪ টাকা ও চাল ৩৪ টাকায় কিনছে। কিন্তু মিল মালিকরা সাড়া না দেওয়ায় গত এক মাসে চাল সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২৫ হাজার ৬২৫ টন। হাওর এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার চালের উৎপাদন কম হবে। অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে সরকার চেয়েছিল চাল আমদানি করে মজুদ বাড়াতে। কিন্তু সেখানেও হোঁচট খেয়েছে সরকার। বিশ্ববাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে চাল আমদানি কার্যক্রম। সরকার যে আড়াই লাখ টন আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা আসতে আরও ১ মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, হাওর এলাকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের দুটি অঞ্চলে প্রচুর ত্রাণসামগ্রী এবং বিনামূল্যে চাল দিতে হচ্ছে। সংকটের কারণে বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর এ সময় চালের বাজারে চড়া মূল্যের কারণে খাদ্য অধিদপ্তর ঢাকাসহ সারাদেশে ১৫ টাকা কেজি দরে ওএমএসের চাল বিক্রি করে। চালের মজুদ কম থাকায় বন্ধ রয়েছে ওএমএস কার্যক্রমও। ফলে গরিব মানুষ সরকারের কম দামের চালের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
মিল মালিকদের বক্তব্য :
বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, সরকারের গুদামে মজুদের সঙ্গে বাজার দামের কোনো সম্পর্ক নেই। ১৫ টাকা কেজি দরে সামান্য চাল বিক্রি করে বাজার দামে তেমন হেরফের হয় না। কিন্তু এবার ধান উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেড়েছে। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে মিল মালিকদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। তিনি বলেন, সরকার বা মিল মালিক ইচ্ছা করলে বাজার দাম হেরফের করতে পারে না।
মিল মালিকরা বলেন, এখন মোটা চালের বস্তা ১৯৫০ টাকা। এতে প্রতি কেজি ৩৯ টাকা পড়ে। ধানের দাম বৃদ্ধির কারণে এই দাম বেড়েছে। এখন প্রতি মণ ধান ৯৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এর সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় ৮০ টাকা। প্রতি মণ ধানে ২৫ কেজি চাল পাওয়া যায়। এতে অবশ্য খুদ আর কুঁড়া থেকে উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশ উঠে আসে। মিল থেকে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪১ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
Posted ৩:২৮ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৭ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta