প্রায় একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছিল গত মাসেও। তাও আবার আগের বার শোরগোল তোলা দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শ্রীলংকা সফরের সময়। মোদি কলম্বো সফরে যান চলতি বছরের ১২ মে। সে সময়ও শ্রীলংকার বন্দরে নোঙর ফেলার অনুমতি চায় একটি চীনা সাবমেরিন। তবে এবার আর সে অনুমতি দেয়নি শ্রীলংকা। দিলে কলম্বো ঘিরে বড় ধরনের একটি কূটনৈতিক সংকট তৈরির আশঙ্কা ছিল। এ আশঙ্কাকে আপাতত কাটানো গেলেও চীনা ড্রাগন আর ভারতীয় হাতির রেষারেষির নতুন এক ময়দান হয়ে উঠেছে শ্রীলংকা। সিংহলিদের জন্য সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এ ড্রাগন-হাতির উন্নয়ন প্রতিযোগিতায় দেনায় ডুবতে বসেছে শ্রীলংকা।
নরেন্দ্র মোদির এবারের কলম্বো সফর ছিল শ্রীলংকার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে এপ্রিলে সিংহলি প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের দিল্লি সফরের সময় ভারত ও শ্রীলংকার মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ নিয়ে বেশকিছু সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এর মধ্যে শ্রীলংকার ত্রিঙ্কোমালিতে বন্দর উন্নয়ন, কেরাওয়ালাপাতিয়ায় ৫০০ মেগাওয়াটের তরলায়িত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) বিদ্যুেকন্দ্র ও এলএনজি টার্মিনাল/ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) স্থাপনসহ জ্বালানি ও সড়ক যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন নিয়ে স্বাক্ষরিত বেশকিছু চুক্তি উল্লেখযোগ্য।
বিক্রমাসিংহের দিল্লি সফরের পর মে মাসে কলম্বো সফরে যান মোদি। বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় বিভিন্ন কলামিস্ট ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্টদের বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে দেখা গেছে। সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম ‘ডেইলি ও’তে প্রকাশিত এক মতামতে দেশটির অবসরপ্রাপ্ত এক সামরিক কর্মকর্তা বিষয়টি বর্ণনা করেন ‘চীনা ড্রাগনের ভারতীয় হাতির পোর্ট কল টর্পেডোয় ডুবিয়ে দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস’ হিসেবে।
ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপনের কালে সমুদ্রপথের গুরুত্ব যে উচ্চতায় উঠে দাঁড়ায়, তা এখনো বিন্দুমাত্র কমেনি। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার গুরুত্ব বেশ অর্থবহ। সম্পদের ক্ষুধায় পৃথিবী দাবড়ে বেড়ানো চীন, ভারত ও জাপানসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর ব্যবহূত অন্যতম ব্যস্ত নৌপথের কেন্দ্রে রয়েছে শ্রীলংকা।
বিশেষ করে ভারতের জন্য শ্রীলংকার গুরুত্ব একটু বেশি। সমুদ্রপথে দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ১২ নটিক্যাল মাইল। বাণিজ্যিক দিক থেকে দেখতে গেলে, লংকাদ্বীপের বন্দরগুলোয় নোঙর ফেলা জাহাজগুলোর মধ্যে ভারতীয় জাহাজের পরিমাণ কখনো কখনো ৭৫ শতাংশেও উঠে দাঁড়ায়। সুতরাং লংকার সমুদ্রপথে যে দেশের আধিপত্য থাকবে, ভারতের সমুদ্রপথেও যথেচ্ছ প্রভাব ফেলার ক্ষমতাও সে দেশের হাতে থাকবে। আবার শ্রীলংকার জন্যও ভারতকে পাশে রাখা বেশ জরুরি।
শ্রীলংকার অর্থনীতিতে চীনা উপস্থিতি দিন দিন ভারতের জন্য বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের শাসনামল থেকেই দেশটির অর্থনীতিতে চীনা উপস্থিতি বেশ জোরালো হয়ে উঠতে থাকে, যার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো হামবানতোতা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। বন্দর স্থাপন ও উন্নয়ন ছাড়াও একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম, কয়েকশ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থায়ন হচ্ছে চীনা সরকারের ঋণ বা এফডিআই তহবিলের মাধ্যমে।
প্রাথমিকভাবে হামবানতোতা বন্দর প্রকল্পে ভারতের সহায়তা চেয়েছিল শ্রীলংকা। সে সময় এতে বিনিয়োগকে লাভজনক বলে মনে করেনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে দেখা গেল, প্রকল্পে বিনিয়োগ না করার ভারতীয় সিদ্ধান্তটি খুব অবিবেচনাপ্রসূত ছিল না। কারণ বর্তমানে এসে দেখা যাচ্ছে, গোটা প্রকল্পে সাফল্যের লেশমাত্র না থাকলেও তা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, এখান থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই।
প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ১৪০ কোটি ডলার। এত ব্যয় করে বন্দর নির্মাণ করা হলেও সেখানে জাহাজ ভিড়ছে খুব কমই। তার ওপর বন্দরের আয়ের সিংহভাগেই কোনো অধিকার নেই সিংহলিদের। ঋণ পরিশোধের ইচ্ছা থেকে বন্দরের মালিকানার প্রায় ৮০ শতাংশ এক চীনা প্রতিষ্ঠানকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় শ্রীলংকান সরকার। অন্যদিকে বন্দর নির্মাণে দেয়া ঋণের অর্থ তুলে নিতে না পারলেও এখান থেকে বেইজিংয়ের পিছু হটার সুযোগ নেই। কারণ মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের আমদানি করা জ্বালানি তেলবাহী জাহাজের নৌরুটের মধ্যে অবস্থিত শ্রীলংকা। আবার আঞ্চলিক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের জলসীমারও খুব কাছাকাছি। এ অবস্থায় নিজের জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য চীনের কাছে বন্দরটি তথা শ্রীলংকায় উপস্থিতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আবার চীনের উচ্চাভিলাষী ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডের’ মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সম্প্রসারণ প্রকল্পের সুরক্ষার জন্যও বন্দরটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে ঋণভারে বিপর্যস্ত শ্রীলংকার জন্য বন্দরটি এমন এক গলার কাঁটা হয়ে উঠছে, যাকে গেলাও যায় না, ফেলাও যায় না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নতুন এক প্রস্তাবনা দিয়েছে চীন। বন্দরটিকে কার্যকর করে তোলার জন্য নতুন এক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চাইছে দেশটি। এজন্য কলম্বোর কাছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ একর জমি চেয়েছে বেইজিং। এছাড়া চীনের অর্থায়নে কলম্বোয় ২৬৯ হেক্টর জমির ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে একটি ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট, যার ১১০ হেক্টরই সংরক্ষিত থাকবে চীনের জন্য। এছাড়া শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর জন্য কেনা অস্ত্রেরও সরবরাহদাতা চীন।
দেশটিতে চীনের এ শক্তিশালী উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই ভারতকে শঙ্কিত করে তুলছে। এর মধ্যে হামবানতোতা সে শঙ্কা আরো বাড়িয়ে তুলেছে, যার প্রকাশ পাওয়া যায় ভারতীয় এক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেলানির কণ্ঠেও। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘চীনা অর্থায়নের প্রকল্প থেকে ধীরে ধীরে চীনের মালিকানাধীন সম্পদ এবং ভারত মহাসাগরে চীনের ছিটমহল হয়ে উঠছে হামবানতোতা।’
এ অবস্থায় শ্রীলংকার কাছ থেকে ত্রিঙ্কোমালি বন্দরে যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাব আসা মাত্র লুফে নেয় ভারত। কলম্বোও ধরতে গেলে বন্দর উন্নয়নের পাশাপাশি কূটনৈতিক ভারসাম্য স্থাপনের উদ্দেশ্যেই এ প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবনায় ভারতের সম্মতির ধারাবাহিকতায় একযোগে বেশকিছু প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নেয় দুই দেশের সরকার। ভারতের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ভিত্তিতে ত্রিঙ্কোমালিতেই একটি চিনিকল স্থাপন হতে যাচ্ছে। এছাড়া ২০০৩ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী ত্রিঙ্কোমালির স্থানীয় এক অয়েল ট্যাংকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন।
এর পরও ডেইলি ও’তে প্রকাশিত নিবন্ধে ভারতীয় বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এসকে চ্যাটার্জি বলেন, শ্রীলংকার অর্থনীতিতে চীনের শিকড় এখন অনেক গভীরে জেঁকে বসেছে। এখানে বিনিয়োগের দিক থেকে বেইজিংয়ের সঙ্গে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না ভারত। সেক্ষেত্রে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ সম্ভব হলে এশিয়া প্যাসিফিকের আরো কয়েকটি দেশের সঙ্গে কনসোর্টিয়ামের ভিত্তিতে দ্বীপরাষ্ট্রটির বিনিয়োগ চাহিদা মেটানো (প্রকারান্তরে চীনকে এখান থেকে দূরে রাখা) সম্ভব।
দেউলিয়াত্বের শঙ্কায় শ্রীলংকা, সরকারও জানে না মোট ঋণ কত: সবমিলে ড্রাগন ও হাতিকে একসঙ্গে খুশি রাখতে গিয়ে বেশ বিপাকে রয়েছে ২৫ হাজার ৩৩২ বর্গমাইলের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা। এভাবে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে শ্রীলংকা একদিক থেকে ঋণে ডুবে যাচ্ছে, অন্যদিক থেকে নিজের সম্পদ তুলে দিতে হচ্ছে বিদেশীদের হাতে। ঋণ নিয়ে একের পর এক অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেশটিকে ঠেলে দিচ্ছে দেউলিয়াত্বের মুখে। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেলআউটও নিতে হয়েছে দেশটিকে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, শ্রীলংকায় মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে চীনের পাওনা ৮০০ কোটি ডলার। শ্রীলংকার মোট ঋণ জিডিপি অনুপাত এখন প্রায় ৭৫ শতাংশ। দেশটির মোট রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আয়ের ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশই ব্যয় হয় ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে। সবমিলে দেশটির ঋণ পরিস্থিতিকে মোটেও টেকসই বলে মনে করছেন না গবেষকরা।
এদিকে সাম্প্রতিক কিছু তথ্য-উপাত্তে বেরিয়ে আসে, সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের আমলে গতানুগতিক পন্থায় বিদেশী ঋণ নেয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকেও অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার কাজে ব্যবহার করেছে দেশটির সরকার, যার কোনো হিসাব দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছেও নেই। তবে এ ঋণের পরিমাণ ৯৫০ কোটি ডলারেরও বেশি বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। গত বছরের শেষ দিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা এখনো জানি না এ ঋণের মোট পরিমাণ কত।’
সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের নির্দেশনায় বেশকিছু ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেয় শ্রীলংকা, যার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে একের পর এক দেনায় ডুবতে থাকে দেশটি।
২০০৯-২০১৪ সালের মধ্যে শ্রীলংকার মোট সরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় তিন গুণ। এর মধ্যে বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ। হামবানতোতা বন্দর নির্মাণ ও বিভিন্ন সড়ক যোগাযোগ প্রকল্পসহ ব্যয়বহুল নানা প্রকল্প হাতে নিতে গিয়ে এ দুর্দশায় পড়েছে দেশটি।
অন্যদিকে দেশটির বর্তমান প্রশাসনও এক্ষেত্রে খুব একটা ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারছে না। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাইত্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশটির অভ্যন্তরীণ ঋণ বেড়েছিল ১২ শতাংশ। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল ২৫ শতাংশ। অথচ এ সময়ের মধ্যে বড় কোনো অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়নি শ্রীলংকা সরকার।
শ্রীলংকা বর্তমানে বেশ বড় ধরনের ঋণজালে আবদ্ধ রয়েছে। চলতি বছরের মধ্যেই দেশটির বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করার কথা কমপক্ষে ৪০০ কোটি ডলার। এ ঋণ শোধ করতে গিয়ে আরো নতুন ঋণে জড়িয়ে যাচ্ছে দেশটি। এর উদাহরণ হলো, গত বছরের এপ্রিলে নতুন ঋণ হিসাবে শর্তসাপেক্ষে ১৫০ কোটি ডলারের একটি বেলআউট দিতে রাজি হয় আইএমএফ। ওই সময় এ তহবিল গ্রহণের পর আরো ৫০০ কোটি ডলারের ঋণ নিশ্চিতের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক।