কক্সবাংলা ডটকম(১০ জানুয়ারি) :: চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের প্রথমার্ধের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে সার্বিক কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, চলতি বছরের শেষ দিকেও নির্বাচন করা যেতে পারে এমন প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন।
এ ক্ষেত্রে চলতি বছর নির্বাচন না হলেও এ বছরই রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথনকশা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্যে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে গত বুধবার জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতিও অন্তর্বর্তী সরকার নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ঢাকা সফররত ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরতে গিয়ে এ কথা বলেন।
অপরদিকে অনতিবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবিতে মাঠে নামছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করে আগামী জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।
এরই মধ্যে বাম গণতান্ত্রিক জোট, সমমনা দল, ১২ দলীয় জোটকে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামতে দেখা গেছে। রাজপথে না নামলেও দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পক্ষে গণফোরাম ও গণতন্ত্র মঞ্চ।
এই দলগুলোর নেতৃত্বের ভাষ্য, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না করলে সরকারের প্রতি জনগণের সন্দেহ ও অবিশ^াস তৈরি হবে। কেউ কেউ আবার কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, সরকারের সংস্কারকাজ করার যোগ্যতা নেই। সে কারণে অনতিবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার তাগাদা দেন তারা।
জানা গেছে, এসব দলগুলোর মধ্যে বিএনপির একটা যোগসূত্র রয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন ইস্যুতে এসব দলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে দলটির। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সন্ধ্যায় এলডিপির সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হয়েছে।
এর বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাসহ আরও কিছু ইসলামি দল ও সংগঠন সংস্কার শেষে উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনের পক্ষে। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে তাদের তাড়াহুড়া নেই। তারা মনে করেন, দেশে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না।
এই প্রসঙ্গে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি বেশি সংস্কার না চায়, তাহালে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী স্বৈরাচারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দোসরদের গ্রেপ্তার এবং বিচার দাবি’ শীর্ষক সমাবেশে ১২ দলীয় জোটের নেতারা বক্তৃতা করেন।
জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো কিছুই সমাধান করতে পারছেন না। সংস্কার করার যোগ্যতা এই সরকারের নেই।
সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘অবিলম্বে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করুন। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সসম্মানে বিদায় নিন।’ এ সময় তিনি সহনীয় মূল্যে গ্যাস সরবরাহ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমাতে সরকারের পদক্ষেপ চান।
সমাবেশে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘জনগণ যা চায় তা বুঝে অবিলম্বে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যেই নির্বাচন দিন। ভোটারের বয়স ১৭ এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স করতে চান ২১ বছর।
দুটোই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা বলব, দেশে কচিকাঁচার সংসদ গড়বেন না। আপনাদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। পাঁচ মাস ধরে কিছুই করতে পারছেন না। আইনশৃঙ্খলা, নিত্যপণ্যের বাজার- কোথাও শৃঙ্খলা আনতে পারছেন না। আমাদের মাঠে নামতে বাধ্য করবেন না।’
জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। কিন্তু আজ পাঁচ মাস হয়ে গেলেও সরকার কিছুই করতে পারেনি। আমি বলব, টালবাহানা না করে অবিলম্বে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।’
জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিমের সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মুহাম্মদ ফারুক রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল করিম, সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা শওকত আমিন, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম, নয়া গণতান্ত্রিক পার্টির এমএ মান্নান, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দলের (পিএনপি) ফিরোজ মো. লিটন এবং লেবার পার্টির মহাসচিব আমিনুল ইসলাম।
এর আগে গত ১ জানুয়ারি লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই সরকার (অন্তর্বর্তী) কী সংস্কার করবে, তা আমরা বুঝতে পারছি। সচিবলায়ে কারা আগুন লাগিয়েছে? সেই ফ্যাসিবাদী দোসরদের তো আপনারা (সরকার) সরাতে পারছেন না। আপনারা করবেন সংস্কার? সংস্কার তো নিয়মিত প্রক্রিয়া। আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে, আপনাদের বিপক্ষে না। তবে আপনাদের আগামী জুন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যে সংস্কারের কথা বর্তমান সরকার বলছে, সেই সংস্কার একমাত্র জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই করতে পারে। সবাই সংস্কার চায়। কিন্তু কেউ বলছে না নির্বাচন ছাড়া সংস্কার কীভাবে সম্ভব? সংস্কার কি নির্বাচন ব্যতিরেকে? বর্তমানে যেহেতু সংবিধান বেঁচে আছে, তার অনুযায়ী নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।’
এ বিষয়ে কথা হলে বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ইতোমধ্যে সিপিবি জনসভা করেছে। সভা থেকে দাবি জানানো হয়েছে আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার। আগামী ২১ তারিখ থেকে শুরু করে ২৭ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশে গণতন্ত্র অভিযাত্রা।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে মাঠে আছি। বাম জোট কথা বলতেছে। আমরা তো আগেই বলছি, অন্যসব কাজ করা যাবে না, আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘নির্বাচন আমাদের জেনারেল ডিমান্ড। আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে এ বছরের কবে নির্বাচন করতে চান সেই তারিখ ঘোষণা করা।
এর জন্য রাজপথে কর্মসূচি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এখনও মনে করছি না। ইতোমধ্যে রিফর্মের যে আলোচনাগুলো চলছে তা দ্রুত একটা পর্যায় নিয়ে আসা, একটা জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা এবং সেই ভিত্তিতেই আমরা মনে করি এ বছরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।’
গণফোরামের নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী আমাদের সময়কে জানান, তারাও দ্রুত নির্বাচন চান এবং এ বিষয়ে তারা তাদের সমমনা দল নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে আসবেন।
দ্রুততম সময়ে নির্বাচিত সরকার গঠন করার দাবিতে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে আছে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বাধীন সমমনা জোট।
এনপিপির চেয়ারম্যান ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ দ্রুত ঘোষণা করে অচিরেই নির্বাচন সম্পন্ন করার দাবিতে মাঠে আছেন বলে আমাদের সময়কে জানিয়েছেন।
জনগণ যেমন তাদের প্রতিনিধির হাতে দেশের শাসনভার তুলে দিতে চায়, তেমনি কোনো সংস্কার সংশোধন ছাড়াই তড়িঘড়ি করে কেবল নির্বাচন দেশের মানুষ চায় না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের ভাষ্য, শুধু একটি নির্বাচনের জন্যই এত মানুষ রক্ত দেয়নি। তারা আমূল সংস্কার শেষে যথাসময়ে নির্বাচন চায়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করীম বলেন, দেশে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না।
তিনি বলেন, মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে দেশে যাতে আর কেউ নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করতে না পারে। নতুন করে পেশিশক্তি দিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচন আয়োজন করে পার পাওয়া তো দূরের কথা, সাহসও যাতে না পায়- তেমন সংস্কার জনগণ চায়। দলের সিনিয়র নায়েবে আমিরের এমন বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচন নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কোনো তাড়াহুড়া নেই।
গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনে অংশ নিয়ে শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘আমাদের এই সরকার খুবই স্বল্পকালীন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগামী বছরই (২০২৫ সাল) আমরা একটি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেখব। জানি না কী হবে।’
Posted ৩:০২ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta