কক্সবাংলা ডটকম(৬ ডিসেম্বর) :: বিদ্যমান সংকট নিরসনে দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের আলোচনা জোরালো হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে কয়েকটি দল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রস্তাব তুলে ধরেছেন।
তাদের মতে, নির্বাচনের আগেই জাতীয় সরকার গঠন হতে পারে। যদিও বড় দল বিএনপি চাইছে নির্বাচনের পরে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে। তাদের চাওয়া দ্রুত নির্বাচন। এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে এখনও কিছু স্পষ্ট করা হয়নি।
জাতীয় সরকারের ধারণাটি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি প্রস্তাব দেন, দীর্ঘদিন যারা হাসিনাবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন তাদের নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠন হবে। অর্থাৎ বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারা জাতীয় সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করবে।
সেপ্টেম্বরের এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর একটি জাতীয় সরকারের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসায় দেশ প্রথম দিন থেকেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে একটি বিরাট অংশ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশ গঠনে কোনো অবদান রাখতে পারেনি।
স্বাধীনতার পরপর জাতীয় ঐক্যের শক্তিকে ব্যবহার না করে সেদিন যে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে আগামী দিনে আমরা তার পুনরাবৃত্তি চাই না।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানে দেশছাড়া হওয়ার পর ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। চার মাসের মাথায় এসে সরকার দেশি-বিদেশি নানা সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনেকটা বেকায়দায় সরকার।
প্রথম থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। সব মত ও আদর্শকে ভারত বিরাজমান সংকট নিরসনে জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক হয়।
বুধবার হয়েছে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা বসেন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে। রাজনৈতিক দলের সংলাপে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর জাতীয় সরকারের প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন, সামনে আরও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে।
এগুলো মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তাব ছিল, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশীজনদের নিয়ে আগামী দুই বছরের জন্য জাতীয় সরকার গঠন করা উচিত।
এ বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, আমরা চাই ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে জাতীয় সরকার হোক। কেননা এ সরকার এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না। আবার কবে নির্বাচন দেবে কিংবা কতদিন ক্ষমতায় থাকবে তাও স্পষ্ট করছে না। তাই যারা দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও রাজনীতে যাদের গুরুত্ব আছে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। তাদের সমন্বয়ে দেশ পরিচালিত হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সরকারের প্রধান হবেন। বাকি উপদেষ্টারাও এই জাতীয় সরকারের থাকতে পারেন।
ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় সরকারের কথা বলে আসছি। ঐক্য মজবুত করতেই জাতীয় সরকার প্রয়োজন। জাতীয় সরকার থাকলে দেশদ্রোহীদের মিশন সফল হবে না। সব নিবন্ধিত এবং প্রতিনিধিত্বশীল আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে জাতীয় সরকার। সম্মিলিত সিদ্ধান্তের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের লোকজনও এখানে থাকতে পারে।
এটি নির্বাচনের আগেও হতে পারে আবার নির্বাচনের পরেও হতে পারে। এখন যেহেতু একটি সংকট চলছে সবার সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় সরকার করলে মন্দ হবে না। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও বিশিষ্টজনের মতামতও নেওয়া যেতে পারে। এ জন্য নির্বাচন একটু দেরি হতে পারে। আমরা তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পক্ষে নই। দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে একটু সময় তো দিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণতন্ত্র মঞ্চের একজন নেতা বলেন, দেশের বিদ্যমান সংকট নিরসনে জাতীয় সরকার গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। ঐক্য গঠনে এটি একটি ভিত্তি হতে পারে। এতে সংস্কার কাজও সহজ হবে। এ বিষয়ে ঐকমত্য জরুরি। জাতীয় সরকার হলে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
তিনি বলেন, সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই জাতীয় সরকারের দাবি সামনে আসছে। যে গতিতে এ সরকার এগোচ্ছে এতে সংস্কারকাজ শেষ করতে অনেক সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনি রোডম্যাপ দেওয়ারও কোনো আলামত চোখে পড়ছে না। অনির্বাচিত সরকার যত ক্ষমতায় থাকবে দেশি-বিদেশি নানা সংকট তৈরি হবে। এগুলো মোকাবিলায় জাতীয় সরকার দরকার।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, জাতীয় সরকার নিয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এখনও এ বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়নি। আমরা মনে করি, ভারতীয় অপ্রচাররোধে আমাদের জাতীয় ঐক্য দরকার। এ ঐক্য গড়ে তুলতে সব পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা এ মুহূর্তে জাতীয় রাজনৈতিক কাউন্সিল করার কথা গুরুত্ব দিয়ে বলেছি।
যদিও বিএনপি মনে করছে জাতীয় সরকারের চেয়ে এখন জাতীয় নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, বিগত ১৫-২০ বছর বা দুই দশক ধরে আমাদের নতুন প্রজন্মের কেউ ভোট দিতে পারেনি। তাদের ভোটাধিকার দ্রুত ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই জাতীয় নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের পর বিএনপি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের পক্ষে। আমরা বিষয়টি আগেই পরিষ্কার করেছি।
আর জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, আমরা জাতীয় ঐক্য নিয়ে কাজ করছি। এ মুহূর্তে জাতীয় সরকার নিয়ে দলের কোনো পর্যবেক্ষণ আমার জানা নেই।
বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সরকারের ধারণাটি আসে ১৯৭১ সালে। সে সময় আওয়ামী লীগের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের দাবি ছিল সব দলকে নিয়েই সরকার গঠন করা হোক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সেই দাবি মেনে নেয়নি, তারা এককভাবে সরকার গঠন করে।
স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনের প্রথম দাবি উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। আওয়ামী লীগ সে দাবি গ্রাহ্য করেনি।
Posted ২:৩৭ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta