কক্সবাংলা ডটকম(১৫ জুলাই) :: বাংলাদেশের রাজনীতির একটা দুর্ভাগ্যজনক দিক হলো, স্বাধীনতা লাভের ছেচল্লিশ বছর পরও এই রাজনীতি সুস্থ গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ষড়যন্ত্র, গোপন তত্পরতা এই রাজনীতিতে লেগেই আছে। যখনই দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় আসে তখনই নির্বাচনের সাধারণ প্রস্তুতির আড়ালে গোপন তত্পরতা ও ষড়যন্ত্র বেড়ে যায়। আরেকটি সাধারণ নির্বাচন এখন সামনে। যথা নিয়মে এই গোপন তত্পরতা শুরু হয়ে গেছে।
নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটও। তাতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কারণ নেই। বরং সমর্থন থাকবে। গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ীই প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর এই নির্বাচন প্রস্তুতি। কিন্তু এই প্রকাশ্য প্রস্তুতির আড়ালে যদি কোনো পক্ষের কোনো ধরনের গোপন অভিসন্ধি বা গোপন তত্পরতার খবর পাওয়া যায় তাহলে তাকে দেশের রাজনীতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলতে হবে।
বেগম খালেদা জিয়ার আজ (রবিবার) লন্ডনে এসে পৌঁছার কথা। তার সঙ্গে শিল্পপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং তার ছেলে বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়ালেরও লন্ডনে আসার কথা। বলা হয়েছে, চোখ ও পায়ের চিকিত্সার জন্য বেগম জিয়া লন্ডনে ছয় সপ্তাহ অবস্থান করবেন। কিন্তু এই সফরের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটাই যে বড় তা তার সফর উপলক্ষ করে যুক্তরাজ্য বিএনপি যে বিরাট প্রচার অভিযান চালাচ্ছে তা দেখেই বোঝা যায়।
এই প্রচারাভিযানে বলা হচ্ছে, বিএনপি-নেত্রী লন্ডনে অবস্থানকালে বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। তা ছাড়া বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গেও একাধিক বৈঠকে বসবেন। লন্ডনের একটি বাংলা সাপ্তাহিকের খবরে বলা হয়েছে, আগামী সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেগম জিয়ার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডনে বসেই পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন তার দল নির্বাচনে যাবে কি যাবে না এবং না গেলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের রোডম্যাপ কী হবে?
বিএনপিসূত্রেই জানা যায়, নির্বাচনকালীন যে সহায়ক সরকারের দাবি তারা জানিয়েছেন, অথচ তার রূপরেখা দিতে পারেননি, লন্ডনে মাতা-পুত্র মিলে সেই রূপরেখা তৈরি করবেন। তারপর দেশে ফিরে সেই রূপরেখা ঘোষণা করবেন বেগম জিয়া। যদি সরকার নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি না মানে এবং বিএনপিকে আন্দোলনে যেতে হয়, তার ধরন ও প্রক্রিয়া কী হবে এবং এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সমর্থন কতটুকু পাওয়া যাবে, তা নিয়েও লন্ডনে দলীয় বৈঠকে আলোচনা হবে।
এই খবরটি যখন লন্ডনের বাংলা সাপ্তাহিকে পড়ছি, তখনই আবার গুজব কানে এসেছে বেগম জিয়া আজ (রবিবার) লণ্ডনে এসে পৌঁছতে নাও পারেন। তার লণ্ডন সফর স্থগিত হতে পারে। আমার এ গুজবটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কারণ, বেগম জিয়ার এবারের লণ্ডন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির প্রকাশ্য রাজনীতির ঘাঁটি এখন ঢাকায় হলেও অপ্রকাশ্য রাজনীতির প্রধান ঘাঁটি লন্ডন। দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতার চাইতেও পুত্র এবং বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানের পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত দ্বারাই তিনি চালিত হন।
তারেক রহমান সম্পর্কে নানা মহলের অভিযোগ, লণ্ডনে তার প্রকাশ্য রাজনীতি হলো, বিভিন্ন সময় সভা ডেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়াত নেতাদের সম্পর্কে কুত্সা প্রচার। আর অপ্রকাশ্য রাজনীতি হলো, বিদেশে বসে স্বদেশে সরকার উত্খাতের জন্য গোপন ষড়যন্ত্র পাকানো। ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচালের জন্য বাংলাদেশে জামায়াতিদের সহযোগিতায় যে হিংস্র পেট্রল বোমা হামলায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, (যাকে আন্দোলন নাম দেওয়া হয়েছিল) তারও রূপরেখা তৈরি হয়েছিল এই লণ্ডনেই।
রবিবারে বেগম খালেদা জিয়া লণ্ডনে পৌঁছবেন (যদি আসেন)। পরদিন সোমবার লণ্ডনের হাউস অব লর্ডস-এ বাংলাদেশ সংক্রান্ত আলোচনা সভা। আগে এই সভা ডাকতেন লর্ড এভাবেরি। তিনি মারা যাওয়ার পর এই সভা ডাকেন লর্ড কার্লাইল। সোমবারের (১৭ জুলাই) বৈঠকটিও তিনিই ডেকেছেন। বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দলীয় একাধিক নেতাকে এই বাত্সরিক বৈঠকে জড়ো করে দু’পক্ষকেই বক্তব্য পেশ করে দেশটির গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার সংক্রান্ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণের সুযোগ দেওয়া হয়। কাজের কাজ কিছু হয় না, এটা একটা চ্যাটারিং ক্লাব।
এই চ্যাটারিং ক্লাবে বাংলাদেশের জামায়াতিদের আসা নিষিদ্ধ। তথাপি গত বছর এক জামায়াতি এই বৈঠকে ঢুকে পড়ে হইচই জুড়ে দিয়েছিল। তাকে পুলিশ ডেকে বহিষ্কার করতে হয়। এই বৈঠকে কাজের কোনো আলোচনা হয় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’দলেরই প্রতিনিধি এখানে আসেন। মনে হয় অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে এমনভাবে বৈঠকটি সাজানো হয়, যাতে শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে বাদীপক্ষ হিসেবে এবং আওয়ামী লীগকে আসামি পক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হয়। বিএনপি প্রতিনিধিরা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সত্যমিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করায়। আওয়ামী লীগের সরকারি প্রতিনিধিরা তার জবাব দিতে দিতেই জেরবার হন। লাভ হয় বিএনপি’র। একটি বিদেশি মঞ্চেও তারা প্রতিবছর আওয়ামী লীগ সরকারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন।
এই গুরুত্বহীন চ্যাটারিং ক্লাবে আওয়ামী লীগ সরকার কেন প্রতিবছর হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করে শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি পাঠান তা আমার জানা নেই। এই সোমবারের বৈঠকে তিনজন সরকার দলীয় প্রতিনিধি থাকবেন। ড. মশিউর রহমান, ড. গওহর রিজভি ও ডা. দীপুমনি। এই বৈঠকে যোগ দিয়ে সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া এরা আর কী করবেন, তা আমার কাছে অবোধ্য।
রবিবার বেগম জিয়া লন্ডনে আসছেন। পরদিন সোমবার লন্ডনের লর্ডস সভায় বাংলাদেশ সম্পর্কে এই বৈঠক। বিএনপি’র জন্য একেবারে সোনায় সোহাগা। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সত্যমিথ্যা, রঞ্জিত অতিরঞ্জিত অভিযোগ প্রচারে তারা একধাপ এগিয়ে যাবেন। তবু বিএনপি’র এই প্রকাশ্য রাজনীতি সমর্থনযোগ্য। একটা সাধারণ নির্বাচনের আগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য সকল রকম প্রস্তুতি গ্রহণের অধিকার তাদের আছে। সকল দলেরই আছে। কিন্তু ঢাকায় বসে তারা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার গঠনের দাবি জানাবেন এবং লন্ডনে বসে অন্যপন্থায় সরকার উচ্ছেদের ঘোঁট পাকাবেন তা তো হয় না।
বিএনপি নেতারা এখন গুজব ছড়াচ্ছেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” বাংলাদেশ চালাচ্ছে। সত্যটা হলো ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর নির্দেশে দেশ চালাত। এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ তুলে তারা আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতে চায়। কিন্তু গুজবকে যদি বিশ্বাস করতে হয় তাহলে এও বিশ্বাস করতে হবে, ঢাকায় বসে বিএনপি-নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের তাঁবেদারি করার অভিযোগ ছড়াচ্ছেন। অন্যদিকে লন্ডনে বসে তারা “র”-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করছেন বাংলাদেশে হাসিনা সরকারকে উত্খাত করে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য। সত্য মিথ্যা এখনো জানি না, কিন্তু লন্ডনের বাজারের গুজব, ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের মাধ্যমে তারেক রহমান ও “র”-এর প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েক দফা গোপন বৈঠক হয়েছে।
এই বৈঠকে ভারতকে বলা হয়েছে, হাসিনা সরকার দিল্লিকে যতটা সুবিধা দিয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার চাইতে অনেক বেশি দেবে। এমনকি তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কেও হাসিনা সরকারের মতো জোর দাবি জানাবে না। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে বিএনপি আমেরিকারও হস্তক্ষেপ চায়। এজন্য ড. ইউনূসের গোপন তত্পরতা তো রয়েছেই, তা ছাড়া বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের আরও কতিপয় শীর্ষ নেতারও এই তত্পরতার সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে।
সম্ভবত আমার এই কলামের পাঠকেরা ভুলে যাননি, কিছুকাল আগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব জয়কে আমেরিকায় অপহরণের যে চক্রান্ত হয়েছিল তাতে মোসাদের এক প্রতিনিধির জড়িত থাকার খবর পাওয়া গিয়েছিল। মোসাদের উদ্দেশ্য, প্রতিটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে গোলমাল পাকিয়ে ইসরায়েলের অবস্থান স্থায়ী ও শক্ত করা। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ বাধানো এবং সন্ত্রাসী আইএস গঠনে ইসরায়েলের ভূমিকা এখন সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং প্যালেস্টাইনিদের মুক্তি সংগ্রামে হাসিনা সরকার দৃঢ় সমর্থন দিয়েছেন। মোসাদ তাই বাংলাদেশেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করতে চায়। আমি বিস্মিত হব না, বিএনপি’র তারেক রহমান যদি মোসাদকে এই আশ্বাস দিয়ে থাকেন যে, তার দল ক্ষমতায় গেলে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।
মুখে বিএনপি যতই ভারত-বিদ্বেষ প্রচার করুক, তলে তলে মোদী-সরকারের ভজনা চালাচ্ছে বলে যে গুজবটি ছড়িয়েছে, তা যে একেবারে মিথ্যা নয়, দিল্লির এক সাংবাদিক বন্ধু তা আমাকে জানিয়েছেন। বলেছেন এতো ভজনা সত্ত্বেও মোদী-সরকার বিএনপিকে বিশ্বাস করতে পারছে না, ঢাকায় অনেক তদবির করে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে বেগম জিয়া তাকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার একটিও তিনি পরে রক্ষা করেননি। বিজেপি সরকারের শীর্ষস্থানীয় অনেকের সন্দেহ বাংলাদেশের বিএনপি পাকিস্তানের আইএসআইয়ের পরামর্শেই এখন ভারত-বন্ধু সাজার চেষ্টা করছে। কোনোভাবে আবার ক্ষমতায় যেতে পারলেই আবার আগের চরিত্রে ফিরে যাবে। এখানেই বাংলাদেশের চক্রান্তের রাজনীতি আর এগুতে পারছে না। বেগম জিয়ার লন্ডন সফর তাকে আবার এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে কিনা, তা বলার সময় এখনো আসেনি।
আগামী নির্বাচন যে হবে তাতে আমার সন্দেহ নেই। বিএনপি’ও সেই নির্বাচনে আসবে। তবে মাঝখানে “দেশের সুশীলদের” সহায়তায় পানি ঘোলা করার চেষ্টা করবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচন-প্রস্তুতিতে এই গোপন তত্পরতা ব্যর্থ করারও সক্ষমতা থাকতে হবে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্ভাগ্য, এই রাজনীতি এখনো গণতন্ত্রের সুস্থ ধারায় ফিরে আসতে পারেনি।
[আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী– লন্ডন, ১৫ জুলাই, শনিবার, ২০১৭ ]
Posted ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৬ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta