কক্সবাংলা রিপোর্ট(৭ জানুয়ারী) ::বাংলাদেশি শ্রমিক ও জাপানি কারিগরি সহায়তায় এগিয়ে চলছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ। সাগর থেকে ১৮ মিটার ড্রাফটের মাদারভেসেলগুলো (গভীর সমুদ্রে চলাচলকারী পণ্যবাহী বড় জাহাজ) ভেড়ানোর জন্য চলছে চ্যানেল তৈরির কাজ।
ইতিমধ্যে উপকূলের ভেতরে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ, ১০০ মিটার চওড়া ও ৮ মিটার গভীর চ্যানেল তৈরি হয়ে গেছে, এখন চলছে জেটি নির্মাণের কাজ। ২০২৩ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে কয়লাবাহী জাহাজগুলো যাতে এখানে ভিড়তে পারে সেই আলোকে চলছে এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ।
এক বছর আগে যেখানে ছিল চরাঞ্চল ও বালির তৈরি রাস্তা। সেখানে গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চ্যানেল তৈরি হয়ে গেছে। সাগর থেকে সহজেই এই চ্যানেল দিয়ে জাহাজ প্রবেশের উপযোগী করা হচ্ছে। চ্যানেলের পাড়ে চলছে জেটি নির্মাণের জন্য মাটি ভরাট ও রাস্তা তৈরির কাজ। বালিবাহী ট্রাকগুলো একের পর এক এসে মাটি ফেলছে এবং একজন জাপানি সুপারভাইজার ট্রাকের চালকদের মাটি ফেলার স্থান দেখিয়ে দিচ্ছেন।
জাপান থেকে আনা বিশেষ প্রযুক্তির এই ট্রাকগুলো আমাদের দেশের তিনটি ট্রাকের সমান মাটি পরিবহন করতে পারে। সাগর থেকে আসা কয়লাবাহী জাহাজগুলো এই জেটিতেই এসে ভিড়বে এবং এখান থেকে চলে যাবে ডাম্পিং স্টেশনে। মাটি ফেলার কাজ তদারকি করছেন একজন কর্মকর্তা।
ময়মনসিংহের স্থায়ী বাসিন্দা মোহাম্মদ সুজন নামের এ কর্মকর্তা ট্রাক থেকে মাটি ফেলার স্থান দেখিয়ে বলেন, ‘এখানেই এসে জাহাজগুলো ভিড়বে এবং কয়লাগুলো নির্ধারিত স্থানে চলে যাবে। এটি হবে জেটির সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী সড়ক।’
চ্যানেলের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা জানান, এখন মাত্র চ্যানেলের রূপ দেয়া হয়েছে। চ্যানেলের গভীরতা ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে এবং উভয় পাড় মজবুত করা হবে। মূলতঃ ২০২৩ সালে জাহাজ ভেড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চলছে এই কাজ।
তবে চট্টগ্রাম বন্দরের আদলে জাহাজ থেকে পণ্য পরিবহন হবে কিনা এ বিষয়ে প্রকল্প এলাকায় কর্মরত কেউ কিছু বলতে পারছে না। এদিকে যেখানে জেটি নির্মাণের কাজ চলছে সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চর খনন করে বিশ্বের শক্তিশালী ৫টি ড্রেজারের একটি ক্যাসিওপিয়া ভি অবস্থান করছে।
সাগরের মাঝখান থেকে চরের ভেতরের জেটিতে (১৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল) আসার জন্য নির্মাণাধীন চ্যানেলের গভীরতা বাড়াতে ড্রেজিং করছে ক্যাসিওপিয়া ভি। এই চ্যানেলের চওড়া হবে ২৫০ মিটার এবং গভীরতা হবে ১৮ দশমিক ৫ মিটার। তবে পরবর্তীতে এই চ্যানেলের চওড়া ৭০০ মিটার করা হবে।
এদিকে গত শুক্রবার মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতে এসেছিলেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এসময় তিনি বলেন, ‘মাতারবাড়িতে নির্মিত হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। কয়লাবাহী ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজগুলো এই বন্দরে ভিড়তে পারবে। এজন্যই আমরা এটিকে গভীর সমুদ্রবন্দর বলছি। এই বন্দরকে ব্যবহার করে আশপাশের এলাকায় এলএনজি টার্মিনাল গড়ে তোলা হচ্ছে এবং বন্দরের জেটিকে মাল্টিপারপাস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি যে গভীর সমুদ্র বন্দর হবে তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। আমরা ২০২৩ সালে কয়লাবাহী জাহাজ ভেড়ানোর লক্ষ্যেই তা নির্মাণ করছি। শুধু এই কেন্দ্র নয়, এই এলাকাকে ঘিরে এক শিল্পহাব হচ্ছে, সেখানে ব্যবহৃত কয়লাও এখান দিয়ে আসবে।’
এদিকে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)’র অর্থায়নে নির্মিত হতে যাওয়া দিনে ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি একই এলাকায় বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা জরিপ করছে জাইকা।
জাইকার গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, গভীর সমুদ্র থেকে ১৮ মিটার ড্রাফট নিয়ে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল বিশিষ্ট হচ্ছে এই গভীর সমুদ্র বন্দর। সেখানে সর্বোচ্চ ৮ হাজার একক কনটেইনার বিশিষ্ট জাহাজ ভেড়ার সুযোগ থাকবে।
গভীর এই সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রকল্প পরিচালক মনোনীত করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য ( প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলমকে।
বন্দর নির্মাণের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গভীর এই সমুদ্রবন্দরের জন্য জাইকার প্রাথমিক গবেষণা চলছে। তবে এর প্রকৌশলগত সার্ভে শুরু হবে আগামী মার্চের পর। আর তা করতে নয় মাস সময় লাগবে। তাদের রিপোর্ট আগামী বছরের শুরুতে পাওয়ার পর সেই অনুযায়ী প্রকল্প তৈরি করা হবে এবং পরবর্তীতে কাজ শুরু করা হবে। তবে আগামী বছর কাজ শুরু করলেও আমরা ২০২২ সালের মধ্যে হয়তো তা চালুর উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারবো।‘
তিনি আরো বলেন, মাতারবাড়ির এই বন্দরকে ঘিরেই মহেশখালী ও কুতুবদিয়া সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় বিশাল এক শিল্প হাব গড়ে ওঠবে।এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এগিয়ে নিতে গত ১৮ অক্টোবর নৌ মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মুখ্য সচিব, বেজা চেয়ারম্যান, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের কো-অর্ডিনেটর, নৌ সচিব, ভূমি সচিব, বিদ্যুৎ সচিব, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানসহ সরকারের ১১ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হেলিকপ্টারে মহেশখালীর মাতারবাড়ির কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন। আর সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের এসব কর্মকর্তা মাতারবাড়ি দেখে আসার পর বন্দর নির্মাণে আরো গতি এসেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মাণ হতে যাওয়া ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নির্মিত হচ্ছে এই বন্দর। যেহেতু কয়লাবাহী জাহাজগুলোর জন্য জেটি নির্মাণ করতে হচ্ছে। এই জেটিকে সম্প্রসারণ করে বাল্ক কার্গো পণ্য হ্যান্ডেলিংয়ের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে রূপ দিতে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।
সেলক্ষ্যে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জেটি থেকে অপর একটি চ্যানেল চলে যাবে পশ্চিম দিকে। সেখানে অন্য পণ্যবাহী জাহাজগুলো ভিড়বে এবং সাগর থেকে গজিয়ে উঠা বিশাল উপকূলীয় এলাকাকে ব্যবহার করা হবে টার্মিনাল হিসেবে। রাজনৈতিক কারণে সরকার সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ না করতে পারলেও মাতারবাড়ি দিয়েই গভীর সমুদ্র বন্দরের সুবিধা পাবে দেশ।
ভূ-রাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় আমরা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে না পারলেও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে মন্দের ভালো পাচ্ছি জানিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু রাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় এখন গভীর সমুদ্র পাচ্ছি না, সেহেতু মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকে ঘিরে তৈরি হতে যাওয়া বন্দরটিতে আমরা গভীর সমুদ্র বন্দরের সুবিধা পেতে পারি। এতে হয়তো আমরা আমাদের দেশের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করতে পারবো।’
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবালের কাছে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘এই বন্দর নির্মাণে আমাদের কোনো খরচ নেই। কয়লা নিয়ে আসা জাহাজগুলোর পোর্ট কলের জন্য বন্দরের প্রয়োজন রয়েছে। তাই তাদের প্রয়োজনে তা নির্মিত হচ্ছে, আমরা শুধু তাদের সুযোগ সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে বন্দরটি গড়ে তুলছি। জাইকার গবেষণায়ও সেই সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে।’
উল্লেখ্য, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলতে নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে ১১ জনের একটি টিম গত ২১ অক্টোবর জাপানে গিয়েছিলেন। সেখানে কাশিমা পোর্ট নামের একটি বন্দর রয়েছে যা মাতারবাড়ির মতো। সেই বন্দর পরিদর্শনের পাশাপাশি আগামীর মাতারবাড়ি কেমন হবে তা নিয়ে পর্যালোচনা হয় সফরে।
Posted ৪:০৯ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta