কক্সবাংলা ডটকম(২২ আগষ্ট) :: অর্থনৈতিকভাবে সুসংগঠিত দলের তালিকা করলে সবার উপরে থাকত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নাম। ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবা খাতের পাশাপাশি তাদের ব্যবসা ছিল অন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক সেক্টরেও। নেতাকর্মীরা দলগত ও ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে গড়ে তোলেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। এ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে জামায়াত মতাদর্শীরাও বিশাল অঙ্কের অর্থ সাহায্য করতেন।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারাকাতের ‘মৌলবাদের অর্থনীতির’ প্রভাব নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মৌলবাদী আদর্শে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মুনাফা আড়াই হাজার কোটি টাকা। আর ১৯৭৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৪০ বছরে এই মুনাফার পুঞ্জীভূত পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে ক্ষমতার শেষের দিকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিপাকে পড়ে দলটি। এর পর ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসি হয়। পাশাপাশি অনেকে বিচারধীন। এর ফলে অনেকটা ভেঙে পড়ে দলটির নেটওয়ার্ক।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে বিদেশ থেকে অর্থ আসার পরিমাণও কমতে থাকে। অন্যদিকে নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অভিযোগে ধর-পাকড়ের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি।
শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বিপুলসংখক নেতাকর্মীর বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে ব্যয় হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। এসব নেতাকর্মী বন্দি থাকায় তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনায় কর্মী সংকট দেখা দেয়। সব মিলিয়ে সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে আরও বেশি দুর্বল হয় তাদের অর্থনৈতিক শক্তি। দেশব্যাপী ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীরা রোষানলে পড়েন সরকারের।
জামায়াতের অর্থনৈতিক দিকগুলোর প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিলেন মীর কাসেম আলী। মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এর পর মূলত বহির্বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগ হ্রাস পায় উল্লেখযোগ্য হারে।
স্বাধীনতার পর জামায়াতের রাজনীতির শুরু থেকেই অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন মীর কাসেম আলী। ব্যাংক, হাসপাতাল, আবাসন, পরিবহন, মিডিয়াসহ ব্যবসার সব শাখায় ছিল তার প্রভাব। বিদেশ থেকে দলের অর্থ সংগ্রহেরও প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ফলে তার মৃত্যুতে বড় ধাক্কা খায় জামায়াত।
জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও দখল হাতছাড়া হওয়ার পরই দলটিতে নেমে আসে অর্থনৈতিক ধস। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানির নামে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানার শেয়ার থাকলেও এর পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল জামায়াতের একচেটিয়া প্রভাব। ফলে জামায়াতের রাজনীতির অর্থনৈতিক বড় স্তম্ভ হয়ে উঠেছিল ইসলামী ব্যাংক।
এ ছাড়া দলটির কর্মীদের কর্মসংস্থানেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখত ব্যাংকটি। এর পাশাপাশি গড়ে তোলা হয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এটি মূলত ইসলামী ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই বিবেচিত।
অন্যদিকে জামায়াত সংশ্লিষ্টরা খুব সহজে এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ত।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের শতকরা ৮০ ভাগ ঋণই দেওয়া হয় জামায়াত সংশ্লিষ্টদের।
ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংকে বর্তমানে ৬৭ হাজার ৯২৫ কোটি টাকার আমানত আছে। গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ, যার ৮০ শতাংশ সাধারণ ধর্মভীরু মানুষ। এর মধ্যে ২০ শতাংশ আমানতকারী জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের।
ইসলামী ব্যাংকে মোট ঋণের পরিমাণ ৬১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। বর্তমানে ৭ লাখ ৫১ হাজারের মতো ঋণগ্রহীতা আছে, যার ৮০ শতাংশ জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। বাকি ২০ শতাংশ সাধারণ ঋণগ্রহীতা ও ব্যবসায়ী। তবে গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, ৮০ ভাগ নয়, ঋণের ৯০ ভাগই জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দখলে।
দেশের অর্থনীতির মূলধারায় ‘মৌলবাদের অর্থনীতির’ প্রভাব নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত মূল স্রোতের অর্থনীতিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার যেখানে গড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ, সেখানে মৌলবাদের অর্থনীতির হার ৮ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ। গবেষণায় পাওয়া ফলে দেখানো হয়, মৌলবাদের অর্থনীতির মুনাফার সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকের মতো বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আসত। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ আসত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে।
এ ছাড়া প্রায় ১১ শতাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান; ১০ দশমিক ৪ শতাংশ ওষুধশিল্প ও স্বাস্থ্য খাত-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান; ৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; সাড়ে ৮ শতাংশ আবাসন খাত; ৭ দশমিক ৮ শতাংশ সংবাদমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এবং সাড়ে ৭ শতাংশ পরিবহন ব্যবসা থেকে আসত।
দেশের ১২টি বৃহৎ খাতে মৌলবাদীদের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। বিনিয়োগের জন্য তারা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রগুলোকেই বেছে নিয়েছে। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই তাদের দখলে রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে অথবা মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এর পরও নামে-বেনামে অনেক ব্যবসাই পরিচালনা করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
জামায়াতের রাজনীতির বিশ্লেষক ফজলুল হক এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, জামায়াতের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে গেছে। দলটির শুভাকাক্সক্ষীরা ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দল থেকে। ব্যবসা-বাণিজ্যও অনেকটা বন্ধ। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান হয়তো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তবে তা একটি দলের জন্য যথেষ্ট নয়। বিদেশ থেকে টাকা আসার উৎসও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এই অবস্থায় দলটি অনেকটা বেকায়দায়। এর পরও হয়তো কিছু কিছু শুভাকাক্সক্ষী এগিয়ে আসেন। বিদেশে অবস্থানরত দলের কর্মীরা কিছু অর্থ পাঠান। এর মাধ্যমেই চলছে দলটি।
Posted ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta