বিশেষ প্রতিবেদক(৭ আগস্ট) :: কক্সবাজারের টেকনাফের দূর্গম পাহাড়ে ১৭টি অস্ত্র ও ৪৩৭ রাউন্ড গুলিসহ দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগটন আল-ইয়াকিন ২’র স্বঘোষিত নেতা আবদুল হাকিমের দুই সহযোগিকে আটক করেছে র্যাব।
আটককৃতরা হচ্ছে, টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লান পাড়া এলাকার দলিলুর রহমান প্রকাশ ধইল্লার পুত্র ফরিদ আলম (৩৭), ও একই এলাকার আবুল হাসেম মাঝির পুত্র শামসুল আলম (২২) বলে জানা যায়।এসময় অভিযান চলাকালীন সময়ে বেশকয়েকজন সহযোগী পালিয়ে যায় ।
৭ আগস্ট সোমবার সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দূর্গম পাহাড়ে র্যাব ৭ এর কক্সবাজারের অফিস ইনচার্জ মেজর রুহুল আমিনের নেতৃত্বে র্যাব সদস্যরা এ অভিযান পরিচালনা করে।
র্যাব-৭’র কর্মকর্তা মেজর রুহুল আমিন জানান, রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার আব্দুল হাকিমের আস্তানায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব সদস্যরা হানা দিয়ে আন্ত:দেশীয় ডাকাত দলের দুই সদস্যকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করতে সক্ষম হয়।
আটকৃতরা রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার আব্দুল হাকিমের সহযোগি হিসাবে সীমান্তে হত্যা,ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। এদের কাছ থেকে ১৫টি শুটারগান ও ২টি পিস্তল এবং ৪৩৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
এদিকে একটি সূত্রে জানা গেছে রোহিঙ্গা জঙ্গি হাকিম ডাকাতের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। হাকিম ডাকাত স্থানীয় কয়েকজনের প্রভাবশালীর ছত্রচ্ছায়ায় টেকনাফ সদর ইউনিয়নের সভাপতি সিরাজ মেম্বারকে খুন করে। এই কয়েকজন ক্ষমতাশালীর ছত্রচ্ছায়ায় সে এইখানে প্রভাব বিস্তার করে রেহায় পাচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানায়। মরহুম সিরাজ মেম্বারের ছেলে আব্দুল ফারুক বাদী হয়ে হাকিম ডাকাতের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছিল।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মাঈন উদ্দিন খান জানান, আব্দুল হাকিম ডাকাতের বিরুদ্ধে অস্ত্র, হত্যা, ডাকাতিসহ একাধিক মামলা রয়েছে। তাকে আটক করতেও পুলিশ হণ্য হয়ে খুঁজছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল হাকিম ওরফে হাকিম ডাকাতের বর্বরতার কথা শুনলে মানুষ অতকে উঠে। মানুষ মেরে জনমনে ভীতি সঞ্চারের জন্য পাহাড়ের চূড়ায় শুকাতে দেয়। এমনই অনেক বর্বর লোমহর্ষক, নিষ্ঠুর কাহিনী জন্মদাতা ওই হাকিম। তার রাজত্বের গল্প টেকনাফের লোকের মুখে মুখে।
তবে আব্দুল হাকিম ডাকাত এতটাই ভয়ংকর ও বেপোরোয়া তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস করেন না কেউ। এই ডাকাতের ভয়ে প্রায় শতাধিক পরিবার গ্রাম ছাড়া। তাকে ধরতে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব যৌথ অভিযান চালিয়েছে কয়েকদফা । কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে আব্দুল হাকিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরকারী মোহাম্মদ রফিক বলেন, আগে আব্দুল হাকিম বাহিনী পুরান পল্লন পাড়ার নুরুল কবিরের ছেলে আব্দুল কাদেরকে চার টুকরো করে হত্যা করে। পরে তার লাশ পাহাড়ের ছড়ায় বাঁশ পুতে শুকাতে দেয়। এমন জঘন্যভাবে আব্দুল হাকিম নির্যাতন চালান।
খুন, অপহরণ, মুক্তিপন আদায়, ইয়াবা ব্যবসা আর মানবপাচার একচ্ছত্র আধিপত্য মিয়ানমারের জানি আলির ছেলে ডাকাত আব্দুল হাকিমের। নাফ নদী থেকে ইয়াবা লুট, সীমান্তের ওপার থেকে রোহিঙ্গাদের অপহরন করে এপারে নিয়ে আসা। মুক্তিপন না পেলে হত্যা করা এখন এই বাহিনীর নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। পাহাড় দখল, সরকারী জমি দখল এই বাহিনীর নাম রয়েছে শীর্ষে।
টেকনাফের নয়াপড়া শরনার্থী শিবিরের ভেতরের শালবন আনসার ক্যাম্পের অস্ত্র লুট ও আনসার সদস্য হত্যা, মিয়ানমারের পুলিশ ক্যাম্পে হামলার সাথেও আব্দুল হামিদ জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রাথমিক তথ্য রয়েছে। ডাকাত হাকিমের হাতে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন।
তাদের মধ্যে আবদুল লতিফের ছেলে নুরুল কবির, সিএনজি ড্রাইভার মো: আলী, মুন্ডি সেলিম, নতুন পল্লানপাড়ার ও আওয়ামীলীগ নেতা সিরাজ মেম্বার, আবদুল হাফিজ ও তোফায়েল অন্যতম।
এছাড়া ওই বাহিনীটি অপহরন করেছেন দুই শতেরও বেশী লোকজনকে। তাদের মধ্যে এখনো অনেকের হদিস মিলেনি। বাহিনীটির হাতে অপহৃতদের অনেকেই মুক্তিপন দিয়ে ফেরত এসেছেন।
তাদের মধ্যে পুরান পল্লান পাড়ার নুরুর কাছ থেকে ৮ লাখ, সেলিমের কাছ থেকে ৫ লাখ, ছুরা খাতুনের কাছ থেকে ৪০ হাজার, শাহপরীরদ্বীপে বসবাসরত বার্মাইয়া জানে আলমের কাছ থেকে ১০ লাখ, শফিউল্লাহ মাঝি থেকে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে বাহিনীটি। রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শিবিরের আনসার ক্যাম্পে অস্ত্র লুট ও আনসার হত্যার অভিযোগ ও ডজন মামলা রয়েছে। তারপরও থেকে গেছেন ধরা ছোয়ার বাইরে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ থানা ২০১৬ সালের ১০/১৬, ৪৩/১৬, ৪৪/১৬, ৪৬/১৬, ৪৭/১৬ নম্বর মামলার প্রধান আসামী রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিম। ২০১৫ সালের জিআর নং-৪১৫/১৫ নং মামলা রয়েছে। এছাড়া চলতি বছরে কক্সবাজার আদালতে অপহরণ মামলা সিআর ৯৪/২০১৭ মামলার প্রধান আসামী সেই ডাকাত।
এছাড়া টেকনাফ মডেল থানায় অপর একটি বৈদেশিক নাগরিক আইন ও মাদক মামলা রয়েছে ।পুলিশ অভিযান চালিয়ে সহযোগী ফরিদ আলম প্রকাশ আলম ডাকাতকে ৩ হাজার ইয়াবা ও একটি বিদেশী পিস্তল সহ আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় হাকিম ডাকাতকে পলাতক আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মিয়ানমারের রাশিদাং থানার বড় ছড়া গ্রামের জানি আলীর ছেলে আব্দুল হাকিম। ৮ বছর আগে মিয়ানমার পুলিশ তার এক ভাইকে সেখানে মেরে ফেলে।
এরপর তিনি সেখান থেকে শাহপরীরদ্বীপ পালিয়ে আসে। এরপর তিনি সেখান থেকে টেকনাফ পৌরসভার পল্লান পাড়ায় এসে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্য তার আরো ৫ ভাই বশির আহমদ, কবির আহমদ, নজির আহমদ, হামিদ হোছনকে নিয়ে আসে এপারে।
এরপর থেকেই শুরু হয় আবদুল হাকিমের বর্বরতা। রাজত্ব চালাতে শুরু করে পুরো উপজেলায়। এরই মধ্যে হাকিম বিয়ে করে পুরান পল্লানপাড়ার জহির আহমদের মেয়েকে।
পরে শ্বশুর বাড়ির সহায়তায় টেকনাফ বন রেঞ্জের উপজেলা প্রশাসনিক ভবনের উত্তর-পশ্চিম দিকের আনুমানিক এক কিলোমিটার পর্যন্ত বনভূমি দখল করে।বেপোরোয়া এই ডাকাত বাহিনী হাকিম ও তার ৫ ভাই ছাড়াও রয়েছে শ্বশুর বাড়ির অনেকেই। এছাড়া পৌরসভার ১ নং ও ২ নং ওয়ার্ডেও অনেকেই রয়েছে ওই গ্রুপে।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ইতিপূর্বে আবদুল হাকিমের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ইসমত আরা বেগম ও হাকিমের ভাই কলিম উল্লাহ প্রকাশ কবির আহমদ এবং তার সহযোগি নুরুল আমিনকে ৩ হাজার ৯৩৭টি ইয়াবা, ৭টি মোবাইল ও ২টি ছুরি সহ গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় মুক্তিপণের জন্য আটকে রাখা শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার নুর মোহাম্মদের ছেলে মোহাম্মদ সেলিমকে উদ্ধার করে বিজিবি।
Posted ১১:৫১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৭ আগস্ট ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta