কক্সবংলা ডটকম(১৭ মে) :: ডেঙ্গু ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগে পড়েছেন দেশের বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে এক বছরের তুলনায় আরেক বছর ডেঙ্গুর পাদুর্ভাবের সময়সীমা বেড়ে যাওয়াকে খুবই চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে তাদের।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকার চেয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হওয়ার ঘটনা। এমন উদ্বেগ থেকেই ডেঙ্গুর সবগুলো সেরোটাইপ, জেনোটাইপ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে কোনো কোনো গবেষণাগারে। সিকোয়েন্সিংয়ে জোর দিয়েছেন কেউ কেউ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে গেছেন এবারও তারা আক্রান্ত হলে বিপদ বাড়বে। ফলে গতবারে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের এবার অধিকতর সতর্ক থাকা জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের ১, ২, ৩ ও ৪ (চারটি) সেরোটাইপ শনাক্ত হয়েছে। গত বছর আক্রান্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি ছিল সেরোটাইপ-২-এর। এর বাইরে গত বছর দুটি সেরোটাইপের একটি সম্মিলিত অংশও ছিল।
বিশেষ করে জুন-জুলাইয়ে এই যৌথ সেরোটাইপের রোগী বেশি ছিল। এ ক্ষেত্রে রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন পাশের দেশ ভারতে ইতোমধ্যেই ডেন ৫ সেরোটাইপ শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ডেন ৫ শনাক্ত হলে পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মক হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যসূত্র অনুসারে, গত বছর দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মারা গেছেন। যাদের মধ্যে ডেন ২ শনাক্ত হয় ৭০ দশমিক ২ শতাংশ, ডেন ৩ ছিল ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ, ডেন ১ ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ডেন ২+ডেন ৩ যৌথ ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং ডেন ৪ ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) তথ্য অনুসারে দেশে ১৯৬৪ সাল থেকে বিক্ষিপ্তভাবে ডেঙ্গু দেখা দেয়। ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ডেঙ্গুর কমবেশি প্রাদুর্ভাব লেগে থাকে। এর মধ্যে ২০০২, ২০১২ ও ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডেন ৩ সেরোটাইপের প্রাধান্য ছিল। তবে সেরোটাইপ ১-৪ পর্যন্ত সব কটিই শনাক্ত হয়। অন্য বছরগুলোতে ডেন ৩ ও ডেন ৪ শনাক্ত হয়নি। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ডেন ১ থাকলেও প্রাধান্য ছিল ডেন ২-এর। এরপর ২০১৮-১৯ সালে চারটি সেরোটাইপই শনাক্ত হয়।
ডেঙ্গু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘গত বছরের অভিজ্ঞতা অনুসারে এবার জরুরিভাবেই নতুন সেরোটাইপ আছে কি না সেটি দেখা দরকার। গত বছরই ধারণা করা হয়েছিল। এবার এখনই পরীক্ষা বাড়ানো দরকার। যত পরীক্ষা হবে, তত সহজে সেরোটাইপ শনাক্ত সহজ হবে। আশপাশের দেশে থাকলে সেটি আমাদের জন্য আরও শঙ্কার ব্যাপার। সেদিকে নজর রেখেই আমাদের বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করেছেন।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত বছর ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং মারা গেছেন ১ হাজার ৬৭৮ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৫৮১ জন এবং মারা গেছেন ৩৩ জন।
১৮ মে পাঠানো তথ্য অনুসারে শেষ ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ জন এবং মারা গেছেন একজন। এবার আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে ৭১১ জন এবং এর পরই ঢাকা দক্ষিণে ৫০৩ জন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে বরিশাল অঞ্চলে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, প্রথমত গত বছর যারা যে সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারা এবার আক্রান্ত হলে বুঝতে হবে অন্য কোনো সেরোটাইপে তাদের আক্রান্ত করেছে। ফলে তাদের জটিলতা ও ঝুঁকি বেশি থাকবে। তাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
ওই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত চারটি সেরোটাইপ শনাক্ত হয়েছে বলেই আমরা জানি। তবে ডেন ৫ সেরোটাইপও পাশের দেশে শনাক্ত হওয়ার কথা শুনেছি। এই সেরোটাইপ আমাদের দেশে ঢুকলে বা থাকলে কিন্তু বিপদ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, এবার ভয় হচ্ছে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর বেশি বিস্তার নিয়ে। যদি ঢাকার বাইরে বেশি ছড়ায়, তবে সামাল দেওয়া মুশকিল হবে। এ ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে ঢাকায় আর ঢাকার বাইরে একই সেরোটাইপের ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা আছে কি না। কোন এলাকায় কোন সেরোটাইপ বেশি সেটি জানতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার কাজ সহজ হবে। সার্বক্ষণিক সেরোটাইপ পর্যালোচনা করা দরকার বলেও তিনি জানান।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘এবার এখন পর্যন্ত সেরোটাইপ বিশ্লেষণ হয়নি। ফলে এবার এখন পর্যন্ত যারা আক্রান্ত হয়েছেন বা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে কোন সেরোটাইপের কত শতাংশ ছিল, সেটিও বলতে পারছি না। সামনে এগুলো দেখা হবে।’
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) উপনির্বাহী পরিচালক ড. সেঁজুতি সাহা বলেন, ‘গত বছর দেশে ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি হয়েছিল তাতে এবারও সবাইকে সতর্ক থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর গতি-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা আরও জরুরি। সেদিকে নজর রেখেই আমাদের প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যেই আমরা ডেঙ্গুর সেরোটাইপ সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ শুরু করেছি। কারণ অনেক সময়েই এক সেরোটাইপের মধ্যে জেনোটাইপগুলোর নতুনত্ব আসতে পারে। যেমনটি আমরা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখেছি। অনেক সাব-ভ্যারিয়েন্ট হঠাৎ করেই বড় ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।’
ওই অনুজীব বিজ্ঞানী বলেন, ‘ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বড় একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যায় পিক সিজনের সময়কালের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ এক বছর থেকে আরেক বছরে পিক সিজন দীর্ঘ হচ্ছে। আগে বছরে খুব অল্প কয়েক দিন বা এক-দুই মাস ডেঙ্গু থাকত। এখন আমরা বছরজুড়ে প্রতিদিনই রোগী পাচ্ছি। এই পরিবর্তন তো এমনি এমনি হচ্ছে না।
অন্যদিকে ডেঙ্গুর ভেক্টর বা বাহক এডিস মশার মধ্যেও এই ভাইরাসের সহনশীলতা শক্তি তৈরি হয়েছে। আগে কেবল পরিষ্কার পানিতে ও ঘরেই ডেঙ্গু এডিসের প্রজনন হতো। এখন নোংরা পানিতে নালা-নর্দমায়ও এডিস মশার লাভা পাওয়া যায়। এটি ভালো লক্ষণ না। তাই আমরা আমাদের ল্যাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের সিকোয়েন্সিং চলমান রাখব। প্রথম ধাপের কাজের ফলাফল হয়তো খুব দ্রুত সময়েই পেয়ে যাব।’
Posted ২:৪৪ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta