মার্কিন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন নির্বাচিত হলে তুরস্কের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আশঙ্কার কথা বলছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। জো-বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার আগেই রাশিয়া থেকে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্রয়ের জন্য মার্কিন অস্ত্র নিষেধাজ্ঞায় পড়ল এরদোয়ান সরকার। এই অবরোধের ফলে তুরস্ক যেমন মার্কিন অস্ত্র ক্রয় করতে পারবে না তেমনি মার্কিন মিত্র অঞ্চলে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয়ে বাধার মুখে পড়বে তুর্কি প্রশাসন।
এই অবরোধ নিয়ে যখন বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনা চলছে তখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের নীরবতা ভেঙে তেল আবিবে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করতে যাচ্ছে তুরস্ক।তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক ও হিব্রু ভাষা জানা উফুক উলুতাসকে ইসরাইলে রাষ্ট্রদূত হিসাবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়ান এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন একটি ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছে তেমনি তেলআবিবে এরদোয়ানের দূতও হয়ে উঠতে পারেন আরেকটি কূটনৈতিক চমক।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে রাশিয়ান এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ন্যাটো মিত্র ও ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তারা এমন কারো সাথে তাদের সামরিক প্রযুক্তি শেয়ার করতে চায় না যাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রাশিয়ার প্রবেশাধিকার আছে। বিষয়টা যতটা না প্রযুক্তিগত তার চেয়েও বেশী ভূ-রাজনৈতিক। ভারত একই সাথে রাশিয়া ও মার্কিন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্রেতা কিন্তু তুরস্ক কেন নয়! সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক যেভাবে মধ্যপ্রাচ্য, ককেশাস অঞ্চল ও পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরে অগ্রসর হচ্ছে তা এই অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে ক্ষুন্ন করতে পারে। ফলে অবরোধ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চল নিয়ে তুরস্কের সাথে একটি দর কষাকষিতে আসতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। শুধুই ভূরাজনৈতিক খেলা নয় মার্কিন অস্ত্র ব্যবসা থেকে তুরস্কের মুখ ফেরানোও এই অবরোধের একটা কারণ। একটা সময় মার্কিন অস্ত্র বাজারের উপর নির্ভর ছিল তুরস্কের সামরিক খাত। এমনকি আধুনিক প্রযুক্তির মার্কিন এফ-৩৫ জঙ্গি বিমান পাওয়ার কথা ছিল তুরস্কের।
রাশিয়া থেকে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করায় বিমান বিক্রয় আটকে দিয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রানালয়। তুরস্ক এখন শুধু মার্কিন অস্ত্র বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে তা নয় নিজেরাও সামরিক খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে। বর্তমানে ৬৫% সমারস্ত্র তুরস্ক নিজে উৎপাদন করছে ২০২৩ সালের মধ্যে সমরাস্ত্রে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বৈদেশিক অস্ত্র রফতানির বাজারে ভাগ বসাতে চায়। তুরস্কের ড্রোন আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধে গেইম চেঞ্জার হিসাবে কাজ করেছে। সার্বিয়া, পোল্যান্ড ও ইউক্রেনসহ বেশ কয়েকটি দেশ নতুন করে তুরস্ক থেকে অস্ত্র কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে। পাকিস্তান, সৌদি আরব, আজারবাইজান ও তুর্কিমেনিস্তান পুরানো ক্রেতা। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বাংলাদেশে সমরাস্ত্র বিক্রির আগ্রহ দেখিয়েছেন। এভাবে অস্ত্রের বাজারে তুর্কি আধিপত্য নিয়েও উদ্বিগ্ন মার্কিন অক্ষ।
বাইডেন প্রশাসনে ওবামা প্রশাসনই নতুন মোড়কে ফিরে আসতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেন পলিসি হতে যাচ্ছে সিরিয়া ও লিবিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বেশী সম্পৃক্ত করা কিন্তু তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে মরিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্পের বিতৃঞ্চা থাকলেও বাইডেন প্রশাসন এই দুই সংস্থাকে শক্তিশালী করতে চায়। তুরস্ক ন্যাটোতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অংশীদার। কিন্তু লিবিয়া ইস্যুতে ন্যাটোভুক্ত দেশ ও তুরস্ক মুখোমুখি ছিল। এমনকি সিরিয়ার শরণার্থী সমস্যা যার সাথে ইউরোপীয় স্বার্থ জড়িত সেখানেও ইউরোপ থেকে সমর্থন পায়নি তুরস্ক। ফলে তুরস্ককে ইউরোপীয় বন্ধুত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবাচ্ছে।
গাজার হামাসের সমর্থক তুরস্কের গাজামুখি মানবিক সহায়তার জাহাজে ২০১০ সালে ইসরাইলি হামলার পর থেকে তেল আবিব-আঙ্কারার সম্পর্কের শীতলতা চলছে। এমন একটা সময় তুরস্ক ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে যখন ইসরাইলকে বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ স্বীকৃতি দিচ্ছে। অন্যদিকে মার্কিন ও মার্কিন মিত্র মহলে তুরস্ক নিয়ে শুরু হয়েছে অস্বস্তি আর মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি বলয়ের দেশে অঘোষিত বানিজ্য নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে তুর্কি পন্য। তুরস্ক ও ইসরাইল দীর্ঘ বাগবিতন্ডা চললেও দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার ছিল। এমনকি ইসরাইলি পর্যটকদের পছন্দের তালিকায়ও থেকেছে ইস্তাম্বুল। ইসরাইল তুরস্কের ১০ নম্বর রফতানি বাজার। ইসরাইল ও তুরস্কের মধ্যে গত বছরে ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের গত বছরে বানিজ্য হয়েছে তার দশ ভাগের ১ ভাগ।
তবে শুধুমাত্র বাণিজ্য সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য ইসরাইলে নিজেদের দরজা খোলেনি এরদোয়ান সরকার। ইসরাইল যেভাবে মিশর, গ্রিস ও আমিরাতের সাথে তুর্কি বিরোধী জোট বাঁধছে তা তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনকই। অন্যদিকে ইসরাইলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও জানে কয়েকটি মুসলিম দেশ চাপে পড়ে নামে মাত্র স্বীকৃতি দিলেই ইসরাইল নিরাপদ হয়ে গেল না। ফিলিস্তন ও ফিলিস্তিনি মিত্রদের সাথে তাদের আলোচনা দরকার। এতদিন ধরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসাবে সৌদি আরব ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা করলেও বর্তমানে ফিলিস্তিনীদের বিশেষ করে হামাসের মুরব্বি হয়ে উঠেছে কাতার ও তুরস্ক। ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে বর্তমানে তুরস্ক একটা ফ্যাক্টর।
অন্যদিকে নিজের সীমান্তে এতগুলো সংঘাত রেখে নতুন করে মার্কিন ও ইসরাইলের সাথে বিবাদে জড়াতে চায় না তুরস্ক। এভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে একা হয়ে পড়লে তুরস্কের অর্থনীতিতে ধস নামবে। ইতিমধ্যে লিরা’র দরপতন রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ফলে আরব উস্কানিতে ইসরাইল যেন তুরস্কের উপর সরাসরি কোন হামলা করে না বসে তার নিশ্চয়তা খুঁজবেন নতুন তুর্কি রাষ্ট্রদূত।
তবে ইসরাইল ও মার্কিন পক্ষ থেকে তুরস্ক সাড়া না পেলে বিকল্প পথ রয়েছে তুরস্কের। পাকিস্তান ও ইরানের সাথে ইকো সংস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে। তুরস্কের অর্থনীতিতে বড় বিনিয়োগকারী হয়ে উঠা চীনের সাথে মধ্য এশিয়া হয়ে সরাসরি বানিজ্য নিয়ে ভাবছে তুরস্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ নিয়ে কঠিন অবস্থানে থাকলে তুরস্কের মার্কিন ঘাঁটি বন্ধ করার কথাও ভাবতে পারে তুরস্ক। তবে কাতার ব্লকের মতো এই নিষেধাজ্ঞা তুরস্ককে সরাসরি চীন রাশিয়ার ব্লক নির্ভর করে ফেললে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি। মার্কিন নীতি নির্ধারকদের অবশ্যই এটা জানা আছে ২০০৮ সালের তুরস্ক আর ২০২০ সালের তুরস্ক এক নয়। ফলে উভয় অক্ষই নিজেদের স্বার্থে বিবাদ না বাড়িয়ে একটা দর কষাকষি অবস্থানে থাকবে বলে মনে হয়।
লেখক-শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Posted ১:৫৯ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta