কক্সবাংলা ডটকম(৪ জুন) :: শিক্ষার গুণগত মান অনেকাংশেই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর। এজন্য শ্রেণীকক্ষে পাঠদানকারী শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে শিক্ষার্থীর বোঝাপড়ার পর্ব অনেকটাই সম্পন্ন হয় মাধ্যমিক স্তরে। অথচ দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলছে প্রায় ৩০ শতাংশই অপ্রশিক্ষিত শিক্ষক দিয়ে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যমতে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় পাঠদানরত মোট শিক্ষক ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন। এর মধ্যে ৭১ হাজার ৭০২ জন শিক্ষক কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করছেন। এ হিসাবে মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষক এখনো অপ্রশিক্ষিত।
সম্প্রতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মাধ্যমিক শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় সংসদে তিনি বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষায় মানসম্মত শিক্ষকের অভাব খুবই প্রকট। এ স্তরে শিক্ষার মান বেশ নিম্নপর্যায়ে রয়েছে।
শিক্ষার মান হতাশাজনক হওয়ার জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবকেই প্রধান বাধা হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি হলো শিক্ষা। শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নিয়োগের পর শিক্ষকদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কেননা শিক্ষা প্রতি মুহূর্তেই আপগ্রেড হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবর্তিত সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে শিক্ষক প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন কোনো পদ্ধতি চালু হলে সে বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হয়। শিক্ষক নিজে না বুঝলে শিক্ষার্থীদের কী পড়াবেন?
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক সংকটের তথ্য উঠে এসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক প্রতিবেদনেও। ২০১৫ সালের নভেম্বরে দেশের নয়টি শিক্ষা প্রশাসনিক অঞ্চলের ৬ হাজার ৫৯৪টি বিদ্যালয় ঘুরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের অনেকেই অপ্রশিক্ষিত বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের প্রায় ৪১ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে না। এর মধ্যে ২৩ দশমিক ৭২ শতাংশ বিদ্যালয় বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করে অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে। আর ১৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ বিদ্যালয় বাইরে থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে পরীক্ষা নেয়।
এদিকে মাধ্যমিক শিক্ষায় ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের হিসাবেও দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ব্যানবেইসের ভিন্ন একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় প্রতি শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৫, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভুটান। দেশটিতে প্রতি ১৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। এর বাইরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত ৩১:১, নেপালে ২৯:১, পাকিস্তানে ১৯:১ ও শ্রীলংকায় ১৭:১।
পর্যাপ্ত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের যথাযথ পাঠদান সম্ভব হয় না। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারায় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া শিশুদের ২০ শতাংশই পঞ্চম শ্রেণী শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। মাধ্যমিকে গিয়ে ঝরে পড়ার এ হার দাঁড়ায় ৪০ শতাংশেরও বেশি। আর উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন না করে ঝরে পড়ছে প্রায় ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ হিসাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিক পর্যায়ে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, দেশে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২০ হাজার ৪৪৯টি। এসব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৬৪।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষায় যতটুকু উন্নয়ন প্রয়োজন ছিল, ততটা করা সম্ভব হয়নি। তবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমাতে বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আশা করছি, এসব উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে।
তিনি আরো বলেন, দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। এসব বিদ্যালয় আর্থিক সংকটের কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। উপরন্তু নিয়োগকৃত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা এসব বিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই এ সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।
Posted ৩:৩৮ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৪ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta