কক্সবাংলা ডটকম(২০ মে) :: আপন জুয়েলার্সে সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানের পর দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে উত্কণ্ঠা দেখা দেয়। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর নিউমার্কেটে আমিন জুয়েলার্সে অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়লে এ উত্কণ্ঠা আতঙ্কে পরিণত হয়। এরপর থেকেই দোকান থেকে বৈধ কাগজপত্র নেই এমন স্বর্ণ সরিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান ঘুরে দেখা যায়, স্বর্ণের দোকানগুলোয় শোকেজে সাজানো গহনার প্রদর্শনী আগের চেয়ে অনেক কম। স্বর্ণ প্রদর্শনের জন্য রাখা কাচঘেরা শেল্ফগুলো অনেকাংশ জুড়ে ফাঁকা, যদিও কয়েক দিন আগে এমন চিত্র ছিল না। দোকানগুলোয় ক্রেতাদের উপস্থিতিও অনেক কম।
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের সব ফ্লোরে ছুটির দিনে ক্রেতাদের ঢল থাকলেও স্বর্ণের বাজার হিসেবে পরিচিত লেভেল-৫-এর চিত্র ছিল ঠিক উল্টো। নামিদামি দোকানগুলোয় দু-একজন ক্রেতার উপস্থিতি চোখে পড়লেও অন্য দোকানগুলো ছিল প্রায় ক্রেতাশূন্য। লেভেল-৫-এর ডি ব্লকে আমিন জুয়েলার্সের আউটলেটে মাত্র দুজন ক্রেতার দেখা মেলে। তবে তারা স্বর্ণ কিনতে নয়, মেরামতের জন্য এসেছেন বলে জানান।
ওই আউটলেটের একজন বিক্রয়কর্মী জানান, স্বর্ণের দোকানে গোয়েন্দাদের অভিযানের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় কয়েক দিন ধরে দোকানে তেমন বেচা-বিক্রি নেই। আগে যেকোনো শুক্রবারে লাখ টাকার কাছাকাছি বিক্রি হলেও এখন তা নেমে এসেছে কয়েক হাজারে।
আমিন জুয়েলার্সের পাশেই ভেনাস জুয়েলার্সের বিশাল শোরুম। কিন্তু সেখানেও যেমন ক্রেতা নেই, তেমনি নেই আগের মতো অলঙ্কারের প্রদর্শনীও। একই চিত্র পার্ল ডায়মন্ড, সুলতান জুয়েলার্স, শ্রী জা গোল্ড, আবেদিন গোল্ড, সোনারতরী জুয়েলার্স ও গোল্ড কিং জুয়েলার্সেরও।
শুধু বসুন্ধরা শপিং মল নয়, রাজধানীর নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, সীমান্ত স্কয়ারসহ বেশ কয়েকটি বিপণিবিতান ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। এসব বিপণিবিতানে স্বর্ণের দোকানগুলোয় নামমাত্র কিছু স্বর্ণ মজুদ রাখা হয়েছে।
দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আপন জুয়েলার্সে অবৈধ স্বর্ণের খোঁজে শুল্ক গোয়েন্দারা অভিযান চালানোর পর থেকেই তাদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছিল।এর মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন নিউমার্কেটের আমিন জুয়েলার্সে ভ্যাট গোয়েন্দারা অভিযান শুরু করেন, সেই সময় থেকেই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করে। মূলত ওই সময় থেকেই তারা অবৈধ স্বর্ণ দোকান থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেন।
নিউমার্কেটের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, এখন যে পরিস্থিতি, তাতে শোরুমে স্বর্ণ রাখা নিরাপদ মনে করছি না। তাই বৃহস্পতিবার বিকালেই অতিরিক্ত স্বর্ণ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বৈধ স্বর্ণ দিয়ে ব্যবসা করতে আপত্তি কোথায়— এমন এক প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যবসায়ী বলেন, বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির ওপর আরোপিত শুল্ককর অত্যধিক, যে কারণে সীমিত আকারে সুযোগ থাকলেও স্বর্ণ আমদানিতে তারা উৎসাহিত নন। একই ধরনের মন্তব্য করেন চাঁদনী চক মার্কেটের বেশ কয়েক স্বর্ণ ব্যবসায়ী।
তাদের মধ্যে পুরনো এক ব্যবসায়ী বলেন, এলসি খুলে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকানুন বড্ড কঠিন। এলসি খুলতে গেলে নানা প্রশ্ন করা হয়। এতে করে আমরা নিরুৎসাহিত হই।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্যমতে, সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার স্বর্ণের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা ৭০০। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আমিন জুয়েলার্সে ভ্যাট গোয়েন্দাদের অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। তবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে বৈঠকের পর রাতেই এ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে বাজুস।
সে সময় বাজুসের সভাপতি গঙ্গা চরণ মালাকার বলেন, গোয়েন্দাদের সঙ্গে আমাদের কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আমরা মনে করেছিলাম, আমিন জুয়েলার্সেও শুল্ক গোয়েন্দারা অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে জানতে পারলাম যে, ওখানে শুল্ক গোয়েন্দারা যাননি; গিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগের লোকজন।
স্বর্ণ বৈধভাবে সংগ্রহ করা না হলেও তাদের ব্যবসা প্রক্রিয়াটি বৈধ বলে দাবি করেন বাজুস সভাপতি। তিনি বলেন, আমরা এ খাতের পক্ষ থেকে বরাবরই সরকারকে প্রাপ্য কর দিয়ে থাকি। তবে আমাদের ব্যবসায়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এসব ঝামেলা হচ্ছে। নীতিমালা হয়ে গেলে এসব ঝামেলা মিটে যাবে বলেও মত দেন তিনি।
বাজুসের একজন নির্বাহী সদস্য পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে জানান, দেশে স্বর্ণ আমদানির তেমন সুযোগ নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও বৈধ পথে খুব বেশি স্বর্ণ আমদানি করা সম্ভব হয় না। তবে এ ব্যবসায়ে অবৈধ কিছু নেই। অবৈধ কিছু না থাকলে দোকান থেকে স্বর্ণ সরিয়ে নেয়া হচ্ছে কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে পর পর বড় দুটি স্বর্ণের শোরুমে গোয়েন্দারা অভিযান পরিচালনার পর অন্য ব্যবসায়ীদের মাঝেও এক প্রকারের ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই ভীতি থেকেই অনেক ব্যবসায়ী দোকান থেকে স্বর্ণ সরিয়ে নিয়েছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানের স্বর্ণের দোকানগুলো খোলা থাকলেও দেশের অন্যান্য এলাকার স্বর্ণের দোকানগুলো বন্ধ ছিল।
জানা যায়, দেশের প্রায় সবগুলো বিভাগ ও জেলা শহরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে দোকান থেকে অবৈধ স্বর্ণ সরিয়ে নিয়েছেন। শুধু যেসব স্বর্ণের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে, সেগুলোই দোকানে রাখা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার খুলনার হেলাতলাস্থ স্বর্ণ মার্কেট ও নিউমার্কেটে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে শুল্ক বিভাগ অভিযান চালাতে আসবে। এ গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর হেলাতলা রোডের মা মনসা জুয়েলার্স, শ্যামা জুয়েলার্স, এল রহমান জুয়েলার্সসহ হেলাতলা, নিউমার্কেট ও সিমেন্ট্রি রোডের বড় বড় স্বর্ণের দোকান থেকে স্বর্ণ সরিয়ে ফেলা হয়।
স্বর্ণ কারিগর সমিতির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চোরাইপথে আনা স্বর্ণের বার সরিয়ে ফেলা হয়েছে। শুধু বৈধ কাগজপত্রে আনা স্বর্ণ দোকানগুলোয় রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সারা দিন স্বর্ণ সরিয়ে ফেলার কাজটি করা হয়েছে অত্যন্ত গোপনে।
খুলনার মতো একই চিত্র যশোরেও। আপন জুয়েলার্সে শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানের খবরে যশোরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে বড় ব্যবসায়ীরা দোকান থেকে গহনা সরিয়ে ফেলছেন।
যশোর জেলা জুয়েলার্স ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রকিবুল ইসলাম চৌধুরী সঞ্জয় জানান, তাদের সমিতিভুক্ত শতাধিক দোকান রয়েছে। এছাড়া সমিতিভুক্ত নয়, এমন দোকানের সংখ্যা জেলায় পাঁচ হাজারের মতো। এসব দোকান বিশেষ করে শহরের বড় স্বর্ণের ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কেননা কোনো নোটিস ছাড়াই শুল্ক গোয়েন্দারা ঢাকায় আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালিয়েছে।
সিরাজগঞ্জের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মাঝেও বিরাজ করছে আতঙ্ক। এরই মধ্যে জেলার প্রতিষ্ঠিত স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান থেকে বেশির ভাগ অবৈধ স্বর্ণ সরিয়ে ফেলেছেন বলে জানা গেছে।
একাধিক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, তারা স্থানীয়ভাবে এবং ঢাকা থেকে স্বর্ণ ক্রয় করে বেচা-বিক্রি করে থাকেন। সরকার যদি বৈধভাবে আমাদের সোনা সরবরাহ করেন, তবে আমরা সেভাবেই ব্যবসা পরিচালনা করব।
শুল্ক গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৬৩০ কেজি বা প্রায় ১১৬ মণ স্বর্ণ তারা জব্দ করেছেন। এ স্বর্ণের মধ্যে সর্বোচ্চ মানের ৫৭ মণ স্বর্ণবার নেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে। অস্থায়ী খাত তথা অনিষ্পন্ন অবস্থায় জমা আছে ১ হাজার ২৫৬ কেজি বা ৩১ মণের সামান্য বেশি স্বর্ণবার। এর বাইরে স্বর্ণালঙ্কার জমা আছে ৩১৫ কেজি বা প্রায় আট মণ। এছাড়া কিছু স্বর্ণ আদালতের নির্দেশে শুল্ক পরিশোধসাপেক্ষে দাবিদারদের কাছে ফেরত দেয়া হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, আটক স্বর্ণ বিক্রি করতে নিলাম ডাকার কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের একজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটির উপস্থিতিতে এ নিলাম ডাকা হয়। স্বর্ণ চোরাচালান বাড়লেও দীর্ঘ সময় ধরে স্বর্ণ বিক্রির নিলাম হচ্ছে না। সর্বশেষ নিলামটি অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মঈনুল খান বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি যে অন্য কোনো জুয়েলার্সে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা আমাদের নেই। আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ সংগ্রহ ও সরবরাহের অস্বচ্ছতা থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে ছিল। ওই তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে থাকা স্বর্ণ নিলামের মাধ্যমে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করার জন্যও আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি চিঠি পাঠিয়েছি। আশা করি, বিষয়টি সরকারের উচ্চমহল বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে দেশ থেকে স্বর্ণালঙ্কার রফতানির লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে প্রথম স্বর্ণালঙ্কার নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আজ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি। এর পেছনে এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতাকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ওই নীতিমালায় বৈধ ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে সুপারভাইজড ওয়্যার হাউসে স্বর্ণ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ওই নীতিমালার অগ্রগতি হয়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার পাশাপাশি সরকার এ খাতের দিকে নজর দিলে দেশে স্বর্ণালঙ্কার শিল্পের প্রসার ঘটত। এ খাত থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ তৈরি হতো।
Posted ২:৫৩ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২০ মে ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta