কক্সবাংলা ডটকম(১৬ জানুয়ারী) :: কোলকাতা এই নামটির সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস, অজানা তথ্য ও অনেক অজানা কথা। History of Calcutta (কলকাতার ইতিহাস)
কোলকাতা ( ইংরেজিঃ Kolkata, আদিনামঃ কলিকাতা, পুরনো ইংরেজি নামঃ Calcutta) হল ভারতের পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর ও সংস্কৃতিক রাজধানী। হুগলী নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত এই শহরটি হল পূর্ব ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্র। ভারতের প্রাচীনতম ও সচল বন্দর হল এই কোলকাতা। জনসংখ্যার নিরিখে এটি ভারতের ৭ তম সর্বাধিক জনবহুল পৌরএলাকা এবং ২০১১ এর জনগণনা অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ৪,৪৯৬,৬৯৪। কোলকাতার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সূচক( আনুমানিক) ৬০-১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ভারতের মুম্বাই ও নতুন দিল্লীর পরে।
মূল কোলকাতা গড়ে উঠেছে সুতানটি, গোবিন্দপুর, ও ডিহি কোলকাতা এই তিনটি গ্রাম নিয়ে। ১৭ শ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত কোলকাতায় আধিপত্য বিস্তার করে ছিল নবাবরা, ১৯৬০ সালে ব্রিটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে বাংলার বাণিজ্য সনদ লাভ কোড়ে।১৭৬৫ সালে নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কোলকাতা দখল করে কিন্তু পরের বছরই ব্রিটিশরা আবার কোলকাতা দখল করে এবং ১৭৯৩ সালে ” নিজামৎ” বা স্থানীয় শাসনের অবলুপ্তি ঘটিয়ে কোম্পানি পুরোপুরিভাবে জাঁকিয়ে বসে। যদিয়ও ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে কোলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী কিন্তু ১৯ শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে কোলকাতা হল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। সেই কারণে এবং ভারতের মতো এতোবড় একটা রাষ্ট্র শাসনের অসুবিধার জন্য কোলকাতা থেকে রাজধানী নতুন দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়।স্বাধীনতার পর কোলকাতা শুধু ভারতের রাজধানীর প্রানকেন্দ্রই নয়, এর সাথে সাথে শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞানচর্চা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
১৯ শে ও ২০ শে শতাব্দীর প্রথমভাগে বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্রস্থল ছিল কোলকাতা। ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্রের পাশাপাশি সাহিত্ত,থিয়েটার, শিল্পকলা ও চলচ্চিত্রের একটি স্বতন্ত্র ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এখানকার অনেক বিশেষ ব্যেক্তিত্ব সাহিত্য, সঙ্গিত, সিনেমা, শিল্প, বিজ্ঞান, অন্যান্য অনেকক্ষেত্রে অনন্য সম্মানে ভূষিত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে নোবেল ও অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রের কেন্দ্রস্থলও হল এই কোলকাতা।এখানে রয়েছে খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, নন্দন, এগ্রি-হার্টিকালচার সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি, ভিক্তরিয়া মেমোরিয়াল, কোলকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কোলকাতা জাদুঘর, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ইত্যাদি আরও কত। কোলকাতায় রয়েছে একাধিক ক্রিকেট মাঠ তবে কলকাতার মানুষ হল ভারতবর্ষের ফুটবলের রাজধানী।
মধ্য যুগের একাধিক বাংলাসাহিত্যের বিভিন্ন গ্রন্থে জেমন,বিপ্রিদাস পিপলাইয়ের মানস বিজয় কাব্য(১৪৯৫ খ্রীঃ ),মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কন চণ্ডী (১৫৯৪-১৬০৬খ্রীঃ), সনাতন ঘোষালের ভাষা- ভগবত (১৬৭৯-৮০খ্রীঃ), আবুল ফজলের আইনি আকবরি (১৫৯০খ্রীঃ) তে “কলিকাতা” গ্রামটির উল্লেখ আছে। যদিও কলকাতার কাছে “চন্দ্রকেতুগড়ে” প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমান পাওয়া গেছে যে এই অঞ্চলটি ২০০০ রের বেশী বছর ধরে জনবসতিপূর্ণ। ১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এখানে আসার সাথে সাথে কোলকাতা শহরের লিখিত ইতিহাসের সূচনা হয়। যদিয়ও কোম্পানির প্রশাসক জব চারণকে কোলকাতার প্রতিষ্ঠাতা মনে করলেও ২০০৩ সালে একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কোলকাতা হাইকোর্ট সেইমত খারিজ করে দেয়।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলার নবাবের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন তিনটি গ্রাম সুতানটি, গোবিন্দপুর ও ডিহি কোলকাতা নামে তিনটি গ্রামে বর্তমান কোলকাতা শহর বিভক্ত ছিল। এই সময় ফরাসি, ওলন্দাজ ও পর্তুগীজদের আক্রমণ ঠেকাতে ১৭০২ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করেন এবং কোলকাতা “প্রেসিডেন্সি সিটি” এবং বাংলা ” প্রেসিডেন্সি শহরে” পরিণত হয়। পরে নবাব সিরাজদ্দৌল্লা বাংলা দখল করে নিলেও ইংরেজরা আবার বাংলা দখল করে ১৭৭২ সালে কোলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষণা করে। এরপর লর্ড ওয়েলেসলির আমলে শহরের ব্যাপক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং অধিকাংশ সরকারি ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। ভবনগুলির বিশালতা ও স্থাপত্য সৌন্দর্য কোলকাতাকে ” প্রাসাদ নগরীর” সম্মান প্রদান করে। এই সময় এখানে আফিম ব্যাবসাও প্রসার লাভ করেছিল এবং চিনে তা রপ্তানিও হত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কোলকাতা ২টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দক্ষিণে ব্রিটিশদের বসতিকে বলা হত ” হোয়াইট টাউন” এবং উত্তরে ভারতীয়দের বসতিকে বলা হত ” ব্ল্যাক টাউন”। ১৮৫০ এর দশকে কোলকাতা বস্ত্রবয়ন ও পাটশিল্পে উন্নতিলাভ করেছিল এবং এসময় রেলপথ ও টেলিগ্রাফ প্রকল্পে ব্রিটিশ সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। ভারতীয় ও ব্রিটিশ সংস্কৃতির মিশ্রণে সেসময় যে বাবুশ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল তাদের মধ্যে বেসিরভাগই ছিল উচ্চবর্ণীও হিন্দু, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংবাদপত্রের পাঠক, জমিদার, সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষক। এই শতাব্দীতেই বাংলায় “নবজাগরণ” নামে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেছিল যা শুধু বাংলায় নয় সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রয়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরজিও, রামতনু লাহিড়ী, বিদ্যাসাগার, বিবেকানন্দ, কেশব চন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
১৮৮৩ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যে জাতিও সম্মেলনের সূচনা হয়েছিল তা প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন হিসেবে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে তা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়ে যায়। কেন্দ্রভূমি ছিল কোলকাতা। স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ দিয়ে এবং পরিণত হয় স্বদেশী আন্দোলনে। ১৯২৩ শে কোলকাতা পৌরসভা গঠিত হয় এবং ১৯২৪ শে প্রথম মেয়র হন দেশবন্ধু ছিত্তরঞ্ঝন দাশ। এরপর ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৪৪ শে হয় মন্বন্তর ও পঞ্চাশের দাঙ্গা। এই দুটি কারনে মারা যায় হাজার হাজার মানুষ। এরপর দেশভাগের পর বহু মুসলিম যেমন চলে যায় পূর্ব পাকিস্তানে আবার লক্ষাধিক হিন্দু চলে আসে এই বাংলায়, ফলে কোলকাতার জনসংখ্যায় এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর প্রেসিডেন্সীর হিন্দু প্রধান পশ্চিমাঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়, রাজধানী হয় কোলকাতা এবং প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন বিধান চন্দ্র রায়। দেশভাগের পর শরণার্থী এবং অর্থনৈতিক চাপের মোকাবিলা করতে এবং কোলকাতার জনসংখ্যার চাপ কমাতে ২৪ পরগনায় লবনহ্রদ ও নদিয়া জেলায় কল্যাণী নামে দুটি পরিকল্পিত উপনগরী গড়ে তোলেন। এরপর নির্মিত হয় হলদিয়া বন্দর ও ফারাক্কা বাঁধ। স্বাধীনতার পর ১৯৫১ ও ১৯৫৬ সালে কর্পোরেশন আইন সংশোধন করা হয়, ২০০১ সালে কোলকাতার ইংরেজী নাম ” ক্যালকাটা” বদলে হয় “কোলকাতা”। ২০০০ সাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প কোলকাতার অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করে এবং উৎপাদন ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সম্ভব হয়।
কোলকাতা শহরের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল পূর্বদিকে ২২ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৮ ডিগ্রী ২০ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। এবং এই শহর গাঙ্গেয় ব- দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শহরের গড় উচ্চটা ১.৫ মিটার- ৯ মিটারের মধ্যে। এর উত্তর- দক্ষিণে আছে হুগলী নদী। এই শহরের বেশিরভাগ অঞ্চলই ছিল জলাভূমিতে পূর্ণ যা রামসার কনভেনশন অনুযায়ী একটি ” আন্তর্জাতিক গুরুত্ব সম্পন্ন জলাভূমি”। কোলকাতার মাটি ও জল মূলত পলিজ প্রকৃতির। ব্যুরো অফ ইণ্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্সের হিসেব অনুযায়ী কোলকাতা ৩য় ভূ-কম্পী ক্ষেত্রের অন্তর্গত আবার রাষ্ট্রসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ুপ্রবাহ ও ঘূর্ণিঝড় ক্ষেত্র হিসেবে কোলকাতা হল একটি অতি উচ্চ “ক্ষয়ক্ষতি প্রবণ” এলাকা।
কোলকাতার আয়তন ১,৮২৬,৬৭ কিমি। ২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী, মোট ৭২ টি বড়ো শহর এবং ৫২৭ টি ছোটো শহর ও গ্রাম এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিভিন্ন স্থানের মধ্যে দূরত্ব অনুযায়ী কোলকাতাকে ৪ টি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্য কোলকাতা।
কলকাতা মূলত পূর্ব ও উত্তর- পূর্ব ভারতের প্রাণকেন্দ্র। এটি একটি প্রধান বাণিজ্যিক ও সামাজিক বন্দর এবং এটি ভারতের ২য় বৃহত্তম শেয়ার বাজার। এখানে রয়েছে দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যদিও ৬০ টের দশকের শেষের দিকে অর্থনৈতিক মন্দার কারনে কলকারখানার উৎপাদন কমে আসে ফলে ব্যবসা অন্যত্র সরে যায়। ফলে সে সময় রাজ্যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এরপর থেকে আস্তে আস্তে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং আসে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প এবং অর্থনৈতিক সেক্টরগুলো। ফলে পরিবর্তন আসতে থাকে কোলকাতার অর্থনীতিতে।বর্তমানে বড় বড় ভারতীয় করপরেশানগুলি দ্বারা পরিচালিত অনেকগুলি শিল্প ইউনিট কোলকাতায় অবস্থিত। আইটিসি লিমিটেড, এক্সাইড ইন্ডাস্ট্রিজ, হিন্দুস্থান মোটরস, ব্রিটানিয়া, বাটা, বিড়লা, কোল ইন্ডিয়া, ডিভিসি প্রভৃতি কয়েকটি বড় বড় সংস্থার হেড অফিস কোলকাতায় অবস্থিত। সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ এশিয়ার কতগুলি বড় বড় দেশ ও চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন কার্যকরী হওয়ায় কোলকাতার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই সুবিধাজনক।
কোলকাতায় মুলত সংখ্যাগরিষ্ঠ হল বাঙালিরা। এছাড়াও মারোয়াড়ী, বিহারি, মুসলিম, জৈন প্রমুখ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও কোলকাতায় বাস করে। এছাড়াও চিনা, তামিল, নেপালি, ওড়িয়া, তিব্বতি, পাঞ্জাবী, প্রভৃতি জাতির মানুষও বাস করে।তাই কোলকাতার মূল ভাষা হল বাংলা ও ইংরেজি। এছাড়াও হিন্দি, উর্দু, ওড়িয়া ভাষাও শহরের এক অংশের দ্বারা কথিত হয়ে থাকে।
কোলকাতায় যেহেতু হিন্দুর সংখ্যা বেশী তাই মূলধর্ম হল হিন্দু ধর্ম। এছাড়াও মুসলিম, খ্রীস্টান, জৈন আছে এবং আছে শিখ, বৌদ্ধ ইহুদী সম্প্রদায় যার সংখ্যা খুবই কম।
কলকাতা মহানগরী তার সংস্কৃতি, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, চলচ্চিত্র দ্বারা সারা বিশ্বে সমাদৃত। এটি কেবলমাত্র ভারতের পুরনো রাজধানী ছিল না বরং আধুনিক ভারতের শিল্প ও সাহিত্য চেতনার জন্মস্থানও ছিল। শিল্প, সাহিত্যে নতুন প্রতিভাকে গ্রহণ করার ঐতিহ্য কোলকাতাকে পরিনত করেছে ” ভারতের সংস্কৃতিক রাজধানীতে”।
কোলকাতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পাড়া সংস্কৃতি। এছাড়াও ক্লাব সংস্কৃতি, দেওয়াল লিখন, এসবও এখানকার সংস্কৃতির অন্তর্গত।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে কোলকাতার সাহিত্যিকদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকীকরণ হয়। সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ। বর্তমান প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, মাহাশ্বেতা দেবী, জয় গোস্বামী, সুনীল গাঙ্গুলি প্রমুখ।
কোলকাতার সঙ্গীতের ইতিহাস সুপ্রাচীন। অষ্টাদশ- ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা গানে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হয়, যা এখন পুরাতনী নামে পরিচিত। সেইসময় সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল “টপ্পা গান” এবং রামনিধি গুপ্ত হলেন এই গানের পথিকৃৎ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ঠাকুরবাড়ির গানের অবদান উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ছিল কবিগান ও তর্জা। এরপরে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুল প্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন প্রমুখ। এছাড়াও অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীরা হলেন দেবব্রত বিশ্বাস, কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, মান্না দে, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখপাধ্যায় প্রমুখ। ৯০ দশকের শুরুতে বাংলা সঙ্গীত জগতে এক নতুন ধারার সূচনা হয় ব্যান্ডের হাত ধরে।এই ধারার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, কবির সুমন, ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু ও ভূমি। কোলকাতার ২ টি প্রধান সঙ্গীত উৎসব হল ” বাংলা সঙ্গীত মেলা’ ও ” ডোভারলেন সঙ্গীত সম্মেলন”।
কোলকাতার যাত্রা, নাটক ও থিয়েটারের ঐতিহ্য সর্বজনবিধিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, গিরীশ ঘোষ, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর প্রমুখ গুনিজনদের হাত ধরে বাংলা নাটকে আধুনিকতার সূচনা হয়। এর পরে আসেন বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, মনোজ মিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যেক্তিত্ব। কোলকাতার নাট্য অ্যাকাডেমি সারা পৃথিবী বিখ্যাত। এখানকার বিখ্যাত মঞ্চগুলি হল স্টার, মিনারভা, মহাজাতি সদন, রবীন্দ্র সদন, শিশির মঞ্চ ইত্যাদি।
বাংলা চলচ্চিত্রের কদর সারা বিশ্বের মানুষের কাছে। শহরের ফিল্ম স্টুডিও টালীগঞ্জে অবস্থিত। একে টলিউড ও বলা হয়। কোলকাতার বিখ্যাত পরিচালকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, ঋত্তিক ঘটক, ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষ প্রমুখ এবং অতীত এবং বর্তমানের অভিনেতা- অভিনেত্রী দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায়ের নেতৃত্বে স্থাপিত হয় কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি যা সারা ভারতের মধ্যে ২য়। ১৯৯৫ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়।
কোলকাতায় মুলত ২য় ধরনের উৎসব পালিত হয়। ধর্মীও ও ধর্ম নিরপেক্ষ। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “দুর্গাপুজো” যেটি পালিত হয় বাংলা মাসের আশ্বিন- কার্তিকে। এছাড়াও আছে লক্ষীপূজো, কালী পূজো, স্বরস্বতি পূজো, দোল, রথ যাত্রা প্রভৃতি। এছাড়াও অবাঙালীদের উৎসবগুলি হল ঈদ, মহরম, সবেবরাত, ছট, দীপাবলী, ধনতেরাস, গুডফ্রাইডে, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা, মহাবীর জয়ন্তী, নানক জয়ন্তী প্রভৃতিও মোহা ধুমধামের সাথে পালিত হয়।
ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব গুলি হল, আন্তর্জাতিক বৈমেলা, রবীন্দ্র জয়ন্তী,চলচ্চিত্র উৎসব, নাট্য মেলা প্রভৃতি।
কোলকাতার মানুষেরা খুব ভোজন প্রিয়। এখানকার বাঙালীদের প্রধান খাদ্য হল ভাত ও মাছের ঝোল। এছাড়া রসগোল্লা, সন্দেশ, মিষ্টি দৈ হল সারা পৃথিবী বিখ্যাত। কোলকাতার মানুষজন খাবার নিয়ে খুব আবেগপ্রবণ। চিংড়ী, ইলিশের নানা পদ যেমন জনপ্রিয় তেমনই জনপ্রিয় পথখাদ্য যেমন ফুচকা, ঘুগনি, রোল, ঝালমুড়ি প্রভৃতি।এখানে সারা দেশ ও পৃথিবীর সব রকম খাবার পাওয়া যায়। তার মধ্যে মোগলাই ও চিনা খাবারের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশী।
কোলকাতায় অতীতে পুরুষদের মধ্যে শুধু ধূতি পাঞ্জাবিরই চল ছিল। তবে বর্তমানে ছেলেদের মধ্যে পাশ্চাত্য পোশাকের ও চল হয়েছে। তারা শার্ট, টি- শার্ট, জিনস যেমন পরছে তেমনি উৎসবে পরছে পাজামা- পাঞ্জাবি বা ধূতি- পাঞ্জাবি। মেয়েরা মূলত পরে শাড়ী, সালোয়ার- কামিজ। তবে বর্তমানে তরুণীদের মধ্যে পাশ্চাত্য পোষাকও বেশ জনপ্রিয়। মুসলিম মহিলাদের মধ্যে অনেকে বোরখাও পরে।
কোলকাতার শিক্ষা ব্যবস্থা বরাবরই খুব উন্নত। সেই প্রাচীনকাল থেকে এখানে চর্চা হয়ে এসেছে নানা বিষয় নিয়ে। জন্মেছেন অনেক বড়বড় শিক্ষাবিদ গড়ে উঠেছে অনেক বিদ্যালয় এবং বিশ্ব বিদ্যালয়। অতীতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে যেত টোলে বা পাঠশালায়। আস্তে আস্তে এলো স্কুল কলেজ। কোলকাতায় মূলত শিক্ষাদান করা হয় বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজী ভাষায় এবং রয়েছে বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যম স্কুল। এখানকার উল্লেখযোগ্য স্কুল ও বিশ্ব বিদ্যালয় গুলি হল সাউথ পয়েণ্ট, লা মারটেনিয়ার, রামকৃষ্ণ মিশন, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, ল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, এডূকেশন কলেজ ইত্যাদি। এখানকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা হলেন জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্র নাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, অমর্ত্য সেন প্রমুখ। কোলকাতায় জন্মেছেন অনেক নোবেলজয়ী শিক্ষাবিদ। এখানে যেমন রয়েছে বসু বিজ্ঞান মন্দির তেমনি রয়েছ ইণ্ডিয়ান সেন্টার অফ স্পেস ফিজিক্স। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ চন্দ্রশেখর রমন এখানেই আবিষ্কার করেন বিখ্যাত রমন এফেক্টের।
ভারতের প্রথম সংবাদপত্র হিকির গ্যাজেট ১৭৮০ সালে প্রথম কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়া এখানকার বিখ্যাত সংবাদপত্র হল আনন্দ বাজার, বর্তমান, এই সময়, প্রতিদিন, গণশক্তি, দৈনিক স্টেটসম্যান ইত্যাদি। এছাড়াও দ্য স্টেটসম্যান, দ্য টেলিগ্রাফ, ইকোনমিক টাইম ইত্যাদি পত্রিকা কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, চিনা, গুজরাটি ইত্যাদি ভাষায়ও সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এছাড়াও আছে সাময়িক পত্রিকা ও লিটিল ম্যাগাজিন। তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হল দেশ, আনন্দমেলা, আনন্দলোক, শুকতারা ইত্যাদি।
কোলকাতার রাষ্ট্রআয়ত্ত বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র হল আকাশবাণী এবং টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র হল দূরদর্শন। এছাড়াও আছে বেসরকারি এফ এম ও রেডিও স্টেশন। অতীতে আকাশবাণীতে বিখ্যাত ছিল বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া যা বাঙালীদের মধ্যে এখনও সমান জনপ্রিয়। বর্তমানে এসেছে কেবেল, ডিটিএইচ এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক টেলিভিশন। তাই এখন বাংলা হিন্দি ছাড়াও অনেক আঞ্চলিক ও বিদেশী চ্যানেল দেখা সম্ভব হয়েছে। বাংলায় ২৪ ঘণ্টা নিউজ চ্যানেল গুলির মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল ২৪ ঘণ্টা, এ বি পি আনন্দ, কোলকাতা টাইমস ইত্যাদি।
পরিবহণ একটি স্থানের উন্নতির একটি উল্লেখযোগ্য ফলক। কোলকাতার অতীত ঘাটলে দেখা যায় যে শহরটি কিভাবে পরিবহণে ধীরে ধীরে উন্নততর হয়েছে। এখানকার গণপরিবহণের মাধ্যম গুলি হল বাস, ট্রাম, মেট্রো, রেল, বিমান, জলপথ, ও সড়ক পথ।
অতীত কোলকাতার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে ট্রাম ও হাতে টানা রিক্সা। তারপর এসেছে রেল ও মেট্রা। এছাড়াও আছে ট্যাক্সি, সড়ক, বিমান ও জল পরিষেবা।
অতীত থেকে এখনও পর্যন্ত যে ইতিহাস বয়ে নিয়ে এসেছে মধুর স্মৃতি এবং যা এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে আত্মসম্মানের সাথে।
Posted ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta