কক্সবাংলা ডটকম(১৯ নভেম্বর) :: কিছুদিন আগে যখন পাবনা ছিলাম, তখন কেউ কেউ এসে জিজ্ঞেস করতেন, ব্যাংকে রাখা তাদের টাকা নিরাপদ থাকবে কিনা? আমার মাথায় তখন এসব ঢোকেনি বিধায় সবিস্ময়ে আমি বলেছিলাম, এসব প্রশ্নের কারণ কী? জবাবে তারা বলেছিলেন-শোনা যাচ্ছে, ব্যাংকে রাখা টাকা ভবিষ্যতে ফেরত পেতে অসুবিধা হবে!
বিষয়টি তখন বুঝতে পেরে তাদের এসব গুজবে কান দিতে নিষেধ করে বলেছিলাম, শুধু ২-৪টি ব্যাংক থেকে সাবধান হলে বাদবাকি ব্যাংকে কোনো সমস্যা নেই বা হবে না। অতঃপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কানেও সে গুজবটি পৌঁছে গেলে কয়েকদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে তারাও এসব গুজব ভিত্তিহীন বলে জনসাধারণকে জানিয়ে দিয়েছেন। এতে জনসাধারণও দেশের ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা ফিরে পাচ্ছেন।
কিন্তু দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পুঁজিবাজারে কেন বাংলাদেশ ব্যাংক সে আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে বা হচ্ছে, সে প্রশ্নটির সদুত্তর বাংলাদেশ ব্যাংকেরও জানা আছে বলে মনে হয় না। আর শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ও এ প্রশ্নটির উত্তর জানে না। ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে দেশের লাখ লাখ মানুষ বছরের পর বছর ধরে সর্বস্বান্ত হতে চলেছেন; আর এ দুর্দিনেও পুঁজি হারিয়ে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে ভীষণ দুরবস্থায় নিপতিত হয়েছেন।
বর্তমানেও পরপর চার-পাঁচ কার্যদিবস দরপতন অব্যাহত থাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের এখন পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছে। কারণ, পুঁজিবাজার এখন প্রায় ক্রেতাশূন্য! দৈনিক লেনদেন চারশ’ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। সামিট পাওয়ারসহ অন্য কিছু মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারেরও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পুঁজিবাজারে এখন কিছু গ্যাম্বলার দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে আবার তা নিচে নামিয়ে আনার যে খেলা খেলে চলেছেন; বলা চলে সে কারণেই বর্তমান চারশ’ কোটি টাকার টার্নওভার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যথায় এসব গ্যাম্বলিং বন্ধ হলে দৈনিক টার্নওভার আরও অনেক কমে যেত এবং পুঁজিবাজার একটি পরিত্যক্ত স্থানে পরিণত হতো। সেখানে লোকজন খুঁজে পাওয়া মুশকিল হতো।
আর বিএসইসি, ডিএসই ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের তা চেয়ে চেয়ে দেখতে হতো। অথচ পুঁজিবাজার সম্পূর্ণ সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠান এবং বিএসইসি, ডিএসই ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমডি, মেম্বার, ডিরেক্টর ইত্যাদি পদগুলো সরকারি আমলাদের দিয়েই পূরণ করা হয়। ব্যাংকের ক্ষেত্রে যদিও বেসরকারি ব্যাংকগুলো বেসরকারি লোকজন দিয়ে পরিচালিত এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু পুঁজিবাজার সম্পূর্ণরূপে সরকারি নিয়ন্ত্রণে সরকারি আমলা দ্বারা পরিচালিত।
কিন্তু বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ ধরে এসব আমলা দিয়ে পুঁজিবাজারের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। বড় বড় চেয়ার দখল করে মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতাসহ বিবিধ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের পদ-পদবির সদ্ব্যবহার করায় একের পর এক ব্যক্তির পালাবদল ঘটেছে মাত্র।
আর এক্ষেত্রে বিএসইসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান রীতিমতো রেকর্ড সৃষ্টি করে নিয়োগপ্রাপ্তির পর তার মেয়াদ পূর্তি হলেও পরপর আরও দুই দফা বর্ধিত মেয়াদে চেয়ার দখল করেছিলেন। চেয়ার দখল করে ছিলেন বলার কারণ হলো, তার সময়ে পুঁজিবাজারের আদৌ তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি বা পুঁজিবাজারকে মোটেও তিনি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিতে পারেননি। এ অবস্থায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী পদে একজনের পর আরেকজনের আসা যাওয়া অব্যাহত থাকলেও আজ পর্যন্ত সেখানে সুবাতাস প্রবাহের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, বিএসইসির প্রধান নির্বাহী পদে বহু বছর ধরে একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপককেই পদায়ন অব্যাহত রয়েছে। ইতঃপূর্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সে পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আবার বর্তমানে যিনি আছেন, তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। তা ছাড়াও আরও কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সেখানকার মেম্বার পদে বহাল আছেন। আর সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিএসইসি যে দেশের মেধাবী লোকজন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, সে কথাটি বলাই বাহুল্য।
যদিও এসব মেধাবী লোকজন সেখানে বসে পুঁজিবাজারের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতদূর কী করেছেন বা করতে পেরেছেন, পুঁজিবাজারের একজন বিনিয়োগকারী বা দেশের যে কোনো একজন নাগরিক সে প্রশ্নটি করতেই পারেন। কারণ, এক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের একজন বিনিয়োগকারীর রুটি-রুজির প্রশ্ন জড়িত এবং একজন নাগরিকের সাধারণ অধিকার। তাই সেখানকার বড় বড় চেয়ারে বসে তারা কী কী কাজ করছেন বা কেমন করছেন, প্রতিটি নাগরিকেরই তা জানার অধিকার আছে।
আগেই উল্লেখ করেছি-ইতঃপূর্বে একনাগাড়ে ৮/৯ বছর যিনি চেয়ারটি দখল করেছিলেন, তিনি তার পদের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। কিন্তু তারপরও তিনি চেয়ারটি আঁকড়ে ধরে সেখানে আরও কিছু দিন থাকতে চেয়েছিলেন। যদিও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করে সরকার তার তৃতীয় দফা মেয়াদ পূর্তির কিছু আগেই তাকে পূর্বের পদে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এতে কিছুটা হলেও পুঁজিবাজার গতিশীল হয়েছিল।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অল্পদিনের মধ্যেই আবার পুঁজিবাজারের অবস্থা যে লাউ সেই কদুতে পরিণত হয়েছে। আমি যখন এ লেখাটি লিখতে বসেছি, সে সময়ে পরপর চার কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে দরপতন ঘটেছে; শত শত কোম্পানির শেয়ারের কোনো ক্রেতা নেই! লেনদেন করা ৩২১টি কোম্পানির মধ্যে আড়াইশ’টির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসে অবস্থান করছে। অর্থাৎ ঠেকনি দিয়ে দরপতন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।
এ আড়াইশ’টি কোম্পানির শেয়ারের দরপতন এভাবে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে ঠেকিয়ে না রাখলে বর্তমান অবস্থায় পুঁজিবাজারে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের চেয়েও বড় বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতো। অথচ এমন অবস্থাতেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফ্লোর প্রাইসে থাকা শেয়ারগুলোও শতকরা দশ ভাগ কম মূল্যে ব্লক মার্কেটে লেনদেনের অনুমোদন দিয়েছে! আর এসব দেখেশুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেকজন শিক্ষক, যিনি পুঁজিবাজার নিয়ে গবেষণা এবং লেখালেখি করেন, তিনি তার ফেসবুক পেজে ফ্লোর প্রাইস না উঠানোর অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে একটি লেখাও লিখেছেন।
কারণ, ফ্লোর প্রাইস অপেক্ষা আরও দশ ভাগ কম মূল্যে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ দেওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ফতুর হয়ে যাবেন। এ প্রেক্ষাপটে আমি নিজে দীর্ঘ দুই দশক ধরে পুঁজিবাজারসংক্রান্ত তথ্য জানার চেষ্টা করে দীর্ঘকালব্যাপী পুঁজিবাজারে দৈন্য দশা না কাটার যেসব কারণ জানতে এবং বুঝতে পেরেছি, এখন সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই। আর প্রথমেই আমি নতুন নতুন কোম্পানি নিবন্ধনের বিষয়ে আমার জানাশোনা কিছু কথা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরব-
আমার অতি ঘনিষ্ঠ একজন বড় শিল্পপতি কথাচ্ছলে একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখেছেন, আমার কোম্পানির সাবান, কসমেটিক ইত্যাদি তৈরির কিছু পুরোনো পাত্র কিনে নিয়ে গিয়ে অমুক কিভাবে জোড়াতালি দিয়ে একটি ফ্যাক্টরি বানিয়ে আবার তা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করিয়ে শতকোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে তুলে নিলেন।’ বলা বাহুল্য, যার কথা বলা হচ্ছে তাকেও আমি খুব ভালোভাবেই চিনি এবং তিনি যে একজন বড় ধরনের ঋণখেলাপি তাও জানি।
আর নতুন কোম্পানি খুলে তিনি যে পুঁজিবাজার থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন সে কথাও জানতাম। শুধু জানতাম না, তিনি পুরোনো ডেকচি, গামলা ইত্যাদি ক্রয় করে কসমেটিক ফ্যাক্টরিটি দাঁড় করিয়েছেন। যা হোক, সে সময়ে সেই কোম্পানিটি প্রিমিয়ামসহ দশ টাকা মূল্যের প্রতিটি শেয়ার কয়েকগুণ বাড়িয়ে বেশি মূল্যে বাজার থেকে টাকা তুলে নিলেও তার কোম্পানির সেসব শেয়ারের প্রতিটির বর্তমান বাজার মূল্য ছয় টাকা!
আর সেই কোম্পানির শেয়ার নিয়ে আজ এখনো মার্কেটে গ্যাম্বলিং অব্যাহত রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সে সময়ে অতিরিক্ত প্রিমিয়ামসহ কোম্পানিটিকে লিস্টিং করাতে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন কে বা কারা? লিস্টিং-এর সময় কেউ কি ফ্যাক্টরিটি ভিজিট করেছিলেন? আর তদন্ত করে যদি দেখা যায়, সে সময়ে লিস্টিং করাতে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে, তাহলে কি তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে?
এ বিষয়ে আর একটি উদাহরণ দিয়েই লেখাটির উপসংহার টানতে চাই। আমার নিজের দেখা অতি পুরোনো এবং জীর্ণ একটি স্পিনিং মিল। তো হঠাৎ একদিন শুনলাম, তারাও পুঁজিবাজারে এনলিস্টেট হতে চলেছে এবং কিছু দিন পর তা হয়েও গেল। আর দশ টাকা মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের সঙ্গে অতিরিক্ত পঁচিশ টাকা যোগ করে কোম্পানিটি বাজারে শেয়ার ছাড়ার অনুমতি পেল। খবরটি আমি জানতে পারলাম একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের মাধ্যমে। কারণ, ফ্যাক্টরি মালিক তার পক্ষে সুপারিশের জন্য অধ্যাপক সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন।
এখানেও প্রশ্ন হলো, এই যে অতিরিক্ত প্রিমিয়ামসহ এক্ষেত্রে প্রায় শতকোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হলো এবং যার ফলে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী ফতুর হলেন, তার খেসারত কে বা কারা দিবেন? কারণ, দশ টাকা ফেসভ্যালুর সঙ্গে অতিরিক্ত পঁচিশ টাকা বাজার থেকে তুলে নিলেও সেই শেয়ারের মূল্যও পাঁচ টাকায় নেমে গিয়েছিল, যদিও কারসাজি করে সে মূল্য এখন আরও ২/৩ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাজারে শেয়ারটি একেবারেই মূল্যহীন।
কারণ, কর্তৃপক্ষ শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ডিভিডেন্ড দেন না! অথচ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন যদি এসব ফ্যাক্টরি ভিজিট করে এনলিস্টেট করত, তাহলে তো বিনিয়োগকারীদের আজ এভাবে ফতুর হতে হতো না। কিন্তু তারা তা করেনি। ঘরে বসেই তারা এসব কোম্পানির এনলিস্টমেন্টের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন।
উপসংহারে বলতে চাই-এসি রুমে বসে বসে আর কতদিন এভাবে কোম্পানি বা ফ্যাক্টরি এনলিস্টেট প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হবে; আর পুঁজিবাজারের এসব গোড়ায় গলদই বা কবে দূর হবে? সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক তারাইবা এক্ষেত্রে তাদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন?
আর শেষ প্রশ্নটি হলো, তাহলে আমাদের পুঁজিবাজার কি আর কখনো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না? আশা করি, অচিরেই দেশের মানুষ এসব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। কারণ, একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যারোমিটার হলো ‘পুঁজিবাজার’। আর সেই পুঁজিবাজারকে ‘হেলতে দুলতে যতদিন চলে’ অবস্থায় ফেলে রাখলে তা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার শামিল হবে বলে মনে করি।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
Posted ৩:০৬ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৯ নভেম্বর ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta