
কক্সবাংলা ডটকম(৪ অক্টোবর) :: প্রাচীন সভ্যতার ব্যাবিলনকে যদি ইতিহাসের এক মহারথ বলা হয়, তাহলে আজকের ব্যাবিলন সেই জৌলুসের কেবল ছায়া মাত্র।
একসময় যেখানে সাম্রাজ্যের গৌরব, স্থাপত্যের শৌর্য ও মানুষের সৃষ্টিশীলতা মিলেমিশে গড়ে তুলেছিল বিশ্বের অন্যতম বিস্ম, সেখানে আজ নীরবতা, অবহেলা আর অবক্ষয়ের মিশেল।
ব্যাবিলনের অবস্থান আজকের ইরাকের বাবিল প্রদেশে, রাজধানী বাগদাদ থেকে দক্ষিণে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ , হিল্লাহ শহরের কাছাকাছি ইউফ্রেটিস নদীর তীরে।
ইরাকের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই ধ্বংসাবশেষে দাঁড়িয়ে বিকেলের রোদে যখন ধুলো উড়ে যায় নরম কুয়াশার মতো, তখন মনে হয় সময় যেন থেমে আছে—অথচ সেই স্থির সময়ের মধ্যেও এক অমোঘ ইতিহাসের গন্ধ ভেসে বেড়ায়।

পুনর্নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ল্যাবিরিন্থ বা গোলকধাঁধা, যা ধারণা করা হয় প্রাসাদের পাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে নকশা করা হয়েছিল
একসময় মেসোপটেমিয়ার গৌরবের প্রতীক ছিল ব্যাবিলন। সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার-এর শাসনে এটি হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ নগরী।
যেখানে গড়ে ওঠে বিশাল মন্দির, প্রাসাদ এবং সেই কিংবদন্তি ঝুলন্ত উদ্যান, যা প্রাচীন বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের একটি। সেই নগরীর পাথরে পাথরে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক।
ইশতার গেটের নীলচে প্রাচীর, সোনালী সিংহ ও ড্রাগনের অলঙ্করণ আজও সেই মহিমার সাক্ষ্য বহন করে।
প্রসেশোনাল ওয়ে( ব্যাবিলনের রাজকীয় শোভাযাত্রার প্রধান রাস্তা) ধরে একসময় রাজকীয় উৎসব আকিতু (প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবগুলোর একটি) উদযাপিত হতো।
শহরের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এতেমনানকি জিগুরাতের (মারদুকের মন্দির হিসেবে নির্মিত হয়েছিল, নামের অর্থ স্বর্গ ও পৃথিবীর সংযোগস্থল) কথা অনেকেই টাওয়ার অব ব্যাবেল বলে বিশ্বাস করেন।
আর সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজাের প্রেয়সী অ্যামিতিসের জন্য নির্মিত ঝুলন্ত উদ্যান — শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইতিহাসবিদদের কল্পনায় যেন এক জীবন্ত কবিতা।

ব্যাবিলনের সিংহ: প্রায় ২,৬০০ বছর আগে নির্মিত এই সিংহমূর্তিটি, যেখানে সিংহকে এক ব্যক্তিকে পদদলিত করতে দেখা যায়, ব্যাবিলনের সবচেয়ে বিখ্যাত নিদর্শনগুলোর একটি
আজও অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদের কাছে এই উদ্যান কেবল কিংবদন্তি নয়, বরং প্রকৃত বাস্তবতা।
তারা মনে করেন, ইউফ্রেটিস নদীর তীরে হিল্লাহ শহরের কাছে সেই উদ্যানের নিদর্শন লুকিয়ে আছে।
কেউ কেউ নিনেভেহকেও সম্ভাব্য অবস্থান বলে দাবি করেন। কিন্তু দর্শনার্থীদের কাছে সেই বিতর্ক গৌণ।
ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে সহজেই কল্পনা করা যায় টেরেসে ঝুলে থাকা সবুজ লতা, কলামের গায়ে বয়ে যাওয়া জলপ্রপাত, আর জীবনের উচ্ছ্বাসে ভরপুর সেই প্রাচীন নগরী।

প্রাচীন শহরের বহু অংশ আধুনিক সময়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে সাদ্দাম হোসেন নিজেকে সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের উত্তরসূরি মনে করে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুনর্গঠন প্রকল্প শুরু করেছিলেন।
তবে ব্যাবিলনের বর্তমান দৃশ্য একেবারেই ভিন্ন। একসময় যেই নগরী লাখো পর্যটকে মুখর থাকত, সেখানে ২০২৪ সালে মাত্র প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ ভ্রমণ করেছে।
যার মধ্যে বিদেশি পর্যটক মাত্র হাজার পাঁচেক। ভাঙাচোরা রাস্তা, আগাছায় ভরা পথ, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক বোতল ও সিগারেটের অবশিষ্টাংশ—এগুলোই আজ ব্যাবিলনের বাস্তবতা।
কোনো হোটেল নেই আশেপাশে, শৌচাগারও কেবল টিকিট কাউন্টারের পরেই মেলে। পথনির্দেশক সাইনবোর্ড অপ্রতুল, ফলে গাইড ছাড়া সহজেই পথ হারানো যায়।
পুরো প্রত্নস্থলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে আছেন মাত্র চারজন কর্মী। স্থানীয় প্রশাসনের সীমিত বাজেট ও রাজনৈতিক জটিলতা উন্নয়নকে আটকে রেখেছে।

সাদ্দাম হোসেনের পুনর্গঠন প্রকল্পের অংশ হিসেবে ইটগুলোতে খোদাই করা হয়েছিল তার স্বাক্ষর ও শাসনের বার্তা
এ কেবল অবহেলার গল্প নয়, ব্যাবিলন বহন করছে আধুনিক ইতিহাসের ক্ষতচিহ্নও।
১৯৮০-এর দশকে সাদ্দাম হোসেন নিজেকে সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের উত্তরসূরি মনে করে পুরনো দেয়ালগুলো নতুন ইট দিয়ে পুনর্নির্মাণ করেন। তাতে নিজের নাম খোদাই করে রেখে যান।
পরে ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী এই অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করে। ইউনেস্কো ২০১৯ সালে ব্যাবিলনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় যুক্ত করলেও তা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দেয়নি।
এখনো তহবিল সংকট, উন্নয়ন প্রকল্পের জটিলতা এবং নিরাপত্তাহীনতা প্রত্নস্থলটিকে ঝুঁকির মুখে রেখেছে।

সাদ্দাম হোসেন ব্যাবিলন নগরীর উপরে নজর রাখা এক বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ বহুতল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। আজ সেই প্রাসাদ নীরব ও পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে
এতসব অবক্ষয়ের মাঝেও কিছু মানুষের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ ব্যাবিলনকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
স্থানীয় গাইড, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও গবেষকরা নিজেদের মতো করে এই শহরের গল্প বলছেন। কেউ পর্যটকদের বোঝাতে চান ইরাককে ভয় নয়, ভালোবাসতে হবে।
কেউ আহ্বান জানান ধ্বংসাবশেষকে সম্মান করতে, পাথরে নিজের নাম না খোদাই করতে, আবর্জনা না ফেলতে।
কোনো কোনো গবেষক বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন ব্যাবিলনের প্রতিটি ইট-পাথরের অর্থ বোঝার জন্য।

এই মাটির সিলমোহরে সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারকে ব্যাবিলনের নির্মাতা ও এর মন্দিরগুলোর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুমেরীয় ভাষায় খোদাই করা এই নিদর্শনটি নব-বাবিলোনীয় যুগের (খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৬–৫৩৯) সময়কার
আজকের ব্যাবিলন তাই এক দ্বৈত প্রতীকের শহর। একদিকে অতীতের গৌরব ও সভ্যতার সাক্ষ্য, অন্যদিকে অবহেলা ও ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি।
একপাশে সম্রাট নেবুচাদনেজারের শিলালিপি, অন্যপাশে সাদ্দামের নাম।
একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা বাবিলোনীয় সিংহ, অন্যপাশে আগাছায় ঢাকা তার স্তম্ভ।
এমনকি ইশতার গেটের মূল অংশ আজ জার্মানির পেরগামন জাদুঘরে অবস্থান করছে, আর দর্শনার্থীদের জন্য এখানে কেবল পুনর্নির্মিত অংশটি দেখা সম্ভব।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের শাসনামলে এই কক্ষগুলো খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। এর চতুর নকশা গ্রীষ্মে শীতল ও শীতে উষ্ণ রাখত — যা ছিল প্রাচীন ব্যাবিলোনীয় প্রকৌশলের এক অসাধারণ উদাহরণ এবং আধুনিক রেফ্রিজারেশনের প্রাথমিক রূপ
তবু এই সব কিছুর পরও ব্যাবিলন তার মায়া হারায়নি। এখানকার বাতাসে এখনো ইতিহাসের শ্বাস, ধ্বংসাবশেষের প্রতিটি পাথরে এখনো গেঁথে আছে সভ্যতার গল্প।
হাজার বছরের ব্যবধান পেরিয়ে মানুষ আজও এখানে আসে, সেই পুরনো শহরের পথে হাঁটতে। সেই সময়ের ছোঁয়া অনুভব করতে।
সিএনএন অবলম্বনে।

Posted ৩:০৭ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta