শাহাব উদ্দিন সাগর,নিউইয়র্ক(১০ জুন) :: বাঙালী যে কোন জয়ে উল্লসিত হতে জানে। উল্লাসকে উৎসবে পরিণত করতে জানে। বিশ্বের যেকোন দেশে, যে কোন ক্ষেত্রে একজন বাঙালী জয় বা সুনাম অর্জন করলে সবাই তাকে অভিনন্দন জানাতে, প্রশংসা করতে ঝাপিয়ে পড়েন। এটা বাঙালীদের চরিত্র বা ঐতিহ্য। গত দুই দিন ধরে বিশ্বের বাংলাভাষাবাসীরা এক উম্মদনায় মেতেছেন। সোস্যাল মিড়িয়া খুললেই দেখা মিলছে বাঙালীদের উম্মাদনা। বৃটেনে তিন বঙ্গকন্যার বিজয় নিয়ে সরব সোস্যাল মিড়িয়া। ফেইসবুকে চলছে সমানে স্ট্যাটাস।
অভিনন্দন বার্তায় সিক্ত হচ্ছেন বৃটেনের আগাম সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী বাংলাদেশের তিন কন্যা রুশনারা আলী, রূপা হক এবং বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক। ফেইসবুকের স্ট্যাটাসগুলো পর্যালোচনা করলেই দেখা যাচ্ছে অভিনন্দন জানানো বাংলাদেশিদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দল এবং মতের লোকজনও আছেন।
বাংলাদেশি হিসেবে, বাঙালী হিসেবে বিলেতে বঙ্গকন্যাদের বিজয়ে সবাই খুশি। বিলেতের খুশির ঝিলিক পড়েছে আটলান্টিকের এ পাড়ে আমেরিকা তথা নিউইয়র্কেও। তিন বঙ্গকন্যার বিলেতে রাজনৈতিক সাফল্যের পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বৃটেনে বাংলাদেশিরা রাজনীতিতে অভাবনীয় ভালো করলেও আমেরিকায় নয় কেন? প্রশ্নটি আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।
বিলেতে বাংলাদেশিদের বসবাস বা কমিউনিটি সম্প্রারণের ইতিহাস অনেক দিনের। সে হিসেবে আমেরিকায় বাংলাদেশিদের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে আরো সময় লাগবে এমন যুক্তি মেনে নেয়া যাবে। তবে এ কথাও সত্যিই মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। আমেরিকায় বাংলাদেশিরা চার দশকেরও বেশি সময় পার করছেন। ফলে মুলধারার রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়ার এখনই মোক্ষম সময়। এ ক্ষেত্রে বিলেতের বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
এক সময় ব্রিটিশরা শাসন করতো ভারতীয় উপমহাদেশকে। সময়ের পরিক্রমায় আজ বৃটিশ পার্লামেন্টে থাকছেন বাংলাদেশিরা। এই জয় বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে নতুনভাবে পরিচয় করছে। এই জয়ের মাধ্যমে বৃটেনে বাংলাদেশিদের রাজনীতি আরো মজবুত হলো। এ জয় আমেরিকার বাংলাদেশিদের মূলধারা রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সাহস এবং শক্তি যোগাতে পারে।
বলা বাহুল্য; আমেরিকায় বাংলাদেশি কমিউনিটি সম্প্রসারণ হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ বেশি ব্যস্ত দেশিয় রাজনীতি, দেশিয় সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে। বৃটেনেও বাংলাদেশিদের মধ্যে এ প্রবণতা লক্ষণীয়।
তবে সেখানে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছাটা বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রবল। এ কারণে টাওয়ার হ্যামলেটের মেয়র থেকে শুরু করে ছায়ামন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন বাংলাদেশিরা। আমরা আমেরিকায় বাংলাদেশিরা কিছু ছোট কাউন্টিতে কাউন্সিলম্যান হতে পারছি। কংগ্রেসে সদস্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধতিতা করার সাহস পাচ্ছি। বৃটেনের রুশনারা আলী, রুপা হক ও টিউলিপ সিদ্দিক দ্রুত এগুচ্ছেন রাজনীতিতে। এ বিবেচনায় আমেরিকায় বাংলাদেশিদের এগুনোর গতি ধীর বা শ্লথ।
নিউইয়র্কে মাঝে মধ্যে এক /দু’জন বাংলাদেশি সিনেটর প্রার্থী হচ্ছেন। তাদের এ উদ্যোগ প্রসংশনীয়। বাংলাদেশি রােকেয়া আক্তার কুইন্স বরো প্রেসিডেন্টের সংসদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, রুবাইয়া রহমান অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে আন্তর্জাতিক সেমিনারে ডাক পাচ্ছেন, এগুলো আমাদের পুলকিত করে। ড. নুরুন্নবী, মোর্শেদ আলম, গিয়াস আহমেদ, এন মজুমদার, মঈন চৌধুরী, ম্যাফ মেসবাহ উদ্দিন, আব্দুস শহিদরা মূলধারার রাজনীতিকদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন।
ছোট বড় কিছু দায়িত্বও পালন করছেন। ক্ষেত্র বিশেষে তারা মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশিদের পক্ষে দাবীদাওয়া উপস্থাপন করছেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তরুণদের কেউ সেভাবে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছেন না। গর্বিত প্রজন্ম হিসেবে নিউইর্য়কে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তদের মধ্যে ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার কিংবা আহনাফ অালম ছাড়া কারো নাম তেমন একটা শোনা যায় না।
বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সভাপতি নার্গিস আহমেদের আমেরিকার বেড়ে ওঠা কন্যা মুনিরা বিশ্বব্যাপী তাক লাগিয়ে দিতে পেরেছেন। মুনিরার আমেরিকার পতাকা দিয়ে হিজাবী ছবি দুনিয়াব্যাপী প্রতিবাদী মানুষের ‘প্রতিক’ হিসেবে কাজ করছে। আমার চাইলে পারি। আমাদের নারীরা কি পারেন নাই নেতৃত্ব দিতে? অবশ্যই পেরেছেন। তা নাহলে নার্গিস আহমেদ বাংলাদেশিদের আম্বেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হলেন কিভাবে? বদরুন নাহার খান মিতা বৃহত্তর সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশেনর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন কিভাবে? আমরা সব করতে পারছি কিন্তু মূলধারার রাজনীতিতে মনোনিবেশটা যত্নের সঙ্গে করতে পারছি না। আমরা অধিকভাবে ব্যস্ত দেশিয় রাজনীতি নিয়ে।
সেই দেশিয় রাজনীতে অন্তরীণ হওয়ার কারণে, পদ পদবী পাওয়া ব্যস্ততার কারণে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে না যোগ্যরাও। দেশিয় রাজনীতির সঙ্গে আমেরিকার বাংলাদেশিরা সক্রিয় হলেও সেখানেই তারা সফল হতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগে গ্রুপিং চরমে, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি বহুধা বিভক্ত, কমিটিহীন চলছে বছরের পর বছর। ফলে বাংলাদেশিরা ঘরের রাজনীতি সামাল দিবেন ,না মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হবেন সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এছাড়া অাঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বিভক্তিতে নেতারা এত বেশি জড়িয়ে পড়েন সেখানে মূলধারার রাজনীতে সম্পৃক্ত হওয়া লক্ষ্যটাই ভুলে যান। সময় এসেছে আমাদের তরুণদের খোঁজে বের করার, যারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংসদগুলোকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের উৎসাহ দেয়ার। কমিউনিটির পক্ষ থেকে তাদের পৃষ্টপোষকতা করা প্রয়োজন। আম্বেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি সে কাজটি করেত পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছোট বড় দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশি প্রজন্মকে মূলধারার রাজনীতিতে জড়নাের ক্ষেত্র তৈরি করার নানা উদ্যোগ নিতে পারে। তরুণ প্রজন্মের অমিত সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে পারে নিজেদের পরিবারও। নিজের সন্তানদের নাসার বিজ্ঞানী, বড় চিকিৎসক, প্রকৌশলী হিসেবে গড়া তোলার স্বপ্নের পাশাপাশি হোয়াই হাউস কিংবা কংগ্রেসে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার উপযুক্ত সময় চলছে। এখনই সে যাত্রা শুরু করলে বিলেতের বাংলাদেশিদের থেকে আমরা আমেরিকার বাংলাদেশিরা হয়তো অনেক দূরে থাকবো কিন্তু লক্ষ্যে একদিন পৌঁছবই। এ লক্ষ্য নিয়ে এগুলে বেশি দিন সময় লাগবেনা আমেরিকা মূলধারার রাজনীনিতে একজন বাংলাদেশি বংশদ্ভোত টিউলিপ, রুশনারা ও রুপা হকের জন্ম হতে।
লেখক: সাংবাদিক।
Posted ১২:৩০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১১ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta