কক্সবাংলা ডটকম(২৩ ডিসেম্বর) :: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, অর্থনীতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব দিনদিন বাড়ছে। এ কারণেই আন্তর্জাতিকভাবে বঙ্গোপসাগর বড় বড় শক্তির নজরে পড়েছে। এটা এখন সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু করতে চায় সরকার।
রোববার (২২ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-বিআইআইএসএসে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
‘বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে পুনরায় সংযোগ’ শীর্ষক এ সেমিনার আয়োজন করে বিআইআইএসএস ও ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিকস (আইডিই-জেট্রো)।
সম্ভাবনাময় অর্থনীতি এবং বঙ্গোপসাগরের প্রতি বৈশ্বিক আগ্রহের কারণে ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দৃশ্যমান। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করছে। যে কারণে ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রতিবেশিসহ পরাশক্তির দ্বন্দ্ব সংঘাতের কেন্দ্রে পরিণত হতে দেবে না বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের অধিকারসহ নিরাপদ প্রত্যাবাসন করতে না পারলে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। নিরাপদ ও সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর এলাকা গড়ে তোলার জন্য স্থিতিশীলতা দরকার। এজন্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সব অংশীজনকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাই।
তিনি আরও বলেন, জাপান এই অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে চায়। বিনয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এটা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষা সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে পরাশক্তিগুলো নিজেদের বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করলেও Check and Balance নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের সৌহার্দপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ভূ-রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকেই বলেন ‘সমুদ্র দখলে যার বিশ্ব দখলে তার’। সেই চিন্তাকে সামনে রেখেই পরাশক্তিগুলোর সমুদ্র দখলের লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (Indo-Pacific region)-এ বঙ্গোপসাগর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অংশ পরিবহন জ্বালানি সম্পদের গমনপথ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলসহ বঙ্গোপসাগরকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের নৌবলয়ে অন্যতম বাণিজ্যিক পথ মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার অভিপ্রায়ে বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম প্রান্তের সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে নানা কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে। রপ্তানি বৃদ্ধিকরণ এবং কৌশলগত বন্দর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য চীনের প্রবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে রয়েছে ইজও BRI (Belt and Road Initiative) Ges Maritime Silk Road’ নীতি।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীনের ‘বন্দর নীতি’ মূলত বঙ্গোপসাগর রুট ব্যবহারের মাধ্যমে কৌশলগত অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রভাব ও ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রবর্তিত। তা ছাড়াও চীন বন্দর নীতির মাধ্যমে সামুদ্রিক অঞ্চলকে নৌশক্তির মাধ্যমে ব্যবহার করার লক্ষ্য হিসেবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, শক্তির সুরক্ষা এবং সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ও রাখতে পারে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের এই কৌশলগত নৌবলয় উদ্দেশ্যকে ‘String of Pearls’ বলে আখ্যায়িত করেছে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও নৌবলয়কে প্রতিহত এবং নিজ প্রভাব বিস্তার করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সুরক্ষা, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক কৌশল গত সংস্থা QUAD গঠন করে। যার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো, চীনের নৌবলয়কে দুর্বল ও ক্রমবর্ধমান শক্তির গতিকে মন্থর করা। তা ছাড়া চীনের Geo-strategy প্রতিহত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র Indo-Pacific Economic Framework for Prosperity চালু করে।
এটি বাণিজ্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতাসহ বিশ্বব্যাপী চীনের অর্থনৈতিক প্রভাবকে ভারসাম্যপূর্ণ করার কৌশল হিসেবেও বিবেচিত হয়। বাংলাদেশ ওচঊঋ-এর সদস্য না হলেও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এর ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের বাণিজ্যিক নীতিগুলোর ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।
তা ছাড়া পূর্ব চীন সাগরের তীরবর্তী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং দক্ষিণ চীন সাগরের তীরবর্তী দেশ ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন। চীনের শক্তিকে প্রতিহত ও কোণঠাসা করার অভিপ্রায়ে দক্ষিণে অবস্থিত বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরকে যুক্তরাষ্ট্রের নিজ বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করে আধিপত্য বিস্তারের বিষয় লক্ষণীয়। বিপরীতে সামরিক ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিহত করতে চীনের বঙ্গোপসাগরে কর্র্তৃত্ব বিস্তার নীতিসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একক Multi polarity হিসেবে উদীয়মান হওয়ার কার্যক্রমও প্রতীয়মান। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ক্ষেত্রেও বঙ্গোপসাগরের দিকে কৌশলগত দৃষ্টি বিদ্যমান। ভারত তার আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখতে বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল।
এ দেশের লক্ষ্য বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা অধিগত করে স্থায়ী প্রভাব বজায় রাখা। চীনের কৌশলগত বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প চালু করায় ভারত এই অঞ্চলে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে চায়। ভারত চায় বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভর করে Blue economy এবং Silk Route পুনরুজ্জীবিত করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুটে আধিপত্য বিস্তার করতে। ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য সরবরাহ করার চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণে ভারতের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতির সঙ্গে বিশ্বব্যাপী আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের হিসাব-নিকাশের সমীকরণ ক্রমে জটিল হচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চীন বাংলাদেশকে তার কাছে বৃহত্তম ঋণগ্রহীতা হিসেবে গড়ে তুলেছে। সমুদ্রবন্দরসহ অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ এবং অর্থায়নে চলা প্রকল্পে বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণে রয়েছে চীনের কূটনৈতিক তৎপরতা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘Visa Restrictions’ সহ বিভিন্ন বিষয় লক্ষণীয়। বঙ্গোপসাগর ঘিরে বা কাছাকাছি দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে থাইল্যান্ডের সঙ্গে চীনের মৈত্রী দীর্ঘদিনের আবার মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সখ্য আছে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গোপসাগর ভারতের জন্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে ব্রিটেনের কাছ থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কর্তৃত্ব পাওয়ার পর থেকেই ওই অঞ্চলকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। দেশটির একটি যৌথ কমান্ড কাজ করছে সেখানে। কারণ এটি মালাক্কা প্রণালির পশ্চিম দিকের অংশ, যেখান দিয়ে চীনের জাহাজ চলাচল করে এবং দেশটির মোট বাণিজ্যের বড় অংশই এ পথে হয়।
যে কারণে এলাকাটি নিয়ন্ত্রণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত নজরদারি করে আসছে। মূলত চীন সাগর থেকে বের হয়ে এসে ভারত মহাসাগরে আসতে হলে মালাক্কা ছাড়া উপায় নেই। এর দক্ষিণে সিঙ্গাপুর। আরেকটু দক্ষিণে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এসব বিষয় বিবেচনা করে সিঙ্গাপুরে যুক্তরাষ্ট্র একটি ঘাঁটি তৈরি করেছে ২০০৮ সালে। মূলত চীনের কারণে মালাক্কা প্রণালির নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এটি করেছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগে বঙ্গোপসাগরের ভূমিকা, ভূরাজনৈতিকভাবে বঙ্গোপসাগরে পরাশক্তিগুলোর অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা, অন্যতম বাণিজ্যিক পথ মালাক্কা প্রণালি, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের সংযোগ এবং সর্বোপরি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত জিও পলিটিক্যাল সারফেজ বিশ্লেষণ করে কোন ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে তা বিশ্লেষকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতির কোনো বিকল্প নেই।
Posted ১:০১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta