কক্সবাংলা ডটকম(১৭ জুন) :: অনেক দিন ধরেই বৈশ্বিক রাজনীতিতে একক পশ্চিমা কর্তৃত্ব আর খাটছে না। ক্ষমতা পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে যেন খানিকটা হেলেও পড়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া। রয়েছে ভারতও।
ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বাংলাদেশের দিকে সবসময়ই চোখ রয়েছে এসব পরাশক্তির। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই বৈশ্বিক রাজনীতির ছায়া ক্রমেই আরও স্পষ্ট করে দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশে।
কূটনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রত্যেকেই বাংলাদেশে নিজ নিজ স্বার্থ ও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে হাতিয়ার করে নিয়েছে।
করোনা অতিমারি মোকাবিলার পরপরই বিশ্বকে মুখোমুখি হতে হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের। বিশ্বের সর্বত্রই এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যার প্রভাব পড়েছে খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থনীতিতে। বৈশ্বিক উত্তেজনার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশেও। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে পশ্চিমা বিশ্ব সহ শক্তিশালী সব রাষ্ট্রেরই বাড়তি মনোযোগ রয়েছে। যার মধ্যে চীনের ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) পলিসি রয়েছে।
অন্যদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এখন সরাসরি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যার একদিকে পশ্চিমা বিশ্ব, অন্যদিকে রাশিয়া-চীন। আবার এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের একাধিক স্থানে খণ্ড খণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
তাইওয়ান ইস্যু মাথা চারা দিয়েছে, চীনের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব আর ইরানের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তুরস্ক একদিকে সংকট কমাতে যেমন মধ্যস্থতা করছে আবার অন্যদিকে দেশটি উত্তেজনা ধরে রাখতে অব্যাহতভাবে অস্ত্র বিক্রি করছে। সবমিলে দিনকে দিন বৈশ্বিক পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে এবং বিশ্বে সংকট বাড়ছে। এই সংকটের মূলে রয়েছে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের চাবি কার হাতে থাকবে সেই প্রশ্ন।
বিশ্ব -নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নের বাইরে নেই বাংলাদেশও। ২০২৪ সালের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিমা বিশ্ব সরব হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভিসানীতি ঘোষণা করে অবাধ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বাধা দিলে সংশ্লিষ্টদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
এদিকে চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এমন নিষেধাজ্ঞা দিলে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বেইজিং। ভারত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এখনও সরাসরি কোনো অবস্থান না নিলেও দিল্লি পরিস্থিতিকে কঠোর নজরদারিতে রেখেছে।
আভাস পাওয়া গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার কারণে বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে বেশি করে ঝুঁকে না পড়ে হোয়াইট হাউসকে সে ব্যাপারে সতর্ক করবে ভারত।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ও বাংলাদেশ ইস্যু আলোচনায় থাকবে বলে কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে কদিন আগে জানিয়েছে কলকাতা ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা।
সবসময়ই হেভিওয়েট রাষ্ট্রগুলো বিশ্বে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা কম শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে চাপে রাখার কৌশল প্রয়োগ করে। এভাবে তারা দেশগুলোকে নিজেদের পক্ষে রাখার চেষ্টা করে।
কূটনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, নিজেদের স্বার্থেই আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের আসন্ন ভোট নিয়ে কথা বলছে বা দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করছে। এরা প্রত্যেকেই জানে যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা আছে। যে কারণে তারা বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের পক্ষে বাংলাদেশকে টানতে দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু তথা নির্বাচন নিয়ে সরকারকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে নিজেদের পক্ষে বাংলাদেশকে টানতেই যুক্তরাষ্ট্র ভোট ইস্যুতে চাপে রাখার চেষ্টা করে। আর যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সরকার শুরুতেই জানিয়েছে যে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে কোনো ছাড় দেবে না। যদিও বিশ্বের অনেক দেশই এসব ইস্যুতে বাংলাদেশের থেকে বাজে অবস্থায় আছে কিন্তু সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বক্তব্য নেই।
যেহেতু বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীন যুক্ত হয়েছে, বিভিন্ন ইস্যুতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে তাই এখানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পূর্ণ সমর্থন পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করছে।
তিনি আরও বলেন, তারা জানে ভোট নিয়ে আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা আছে। তাই তারা এই ইস্যুতে সরকারকে চাপে রেখে নিজেদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।
সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাবের ছায়া লেগেছে বাংলাদেশের ভোটে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সখ্যতা বাড়ায় চটেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের ভোট, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এত আগ্রহী হওয়ার পেছনে কাজ করছে বৈশ্বিক রাজনীতি। এসব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপে রেখে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে।
সাবেক সচিব মুন্সী ফায়েজ বলেন, বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের জ্বালানিসহ একাধিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেই সঙ্গে আসন্ন ভোট নিয়েও বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
তিনি বলেন, প্রতিটি রাষ্ট্রেরই বাংলাদেশের ভোটের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সব রাষ্ট্রের প্রকাশভঙ্গি একরকম নয়। সাবেক অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ভোট যত ঘনিয়ে আসবে কূটনৈতিক তৎপরতা তত বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের এক বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, ওয়াশিংটন যেন বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ না নেয়।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান গত বুধবার নয়াদিল্লিতে ওই বৈঠক করেছেন।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, প্রতিনিধি পর্যায়ের এই বৈঠকের আলোচনায় বাংলাদেশ ইস্যুও স্থান পেয়েছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন। মোদির ওই সফরের আগে দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক হয়।
এশিয়াজুড়ে, বিশেষ করে এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল (আইওআর) ঘিরে চীনের উচ্চাকাক্সক্ষার বিষয়টি এ বৈঠকে অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে বলে জানা গেছে।
ভারতের দুই প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে যথাক্রমে চলতি বছরের শেষ দিকে এবং আগামী বছরের শুরুর দিকে জাতীয় নির্বাচন হবে।
ভারতের অভিমত হলো, তার প্রতিবেশী দেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া উচিত হবে না, যা নয়াদিল্লির জাতীয় স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র সফরেও সময়ও বাংলাদেশ ইস্যু আলোচনায় থাকবে বলে কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে কদিন আগে জানিয়েছে কলকাতাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা।
আভাস পাওয়া গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার কারণে বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে বেশি করে ঝুঁকে না পড়ে হোয়াইট হাউসকে সে ব্যাপারে সতর্ক করবে ভারত।
Posted ১:১৬ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৭ জুন ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta