
কক্সবাংলা ডটকম(২৮ আগস্ট) :: প্রায় এক হাজার একর জমির মাঝখানে আয়নায় মোড়া এক প্রাসাদ। তার নাম ‘বাবা কি গুফা’। দামি আসবাব, সোফা, পর্দায় সাজানো বিলাসবহুল সেই প্রাসাদেই বাস গুরমিত রাম রহিম সিংহের। গুফায় তাকে ঘিরে থাকেন ২০০ জনেরও বেশি বাছাই করা শিষ্যা। তাদের চুল খোলা। পরনে সাধ্বীদের মতো দুধসাদা রঙের পোশাক। এরাই রাম রহিমের যতœআত্তি, দেখভাল করেন।
এমনই দুই শিষ্যাকে ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং। এক সময়ে বাবার ‘গুফা’য় অতিথি হওয়া বিহারের সাংবাদিক পুষ্পরাজ জানিয়েছেন, সেখানে আছে মেয়েদের স্কুল ‘পরীলোক’। তার সব শিক্ষার্থীই সুন্দরী। কারণ, গুরু মনে করেন ‘খুবসুরত’ হলেই মেধাবী হয়।
সেই গুফায় প্রবেশাধিকার আছে মাত্র কয়েকজনের। তাও আঙুলের ছাপ, চোখের মণির মতো বায়োমেট্রিক তথ্য মিললে তবেই ভিতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। ধর্মগুরু হলেও রাম রহিমের পছন্দ শিফনের রংবেরঙের জামা, বাহারি জুতো। তার জামাকাপড় তৈরির জন্য নিজস্ব ফ্যাশন ডিজাইনার রয়েছেন। রয়েছেন নিজস্ব ‘হেয়ার ড্রেসার’। রাম রহিমের কনভয়ে বিলাসবহুল ১০০টি গাড়ি। তার মধ্যে ১৬টি কালো রঙের ফোর্ড এনডেভার। তিনি প্রাসাদ থেকে বের হলে সব গাড়ি তাঁবু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।
তিনি নিজেই ঠিক করেন, কোন গাড়িতে উঠবেন। আশ্রমে নিজের ব্যাটারিচালিত গাড়িতেই ঘোরেন তিনি।সিরসায় ডেরা সচ্চা সৌদার এই সদর দফতর আসলে নিছক আশ্রম নয়। ছোটখাটো শহর। ডেরার ভিতরেই চাল, ডাল, আনাজের চাষ হয়। হোটেল, সিনেমা হল, স্কুল, রেস্তোরাঁ, মালটি স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, স্টুডিও, বায়োগ্যাস কারখানা, পেট্রুলপাম্প, সংবাদপত্রের ছাপাখানা সবই রয়েছে।
এক সঙ্গে ১০ হাজার জামাকাপড় কাচার ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াশিং মেশিনও রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে কন্ট্রোল রুম ও গোটা ডেরায় নজরদারির ব্যবস্থা। সিরসা ছাড়াও দেশে-বিদেশে আরও ৪৬টি আশ্রম রয়েছে রাম রহিমের।
রাম রহিম নিজেকে ‘মেসেঞ্জার অব গড’ বলেন। তার ‘এমএসজি’ ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু-তেল-সাবানের মতো হাজারও সামগ্রীর ব্যবসাও চলে এই আশ্রম থেকেই। আশ্রমে রাম রহিমের প্রবচন শুনতে দিনে গড়ে ৩০ হাজার লোক জড়ো হয়। মাত্র ছ’মিনিট ভক্তদের উপদেশ দেন। তার পরেই মঞ্চে ডিজে উঠে গান বাজাতে শুরু করেন।
মাত্র দু’সপ্তাহ আগেই সিরসার ডেরায় ‘মিউজিক্যাল কার্নিভাল’র আয়োজন হয়েছিল। ১২ আগস্ট রাতের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন অন্তত ৭০ লাখ মানুষ। তিনি ১৫ আগস্টেই ৫০ বছরে পা দিলেন। সেদিন ৩ ইঞ্চি মোটা, ৪২৭.২৫ বর্গফুটের কেক তৈরি হয়েছিল। তার ওপরে একসঙ্গে দেড় লাখ মোমবাতি জ্বালানো হয়েছিল।
আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, ধর্মগুরু রাম রহিম অবশ্য সংসারী। স্ত্রী হরজিত কউর ও তার এক পুত্র এবং দুই কন্যাও রয়েছেন। এ ছাড়াও একটি কন্যা দত্তক নিয়েছেন তিনি- নাম হানিপ্রীত ইনসান। গুরুর ছায়াসঙ্গী ছিলেন তিনি। ডেরাভক্তরা তাকে ‘পাপা’স অ্যাঞ্জেল’ বলে চেনেন এবং মানেনও।
ডেরা সচ্চা সৌদার প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিংহের তিন মেয়ের মধ্যে অন্যতম এই হানিপ্রীত ইনসান। তাকেই এখন রাম রহিমের উত্তরসূরি হওয়ার অন্যতম দাবিদার বলে মনে করা হচ্ছে। হানিপ্রীতের আসল নাম প্রিয়ঙ্কা তানেজা। সোস্যাল মিডিয়ায় তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। ফেসবুকে তার ভক্তের সংখ্যা ৫ লাখ।
ভক্তদের অনেকে মনে করেন, তার সিদ্ধান্তই ‘বাবা’র সিদ্ধান্ত। হানিপ্রীত রাম রহিমের পালিত কন্যা হলেও গুরুর খুবই ঘনিষ্ঠ। আর সে কারণেই নাকি খুব অল্প সময়েই তার উত্থান। হিসারের ফতেহবাদের এক সাধারণ ঘরের মেয়ে প্রিয়ঙ্কা। ১৯৯৯-এ সিরসার এক ডেরাভক্ত বিশ্বাস গুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সেই সময় থেকেই রাম রহিমের সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা।
প্রিয়ঙ্কা থেকে তিনি পরিচিত হন হানিপ্রীত নামে। রাম রহিমই প্রিয়ঙ্কাকে ওই নাম দেন। ডেরা অনুগামীরা দাবি করেন, ‘বাবা’র কাছে শ্বশুরবাড়ির পণ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন হানিপ্রীত। তারপরই ২০০৯-এ হানিকে দত্তক নেন রাম রহিম। তখন থেকেই গুরুর ছায়াসঙ্গী হানি।
ভারতে হরিয়ানার একটি বিশেষ আদালত শুক্রবার বিতর্কিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিংকে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে। এ ধর্ষণ মামলার রায় নিয়ে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যজুড়ে অচল অবস্থা ও নজিরবিহীন নিরাপত্তার কারণে দেশবিদেশে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন এই বিতর্কিত ধর্মগুরু। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সর্বত্র একই প্রশ্ন কে এই রাম রহিম। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আগেও খবর প্রচারিত হয়েছে।কিন্তু ডেরা সাচ্চা সৌদার লাখ লাখ ভক্ত কেন গুরুর জন্য পাগল? কেন হাজার হাজার ভক্ত গুলি-লাঠির সামনে বুক পেতে দিয়ে দু’টি রাজ্যের রাস্তায় নেমে তান্ডব চালিয়েছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই।
১৯৯০ সালে ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন গুরমিত রাম রহিম সিং। পাঞ্জাব ট্রিবিউনের সিনিয়র সাংবাদিক হামির সিং বহুদিন ধরে রাম রহিম ও তার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাজের সঙ্গে পরিচিত। তিনি বলেন, সে সময়ে পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলন চলছিল। গুর্জন সিং রাজস্থানী নামে এক উগ্রপন্থী নেতা ছিলেন। গুরমিত হচ্ছেন ওই গুর্জন সিংয়ের চাচাতো ভাই।
অনেকের মতে, গুর্জন সিং ও সাবেক এক অতি ক্ষমতাধর পুলিশ প্রধান গুরমিতকে ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান হিসাবে বসান। ডেরার প্রধান তখন বেঁচে থাকা সত্ত্বেও অনেক জমিজমার মালিক এই যুবক গুরমিতকে প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল।
ডেরা সাচ্চা সৌদার মতো আরও অনেক ডেরা আছে পাঞ্জাব হরিয়ানায়। মূলত এসব ডেরা শিখ ধর্মের একেক জন গুরুর অধীনে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রৌণকী রাম বলেন, ডেরার প্রতি ভক্তদের এক রকম অন্ধ বিশ্বাস তৈরি হয়। ভক্তরা মনে করতে থাকে, তারা যা করছে, তাই ঠিক, সত্যের জন্য কাজ করছে। ভক্তদের যে কোনো ধরনের সমস্যার সমাধানও ডেরায়ই দেওয়া হয়, সেটা পানির অভাব হোক বা অন্য কিছু। অর্থাৎ ডেরায় সোশ্যাল ক্যাপিটাল তৈরি করা হয়। এমন কোনো ডেরা পাওয়া যাবে না যার নিজস্ব স্কুল, ক্যান্টিন, কোঅপারেটিভ মেস- এসব প্রতিষ্ঠান নেই।
রৌণকী রাম আরও বলেন, যে কাজগুলো সরকারের বা নাগরিক সমাজের করার কথা, সেগুলোর অভাব মেটায় এই ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ডেরাগুলো। এর ফলে ভক্তদের মনে এসব ডেরার প্রধানের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরি হয়। এর ফলে ডেরাকে ঘিরে রাজনীতি ও গ্রামীণ সমাজ চলতে থাকে। সেগুলো হয়ে ওঠে সমান্তরাল শক্তি কেন্দ্র।
সাংবাদিক হামির সিং বলেন, পাঞ্জাব হরিয়ানার বেশিরভাগ ডেরায় জাঠ সম্প্রদায়ের আধিপত্য। সেখানে দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের কোনো জায়গা নেই। অথচ পাঞ্জাবের জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ দলিত সম্প্রদায়ের। আর ডেরা সাচ্চা সৌদার বেশিরভাগ ভক্তই দলিত সম্প্রদায়ের। তারা অন্যান্য ডেরায় কোনো প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। অথচ রাম রহিমের ডেরায় তারাই সর্বেসর্বা। তাই এই ডেরার প্রতি অসীম আনুগত্য তাদের।
তিনি আরও বলেন, যতোই ভক্ত বাড়তে লাগল রাম রহিম আরও বেশি করে আনুগত্য আদায়ের জন্য দলিতদের বেশি করে জায়গা, মর্যাদা দিতে থাকলেন। এজন্য গুরমিত রাম রহিম সিংসহ ডেরা সাচ্চা সৌদার সব ভক্তের নামের শেষে ‘ইনসান’ অর্থাৎ মানুষ শব্দটা যোগ করা হয়। আর এর মাধ্যমে দলিত ভক্তদের সামাজিক সম্মান দেওয়া হয়। এ কারণেই দ্রুত ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে রাম রহিমের। ভক্তদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা দেখে ডেরায় যাতায়াত শুরু করেন রাজনৈতিক নেতারাও।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ব বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান শমিত কর বলেন, ভারতের সমস্যাটা হলো বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা হোক বা স্বাস্থ্য পরিসেবা- কোনোটাই সিংহভাগ মানুষের কাছে পৌঁছয় না। তাই আদিম অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও এসবের গুরুদের প্রতি অন্ধবিশ্বাস জন্মায় তাদের।
সিনেমার হিরো থেকে শুরু করে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘ইনসান’-এর মর্যাদা দেওয়া, রাজনৈতিক ক্ষমতা আর পেশীশক্তি- এ সবকিছুর মিশেলেই প্রায় আড়াই দশক ধরে গড়ে উঠেছে রাম রহিমের বিশাল সংখ্যক ভক্ত।

Posted ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৮ আগস্ট ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta