কক্সবাংলা ডটকম(১০ জুলাই) :: সৌদি আরব ও অন্য আরব রাষ্ট্রসমূহ কাতারের বিরুদ্ধে তাদের কূটনৈতিক অবরোধের প্রধান কারণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে দেশটির সমর্থনকে দায়ী করছে। কিন্তু একটি ছোট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাতারের আবির্ভাবের মূল কারণ বিশ্লেষণ করলে এই সংকটের ভিন্ন একটি ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। সবাই প্রায়ই ধারণা করে থাকেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল কারণ হলো তাদের ভূগর্ভস্থ তেলসম্পদ।
কিন্তু তেলসম্পদ এই অঞ্চলে সমভাবে বিন্যস্ত নয়, এবং একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদও নয়। তেলসম্পদ নয়, বরং প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের উপস্থিতিই কাতারের বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হিসেবে উত্থানের প্রধান কারণ। বর্তমানে দেশটি পৃথিবীর বৃহত্তম তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের রপ্তানিকারক। এ কারণেই কাতার দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সৌদি আরব বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক এবং ওপেক জোটের প্রধান, যা বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে থাকে। কাতার তেল রপ্তানি করে যে রাজস্ব আয় করে তার চারগুণ বেশি রাজস্ব আয় করে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে। ফলে দেশটি সৌদি আরবের নেতৃত্ব বলয়ে থাকতে কখনোই বাধ্যগত ছিল না। এছাড়াও কাতার যে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে তা তরলীকৃত (এলএনজি), যা জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রপথে পরিবহন করা হয়।
তাই দেশটিকে প্রতিবেশী সৌদি আরবের মধ্য দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে অন্যান্য দেশে গ্যাস রপ্তানির মতো কঠিন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখিও হতে হয়নি। এ কারণেই সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট অবাধ্য কাতারকে শায়েস্তা করতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার মতো শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৩ দফা সংবলিত কঠিন সব শর্তের বেড়াজালে কাতারকে আবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে ১৯৯১-এর ইরাক-কুয়েত সংকটের পর মধ্যপ্রাচ্য কঠিনতম রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে।
কাতারের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উত্স পারস্য উপসাগরের তলদেশে অবস্থিত নর্থ ডোম গ্যাস ক্ষেত্র। এটির উপর কাতার এবং ইরানের যৌথ মালিকানা রয়েছে। এ কারণেই কাতার মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও ইরানের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখছে।
কাতারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেশটির স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। পারস্য উপসাগর তীরের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি আজ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির এক মুখ্য খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দোহা রিয়াদের রাজনৈতিক অবস্থান উপেক্ষা করার পাশাপাশি একাধিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাতেও লিপ্ত হয়েছে।
কখনো আল-জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্কের জনপ্রিয়তার মাধ্যমে, কখনো মুসলিম ব্রাদারহুড ও হামাসের মতো রাজনৈতিক শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে, আবার কখনো ইরান কিংবা তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে মিত্রতার মাধ্যমে কাতার প্রতিনিয়ত মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের স্বার্থকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে।
নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কাতার তার কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার সুযোগটিও হাতছাড়া করেনি। ২০০৩ সাল থেকে কাতারের আল উবাইদ বিমান ঘাঁটিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে ইরাক এবং সিরিয়ায় মার্কিন সামরিক অভিযানসমূহ এখান থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, কাতারে প্রায় ১১ হাজার মার্কিন সৈন্য অবস্থান করছে। পারস্য উপসাগরে গ্যাস ও তেলবাহী ট্যাংকারের চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতেও এ মার্কিন ঘাঁটিটির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।
কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বন্ধ করা সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের দাবিসমূহের মধ্যে অন্যতম। এই ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে উসমানিয়া সাম্রাজ্যের পতনের পর এই প্রথম তুর্কি সেনাবাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে এসেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, এই সেনাঘাঁটি সৌদি আরবের স্বার্থের পরিপন্থি নয়। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আরও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাবে।
২০১৪ সালেও সৌদি আরব ও তার মিত্র আরব রাষ্ট্রসমূহ মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সমর্থনসহ একাধিক কারণে কাতার থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত সরিয়ে নেয়। আলোচনার মাধ্যমে সেবার আট মাস পরে হলেও সংকটের নিরসন ঘটে। কিন্তু বর্তমানে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট আরও প্রকাশ্য ও শক্তভাবে কাতারকে কোণঠাসা করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমান এই সংকটের কারণ হিসেবে অনেকেই নতুন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী নীতিকে দায়ী করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান এই কূটনৈতিক সংকট মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থের জন্য অনেক বড় হুমকি। কারণ এই আরব রাষ্ট্রসমূহের ঐক্য যত দুর্বল হবে, মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী যুদ্ধ আরও কঠিন হয়ে পড়বে এবং একই সঙ্গে ইরানও রাজনৈতিকভাবে এই সংকটের ফায়দা লোটার চেষ্টা হাতছাড়া করবে না।
Posted ২:২৪ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১০ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta