কক্সবাংলা ডটকম(৫ জুন) :: কাতারের সাথে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিশরসহ ছ’টি দেশ শুধু কূটনৈতিক সম্পর্কই ছিন্ন করেনি। একই সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কও ভেঙ্গে পরবে। তাহলে, আঞ্চলিক সম্পর্কের হঠাৎ এই অবনতির কী প্রভাব পরবে কাতারের অর্থনীতিতে এবং সেই দেশের অধিবাসীদের ওপরে?
মাত্র ২৭ লক্ষ মানুষের বসবাস আরব উপদ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই ছোট রাষ্ট্রে। তবে কাতার তার ওজনের চেয়ে অনেক ওপরের পর্যায়ে খেলার চেষ্টা করে।
মানুষ কাতারকে চেনে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে আংশিকভাবে দেশের জাতীয় বিমান পরিবহন সংস্থা কাতার এয়ারওয়েজকে এবং তার আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরাকে।
আরো পরিচিতি এসেছে ক্রীড়া জগতে কিছু সাফল্যের মাধ্যমে, যেমন ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকার অর্জন এবং বিশ্বের সব চেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল দলগুলোর মধ্যে অন্যতম বার্সেলোনাকে স্পন্সর করে।
আর রাজধানী দোহার ব্যাপক আধুনিক উন্নয়নের মাধ্যমে অনেক বহুজাতিক কোম্পানিকে সেখানে অফিস খুলতে অকৃষ্ট করেছে। কাজেই, এই সংকট অনেক কিছুকেই প্রভাবিত করতে পারে।
বিমান পরিবহন
আবু ধাবির এতিহাদ এয়ারওয়েজ এবং দুবাই-ভিত্তিক এমিরেটস মঙ্গলবার থেকে তাদের দোহাগামী বা দোহা থেকে সকল ফ্লাইট স্থগিত করবে। বর্তমানে এই দুই বিমান সংস্থা দোহাতে দিনে চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করে।
স্বল্প ব্যয়ের বিমান সংস্থা ফ্লাইদুবাই এবং এয়ার অ্যারাবিয়াও তাদের দোহা ফ্লাইটগুলো বাতিল করছে। ধারনা করা হচ্ছে অন্যান্য বিমান সংস্থা যেমন বাহরাইনের গালফ এয়ার এবং মিশরের ইজিপ্টএয়ারও তাদের দোহা ফ্লাইট বাতিল করবে।
এর আগে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর ঘোষণা করে যে তারা কাতারের সাথে বিমান যোগাযোগ ছিন্ন করবে এবং নিজেদের আকাশপথ কাতার এয়ারওয়েজের জন্য বন্ধ করে দেবে।
কাতারের জাতীয় বিমান সংস্থা এখানে সব চেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রথমত, দুবাই, আবু ধাবি, রিয়াদ এবং কায়রোর মত জায়গায় তাদের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে। তার মানে, দিনে কয়েক ডজন ফ্লাইট।
তারা ইতোমধ্যেই সৌদি আরবের সাথে তাদের সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে।
কিন্তু অঞ্চলের আকাশপথের একটি বড় অংশ তার জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বাধ্য হবে তাদের যাত্রাপথ বদলাতে। এর ফলে অনেক রুটে সময় বেশি লাগবে।
সময় বাড়লে শুধু বেশি জালানি খরচ হবে তাই না, যাত্রীদের মন-মেজাজও খারাপ হতে পারে।
কাতার এয়ারওয়েজ তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে নিজেকে একটি ‘হাব এয়ারলাইন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, দোহার মাধ্যমে ইউরোপ এবং এশিয়াকে যুক্ত করে।
”ইউরোপে যাবার যে যাত্রা আগে ছয় ঘণ্টা লাগতো, সেটা যদি এখন রুট বদল করার ফলে আট-নয় ঘণ্টা লাগে তাহলে যাত্রীদের জন্য আর সুবিধাজনক থাকবে না এবং তারা বিকল্প খুঁজতে পারে,” বলছেন করনারস্টোন গ্লোবাল নামে একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির পরিচালক ঘানেম নুসেইবেহ।
খাদ্য
মরুভূমির দেশগুলোর স্বাভাবিক কারণেই খাদ্য ফলাতে কষ্ট হয়। খাদ্য নিরাপত্তা কাতারের জন্য বড় একটি বিষয়, কারণ স্থলপথে দেশে প্রবেশ করার একটিই পথ এবং সেটা হচ্ছে সৌদি আরব সীমান্ত দিয়ে।
প্রতিদিন শত শত ট্রাক এই সীমান্ত দিয়ে আসে এবং খাদ্যদ্রব্য তাদের মালামালের একটি বড় অংশ। ধারনা করা হয় কাতারের খাদ্য আমদানির ৪০ শতাংশ এই পথে আসে।
সৌদি আরব বলেছে তারা এই সীমান্ত বন্ধ করে দেবে এবং ট্রাক আসা বন্ধ হলে কাতার বিমান এবং সমুদ্রপথে মালামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরবে।
”এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে যেটা সাধারণ মানুষকে সরাসরি আঘাত করবে,” বলছেন মি: নুসেইবেহ।
”যদি জিনিসপত্রে দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে, তাহলে আপনি দেখবেন সরকার বদলের দাবীতে বা দেশের নীতি পরিবর্তনের জন্য রাজকীয় পরিবারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়তে থাকবে।”
নির্মাণ শিল্প
কাতারে এই মুহূর্তে কয়েকটি বড় নির্মাণ প্রকল্প চলছে, যাদের মধ্যে আছে একটি নতুন বন্দর, মেডিকেল এলাকা, মেট্রো প্রকল্প এবং ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য আটটি স্টেডিয়াম।
নির্মাণ শিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন কনক্রিট এবং ইস্পাত জাহাজে আসলেও, স্থলপথ দিয়ে সৌদি আরব হয়েও আসে।
সীমান্ত বন্ধ হলে খাদ্যদ্রব্যের মত নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং কাজ সময়মত শেষ করা কঠিন হয়ে যাবে।
দীর্ঘ সময়ের জন্য আকাশপথ এবং স্থলপথ বন্ধ হলে বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সময়সীমা হুমকির মুখে পরতে পারে।
জনগণ
সৌদি সরকার বলেছে সম্পর্ক ছিন্ন করার অংশ হিসেবে, সৌদি আরব, মিশর, বাহরাইন, আরব আমিরাত, লিবিয়া এবং ইয়েমেনের নাগরিকদের কাতারে যাওয়া, সেখানে বসবাস করা বা কাতার হয়ে অন্য কোন দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তাদেরকে ১৪ দিনের মধ্যে কাতার ছাড়তে বলা হয়েছে। একই সাথে, সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং বাহরাইনে বসবাসরত কাতারিদেরও একই সময়ের মধ্যে চলে যেতে বলা হয়েছে।
তবে মিশর যদি একই রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহলে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, কাতারে এক লক্ষ আশি হাজার মিশরীয় নাগরিক বাস করছে, যাদের বেশিরভাগ নির্মাণ শিল্পের পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি এবং আইন পেশায় কর্মরত।
এই বিশাল কর্মী বাহিনী কাতার ছেড়ে চলে গেলে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো কঠিন সমস্যার মধ্যে পরবে।
এছাড়া আল জাজিরায় কর্মরত সৌদি সাংবাদিকদেরও বাড়ি ফেরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সৌদি সংবাদ সংস্থা আজেল মিডিয়ার বরাতে এই খবর জানিয়েছে রাশিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা স্পুটনিক নিউজ।
এতে বলা হয়, সোমবার কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব, বাহরাইন, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। একই পদক্ষেপ নেয় লিবিয়া, ইয়েমন এবং মালদ্বীপ।
এরপরই কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে সৌদি আরব।
স্পুটনিক জানায়, সৌদির রাজধানী রিয়াদে আরব ইসলামি আমেরিকান সম্মেলনের এক সপ্তাহের মাথায় দোহার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা আসে।
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করতে চান বলে কাতারের আমিরের একটি বক্তব্য প্রচার করে দেশটির একটি সংবাদ সংস্থা।
এরপর কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, যে সংবাদ সংস্থায় বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে তা হ্যাক হয়েছিল।
আর আমিরের বক্তব্য হ্যাকাররাই প্রচার করেছে জানিয়ে এ ক্ষেত্রে তার কিছুই করার ছিল না।
তবে এ বক্তব্যের পরেও সৌদি, আমিরাত এবং বাহরাই মনে করে ইরানের সঙ্গে সত্যিই কাতারের আমির সম্পর্ক সহজ করতে চান।
প্রসঙ্গত, ইরানের সঙ্গে আরব দেশগুলোর বৈরিতা চলছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কারণে সৌদি আরবের সঙ্গে দেশটির বিরোধ চলছে।
কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নকারী দেশগুলোর অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় দোহা বলেছে, ‘ভিত্তি নেই’ এমন অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ঐ সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে এবং এটি ‘অন্যায্য’ একটি সিদ্ধান্ত।
কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য জঙ্গি দলগুলোকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেয় এবং মধ্যপ্রাচ্যে কাতার উত্তেজনা সৃষ্টি করছে, এই অভিযোগে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সৌদি আরব, মিসর, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
নজিরবিহীন এই সিদ্ধান্তকে দেখা হচ্ছে গাল্ফ অঞ্চলের দেশগুলো, যারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তাদের সাথে কাতারের সম্পর্কচ্ছেদ হিসেবে।
এর সাথে গাল্ফভুক্ত দেশগুলোর সাথে ইরানের সাম্প্রতিক উত্তেজনার একটি প্রভাব রয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রক্রিয়া প্রথমে শুরু করে বাহরাইন। পরে সৌদি আরব, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্পর্কচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়।
গাল্ফভুক্ত দেশগুলো তাদের দেশে অবস্থানরত কাতারের নাগরিকদের দেশ ত্যাগের জন্য দুই সপ্তাহ সময় বেধে দিয়েছে।
সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হঠাৎ এলেও, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কাতারের সম্পর্কের টানাপড়েনের শুরু কয়েক বছর আগে, যা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দুই সপ্তাহ আগে গত ২৫শে মে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আল জাজিরা নেটওয়ার্কসহ কাতারের সংবাদ বিষয়ক সকল ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয় এই চারটি দেশ।
বিতর্কিত ঐ ঘটনায় দেখা যায়, কাতারের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমে আমির সৌদি আরবের সমালোচনা করেছেন।
ঐ প্রতিবেদনে আমিরকে উদ্ধৃত করে আরো বলা হয়, তিনি ইরানের প্রতি আরব দেশগুলোর বিরোধিতার সমালোচনা করছেন।
যদিও পরে কাতার তখন দাবী করে পুরো ঘটনাটি ভুয়া। কারণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা হ্যাক হয়েছিল এবং ঐ খবর সাইটটি হ্যাক হবার পর প্রকাশিত হয়েছিল বলেও দাবী করে কাতার।
তবে, মূলত দুটি বিষয় কাজ করেছে এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে। এক, জঙ্গি সংগঠনসমূহের সঙ্গে কাতারের সংযোগ, আর দুই আঞ্চলিক রাজনীতিতে সৌদি আরবের প্রতিপক্ষ ইরানের ভূমিকা।
আইএস গোষ্ঠীকে ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটে কাতার যোগ দিয়েছে ঠিকই।
তবে, সেই সঙ্গে ইরাকের শিয়া নেতারা অভিযোগ করে আসছিলেন যে কাতার আইএসকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে।
যদিও এ অভিযোগও অস্বীকার করে আসছে কাতার।
আবার সিরিয়ার কট্টর ইসলামী গ্রুপগুলোকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তার অভিযোগও রয়েছে দেশটির বিরুদ্ধে।
আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট নুসরা ফ্রন্টের সঙ্গে কাতারের সংযোগের অভিযোগও রয়েছে।
এছাড়া সুন্নি প্রধান দেশ সৌদি আরব বরাবরই বাহরাইনের শিয়া জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছে।
দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিয়াদ সফরের সময় মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার জন্য ইরানকে দায়ী করেন।
Posted ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta