কক্সবাংলা ডটকম(৭ জানুয়ারি) :: মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান এই মুহূর্তে ভারত সফরে রয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, বাইডেন প্রশাসনের শেষ সময়ে জ্যাক সুলিভান কেন দিল্লিতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিদায় নেবেন ২০ জানুয়ারি।
সেই হিসেবে, ডেমোক্র্যাট সরকারের হাতে সময় আছে মাত্র ১৩ দিন। এরপর আর তারা ক্ষমতায় নেই। তবু এই সময়ে তার এই সফর নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
পাশাপাশি সুলিভানের দিল্লি সফরের কারণে বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কোনো বিষয় আছে কিনা অথবা তার এই সফরটিকে বাংলাদেশ বিশেষভাবে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে কিনা- এমন আলোচনাও রয়েছে কূটনৈতিক মহলে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে কিছু বলা না হলেও সুলিভানের দিল্লি সফর নিয়ে ঢাকার যে কৌতূহল রয়েছে তার আভাস পাওয়া গেছে।
অপরদিকে বিশ্লেষকরা বলেছেন, সফরের বিষয়ে ঢাকার নজর রাখা উচিত।
সংশ্লিষ্টদের মতে, শেখ হাসিনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তান নানা মাত্রায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। সেই আবহেই আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তথা উপপ্রধানমন্ত্রী ইশহাক দার। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশকে ‘হারিয়ে যাওয়া ভাই’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
অপরদিকে, বাংলাদেশও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা করছে এবং ক্রমেই তা দৃশ্যমান হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে চীনের ভূমিকা কী দাঁড়াচ্ছে, তা নিয়েও ভূ-রাজনীতিতে নানা আলোচনা আছে।
ধারণা করা হচ্ছে দিল্লিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং দেশটিকে নিয়ে চীন ও পাকিস্তানের আগ্রহের বিষয় নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মকাণ্ডও সেই আলোচনায় স্থান পেতে পারে। এসব বিবেচনায় নিয়ে জ্যাক সুলিভানের দিল্লি সফরকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে।
জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, বিভিন্ন কারণে দিল্লির সঙ্গে জ্যাক সুলিভানের আলোচনায় চীন ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসতে পারে।
বাংলাদেশকে নিয়ে ঠিক কী আলোচনা হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে কী আলোচনা হতে পারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে অনুমান করা যায়, ওই আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মিয়ানমার সীমান্ত নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
পাশাপাশি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়েও ভারত যাতে সহায়তা করে; সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে সম্পর্ক বিরাজ করছে তাতে এ অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। ওয়াশিংটন হয়তো দিল্লিকে বলবে, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মধ্য দিয়ে শান্তি স্থাপন করলে দুদেশই উপকৃত হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিডিউল অনুযায়ী মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা দুদিনের সফরে রবিবার দিল্লি এসেছেন।
সোমবার তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করেন। সুলিভান বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গেও।
সোমবার বৈঠকের পর ‘এক্স’ হ্যান্ডলে ড. এস জয়শঙ্কর বলেন, দুদেশের (ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা আরো বাড়াতে যা যা করা দরকার, সেই আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। চার বছর ধরে চলমান এই আলোচনায় খোলামেলা মনোভাব দুদেশের কাছেই মূল্যবান।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক দৃঢ় করতে তার ব্যক্তিগত অবদান উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কমিউনিকেশনস উপদেষ্টা জন কার্বি এই সফর প্রসঙ্গে বলেছেন, মহাকাশ, প্রতিরক্ষা, সামরিক প্রযুক্তি সহযোগিতাসহ সম্পর্কের সব দিক নিয়ে সুলিভান আলোচনা করবেন। আলোচনা হবে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়েও।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, জ্যাক সুলিভান বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি কিন্তু ট্রাম্পের দূত হয়েই ভারতে এসেছেন। তার আসার কারণ হচ্ছে, ট্রাম্পের হয়ে আগাম রাস্তা পোক্ত করা। কারণ খুব বেশি ব্যতিক্রম ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন হয় না।
সুতরাং পররাষ্ট্র নীতিতে তাদের যা অবস্থান, যা নীতি সেটিই তারা ধরে রাখার চেষ্টা করে। জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এখন ওয়াশিংটন ফিরে গিয়ে জ্যাক সুলিভান এমন কিছু প্রতিবেদন রেখে যাবেন যা ট্রাম্প প্রশাসন এসে বাস্তবায়ন করবে। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করও ৬ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন।
এদিকে ভারতের গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়ে জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টার বৈঠকের খবর তুলে এনেছে। তারা এ-ও বলেছে, বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও এসেছে। প্রসঙ্গত, গত ২৪ ডিসেম্বরে জ্যাক সুলিভান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসকে ফোন করেছিলেন। ওই ফোনালাপ নিয়ে অনেকের আগ্রহ ছিল।
এরপর ড. ইউনূসের প্রেস উইং এবং হোয়াইট হাউস বিবৃতি দেয়। দুই বিবৃতির মধ্যে বেশ ফারাক ছিল।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল- গত সাড়ে চার মাসে ড. ইউনূসের নেতৃত্বকে প্রশংসা করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নির্বাচন এবং অন্যান্য সংস্কারের যে অগ্রগতি হয়েছে তার জন্য জ্যাক সুলিভান প্রধান উপদেষ্টার প্রশংসা করেছেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করার জন্য ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য মার্কিন সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছেন।
এর বিপরীতে হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে নিজেদের সম্মান ও অধিকার নিশ্চিতের কথা জানিয়েছেন জ্যাক সুলিভান।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তিনি থাকছেন না; তবু দিল্লি সফরে এসেছেন। এজন্য সফরের গুরুত্ব কতটুকু তা বলা মুশকিল। তার মতে, জ্যাক সুলিভান হয়তো দিল্লিকে বলতে চাইবেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রশাসন এলেও ভারতকে নিয়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
সব মিলিয়ে এই সফরের উদ্দেশ্য হতে পারে, হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন সম্পর্কে দিল্লিকে অবহিত করা, নয় বিরোধী দল হিসেবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে; সেটি গুরুত্ব দিয়ে দেশটিকে বুঝিয়ে বলা।
পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রশাসন আসার পর বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের মনোভাব পরিবর্তন হবে কিনা- সেটিও সুলিভান জেনে নিতে চাইবেন।
বিশ্লেষকদের মতে, জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টদের আলোচনায় যা-ই থাকুক না কেন ভারতের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসা হচ্ছে এবং ট্রাম্প প্রশাসন কিংবা বাইডেন প্রশাসনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে।
এর পাশাপাশি ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর সব জায়গায় আলোচনা হচ্ছে, ট্রাম্পের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্পর্ক ততটা ভালো নয়, যতটা হিলারি ক্লিনটন কিংবা বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ছিল।
সব মিলিয়ে জ্যাক সুলিভানের দিল্লি সফরে বাংলাদেশের যে দুশ্চিন্তা রয়েছে- তা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কথায়ও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। দুদিন আগে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজে প্রধান উপদেষ্টার একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সেই সাক্ষাৎকারে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনেক ভালো সম্পর্ক।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের কেবিনেটে ভারতীয় বংশদ্ভেূাত সাতজন মন্ত্রী আছেন বলে জানা গেছে। আপনার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক ভালো বলে মানুষ মনে করে।
ভারত ও যুক্তারাষ্ট্রের মধ্যে এমন সম্পর্কের মধ্যে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আপনি মনে করেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেছেন, এত ঘনিষ্ঠতা থাকলে হতে পারে। বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। কারণ ভারতীয় বংশদ্ভেূাত ব্যক্তি যদি ওখানে ক্ষমতায় থাকে তার একটা প্রভাব পড়তেই পারে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের একটা টার্গেট আছেই। এ অবস্থায় জ্যাক সুলিভানের এই সফরে বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্ব ইঙ্গিত করছে- তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে। তবে এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চোখে কখনোই বাংলাদেশকে দেখে না; এটি বারবার বলার চেষ্টা করেছে। তবে এই অঞ্চলে চীনকে প্রতিরোধের জন্য ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন এবং এর ফলে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপরে কী প্রভাব ফেলবে তা ইতোমধ্যেই কূটনৈতিক চর্চার বিষয় হয়েছে। প্রতিবেশী হিসেবে দীর্ঘতম সীমান্ত ভাগ করে নেয়া ভারতের জন্যও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
কূটনৈতিক মহলের একাংশের বক্তব্য, গত সেপ্টেম্বরে ইউনূস আমেরিকা সফরে গিয়ে বারাক ওবামা, বিল ক্লিন্টনসহ ডেমোক্র্যাট নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেও ট্রাম্প বা কোনো রিপাবলিকানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। তবে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার অভিনন্দন জানিয়েছে।
Posted ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারি ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta