কক্সবাংলা ডটকম(১৮ জুন) :: প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে উত্তর আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের ‘মিসরীয় সভ্যতা’ অন্যতম। নীল নদের তীরবর্তী এই সভ্যতাটি গড়ে ওঠে খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৫০ অব্দে। প্রথম ফারাওয়ের অধীনে উচ্চ ও নিম্ন মিসরের রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে এই সভ্যতার উৎপত্তি হয়।
প্রাচীন মিসর মূলত কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র ছিল। তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের উৎপাদিত সকল ভোগ্যপণ্য জমা করা হত রাষ্ট্রীয় তহবিলে বা মন্দিরগুলোতে। পরবর্তীতে এগুলো প্রত্যেকের প্রয়োজন অনুসারে নিরপেক্ষভাবে জনগণের মাঝে বন্টন করে দেয়া হত।
বাড়তি পণ্যগুলো স্থানীয় বাজারে বাণিজ্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হত। ফলে অর্থনীতিতে বিদ্যমান সরবরাহ প্রবাহের যেকোনও ঘাটতি পূরণ হয়ে যেত। এই বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী বণিকরা দ্রব্যের বিনিময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতো। তাদের কাজ ছিল সরকারি তহবিলের উদ্বৃত্ত পণ্য বাজারে নিয়ে বিক্রি করা। তারা যতটা সম্ভব এই উদ্বৃত্ত পণ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানোর চেষ্টা করত। তবে নিজ স্বার্থের জন্য কাজ করা বণিকদের অস্তিত্ব প্রাচীন মিসরের নতুন রাজাদের সময়ে বেশি ছিল।
প্রাচীন মিসরের চিত্রকর্ম দেখে বোঝা যায় তখনকার বাজারে বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল। চিত্রে বিক্রেতাদের মাটিতে বা টুলে বসে ডেকে ডেকে পণ্য বিক্রি করতে দেখা যায়। অন্যদিকে ক্রেতাদের দেখা যায় ব্যাগভর্তি পণ্য কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেগুলোর বিনিময়ে তারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারবে।
বাজারে সাধারণত খাদ্যজাতীয় দ্রব্যাদি যেমন, রুটি, বিয়ার, মাছ, শুঁটকি, মাংস, ফলমূল ও শাকসবজি বিক্রি করা হত। এসব পণ্য চামড়া, চন্দন গুঁড়ো, আগুনে বাতাস করার জন্য বড় আকারের ফ্যান, অলঙ্কৃত হাতলযুক্ত হাঁটার জন্য ব্যবহৃত লাঠি, আসবাবপত্রের টুকরা ইত্যাদির বিনিময়ে বিক্রি করা হত। সিরামিকের পাত্র এবং তামার তৈরি আয়না, মাছ ধরার হুক, বাটালিও আনা হত বাজারে। এছাড়া দাস বিক্রির প্রথা তো ছিলই।
বিলাসদ্রব্যের মধ্যে লিনেন কাপড় ছিল অন্যতম। এই কাপড় উৎপাদিত হত রাষ্ট্রপরিচালিত বুনন কারখানায়। পরিমাপ অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হত। তবে একদামেই বিক্রি হত এসব কাপড়।
যেকোনো দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণের জন্য দুই ধরনের একক ব্যবহৃত হত। একটা ছিল ‘হেকাত’ পরিমাপ যা মজুরি হিসেবে কতটুকু দ্রব্য দেয়া হবে সেটা পরিমাপ করত। আরেকটা ছিল ‘শাত’ পরিমাপ যা দ্রব্যের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত হত।
কয়েন প্রচলনের আগে প্রথম সহস্রাব্দে মিসরে বিভিন্ন ধরনের মুদ্রার ব্যবহার ছিল। ধাতু থেকে কয়েন তৈরির কয়েকশ বছর আগে প্রাচীন মিসরে ব্যবহৃত এই মুদ্রাগুলো ছিল স্বর্ণ আর রূপার তৈরি বিভিন্ন আকৃতির জিনিসপত্র যেমন, রূপার আংটি ও স্বর্ণের তৈরি ভেড়া।
প্রাচীন মিসরীয়রা প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সাথে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত ছিল। তারা পাথর, মৃৎপাত্র, লিনেন, প্যাপিরাস, ডাল, স্বর্ণ এবং শুঁটকি রপ্তানি করত।
আমদানি দ্রব্যের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল কাঁচামাল যা উচ্চবিত্তদের বিলাসপণ্য তৈরির জন্য আনা হত। প্রাচীন মিসরের প্রথম এবং একমাত্র রাজা ছিল ফারাওরা। তারা শুধু রাজনৈতিক নেতাই নয় ধর্মীয় নেতাও ছিল।
প্রাচীনকালে মিশরীয়রা মৃত্যুর পরও তাদের আত্মা বেঁচে থাকে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো। তাই পরকালের জীবনটাও যাতে উপভোগ করা যায় সে ব্যবস্থা করতেই পিরামিড তৈরি করতে শুরু করে। তাদের আত্মার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে দেয়া হত তাদের মৃতদেহের মমির সাথে। খাবার দাবার, ফলমূল থেকে শুরু করে অর্থ, স্বর্ণ এবং অন্যান্য বিলাস দ্রব্য দেয়া হত এর সাথে। এসব সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োগ দেয়া হত পিরামিড প্রধানদের।
বিশালায়তনের পিরামিড প্রাচীন মিসরের ফারাওদের সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হলেও জনজীবনে এর প্রভাব ছিল অনেক গুরত্বপূর্ণ। একটা বড় পিরামিড তৈরি করতে এক লক্ষ শ্রমিকের টানা ২০ বছর কাজ করতে হত। তাই প্রাচীন মিসরের অর্থনীতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল পিরামিড।
পিরামিড বানানোর জন্য ফারাওরা দাসদেরকে ব্যবহার করেনি। কৃষক ও সাধারণ জনগণের হাতেই তৈরি হয়েছে এই পিরামিড। বছরের একটা সময় নীলনদের বন্যায় প্লাবিত হয়ে কৃষিপ্রধান এই অর্থনীতির কৃষিকাজ বন্ধ থাকতো। তখনই মূলত তাদের দিয়ে কাজ আদায় করতো ফারাওরা। তবে এই অদক্ষ শ্রমিক ছাড়াও প্রকৌশলীরা সারাবছরই কাজে নিয়োজিত থাকতো। পিরামিডে ব্যবহৃত পাথরের অধিকাংশই আনা হয়েছিল নীলনদের পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে।
পিরামিড তৈরিতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ সুবিধাও ছিল। তাদের থাকার জন্য বাসস্থান তৈরি করা হয়েছিল পিরামিডের পাশেই। শ্রমিকদের হাড় ভেঙে গেলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসাও নিতে পারত।
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা টিকে ছিল প্রায় ৪ হাজার বছর। এই সময়ের মধ্যে তারা প্রায় ১০০টির মত পিরামিড নির্মাণ করেছিল। শেষপর্যায়ে এসে ফারাওরা পিরামিডের সম্পদ চুরি হতে শুরু করলে পিরামিড বানানো বন্ধ করে দেন। তারপরের ফারাওরা তাদের মৃতদেহ কবরে সমাহিত করতেই পছন্দ করতেন।
Posted ১২:০৮ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৮ জুন ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta