কক্সবাংলা ডটকম :: দেশে কয়েক বছর ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। অর্থের জোগান কমিয়ে এই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরই চার দফা বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার।
এর প্রভাবে একদিকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতে কমছে ঋণপ্রবাহ। ফলে চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। সুদহার বাড়ার বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে।
এক বছর আগে ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে কোনো কোনো ব্যাংকে সাড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। সব ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহারও ক্রমশ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
দেশে অন্যতম প্রধান নীতি সুদহার রিপারচেজ এগ্রিমেন্ট বা রেপো রেট। বাংলাদেশ ব্যাংক যে সুদের হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদি ধার দেয়, সেটিই হলো রেপো সুদহার। গত সপ্তাহে রেপোর সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এতে রেপোর হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এর আগে গত ২৫ আগস্ট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে রেপো হার করা হয় ৯ শতাংশ। তার আগে গত ৮ মে বাড়ানো হয় ৫০ বেসিস পয়েন্ট। আর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি বাড়ানো হয় ২৫ বেসিস পয়েন্ট। মূলত নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবেই ব্যাংকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার বাড়ে।
সুদহার এভাবে বাড়তে থাকায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা। এগুলো ছাড়া আরও কিছু কারণে ব্যবসায় ব্যয় বেড়েছে। অথচ বৈশ্বিকভাবে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যের দর সেভাবে বাড়েনি। এর মধ্য সুদহার বাড়তে থাকলে ঋণ পরিশোধে সমস্যা হবে। নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়বেন অনেকে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, তারাও চান মূল্যস্ফীতি কমে আসুক। কিন্তু বিগত সরকারের ভুল নীতির দায় তাদের কেন নিতে হবে? অনেক ব্যবসায়ী ৯ শতাংশের কম সুদ বিবেচনায় ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন সুদ গুনতে হচ্ছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। নীতি সুদহার এভাবে বাড়তে থাকলে আগামীতে ঋণের খরচ আরও বেড়ে সামগ্রিকভাবে সংকট তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এভাবে সুদহার বাড়লে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে। যারা আগে ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ঋণের ভারে খেলাপি হয়ে পড়বেন। সোজা কথায় বলা চলে, সুদহার বৃদ্ধি মানেই ব্যবসায়ীদের গলাটিপে হত্যা করা।’
শিল্প গ্রুপ ডিপিএলের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম ফিরোজ বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক যে পরিস্থিতি, তাতে ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। এমনিতেই গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে ধুঁকছে শিল্প। রপ্তানি আদেশ কমছে। ন্যায্য ধারও পাওয়া যাচ্ছে না।
এ রকম বৈরী বাস্তবতায় নতুন কোনো সংকট হজম করার সামর্থ্য শিল্প খাতের নেই। আশা করি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।’দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার অন্যতম একটি সূচক হলো মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি নিরূপণ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ কমে ৪ হাজার ৮১ কোটি ডলার হয়েছে। আমদানি ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ কমে হয়েছে ৬ হাজার ৩২৪ কোটি ডলার।
গত দুই বছরের বেশি দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে। এই মূল্যস্ফীতি শিগগিরই কমার লক্ষণ দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। গত জুলাই-আগস্টে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে। জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা আগস্টে সামান্য কমে হয় ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এখন আর্থিক খাতে বিভিন্ন সংস্কারের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি আরও সংকোচনমূলক ও কঠোর করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার না বাড়িয়ে উপায় নেই। সুদহার বাড়ানোর ফলে হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্যে খরচ বাড়ছে। তবে মূল্যস্ফীতি কমে এলে আবার সুদহার কমানো হবে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন সুদহার বাড়ানো হয়েছিল, তখন নানা কারণে আমাদের এখানে বাড়ানো যায়নি। ফলে এখন ওই সব দেশ সুদহার কমালেও আমরা কমাতে পারছি না।’
বাংলাদেশে এমন এক সময়ে সুদহার বাড়ানো হচ্ছে, যখন মূল্যস্ফীতি কমে আসায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, চীনসহ কয়েকটি বড় অর্থনীতির দেশ তা কমিয়ে আনছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে নিয়ে এসেছে।
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছে এ সুদহার। কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছরে এ পর্যন্ত নীতি সুদহার তিনবার কমিয়েছে।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সম্প্রতি সুদের হার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে এর আগে গত দুই বছর দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ায় বিভিন্ন দেশ। উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশ এর ফলও পেয়েছে। তাদের চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকায় কমে এসেছে মূল্যস্ফীতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। আওয়ামী লীগ সরকার নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বাস্তবতার চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ব্যবসায়ীদের একটি অংশকে খুশি করার ওপর জোর দেয়। তাই বৈশ্বিক সুদহার বাড়লেও দেশে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। ডলারের দর দীর্ঘদিন ৮৫ টাকায় সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এমন ভুল নীতির কারণে অর্থনীতিতে নানা ক্ষত তৈরি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে না দেওয়ার ঘোষণা দিলেও গত অর্থবছরের শেষ তিন মাসে গোপনে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে। তার আগের অর্থবছর ছাপানো হয় প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। আবার অর্থ পাচার ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ ছিল না। এসব কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে, এখন অন্য দেশে তা কমলেও দেশে কমছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অন্য দেশের অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের তুলনা চলবে না। এ সময়ে সুদহার বাড়ানো ঠিক আছে। কেননা এ মুহূর্তে একদিকে তারল্য সংকট রয়েছে, আরেকদিকে বড়ভাবে বিনিয়োগ চাহিদা নেই।
আবার যেসব ঋণ গেছে, সময়মতো তা ফেরত আসছে না। এ সময়ে তারল্য সহজলভ্য করা মানে চাহিদা না থাকার পরও অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ানো। যেহেতু উচ্চ মূল্যস্ফীতির একটি বড় কারণ মুদ্রা সরবরাহজনিত। সুতরাং এটা সীমিত রাখলে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ উদ্যোগ এতদিন সফল না হওয়ার একটা বড় কারণ মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সামঞ্জস্যতা না থাকা। কেননা, সরকারি ব্যয় না কমালে মুদ্রানীতি কাজ করে না। এতদিন সরকারি ব্যয় বেশি রাখা হয়েছিল। এখন সরকার আসলেই ব্যয় কমাচ্ছে।
ফলে আশা করা যায়, এর ফল পাওয়া যাবে।’ সিপিডির এ গবেষক বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সবসময় চান, অর্থ সরবরাহ বেশি থাকুক। তবে অর্থনীতির এখনকার যে অবস্থা, তাতে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালানোর মতো পরিস্থিতি নেই।
ফলে এ মূহূর্তে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে ব্যয় সংকোচনে থাকতে হবে। আবার যখন অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে, মুদ্রা সরবরাহ স্বাভাবিক হবে, আমদানি-রপ্তানি ঠিক হয়ে আসবে, ডলারের বিপরীতে টাকার ভারসাম্য আসবে এবং রিজার্ভে সুস্থির পরিস্থিতি হবে, তখন ধীরে ধীরে আবার সুদহার কমবে।’
ব্যাংকাররা জানান, বিভিন্ন পক্ষের সমালোচনার পরও ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত ছিল ৯ শতাংশ। বড় ব্যবসায়ীরা তখন ৭ থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ পান। আর আমানতে সুদ ছিল ২ থেকে ৬ শতাংশ। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের শুরুর দিক থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে।
তখন বেশির ভাগ দেশ দফায়-দফায় সুদহার বাড়াতে থাকে। সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে ডলারে বিনিয়োগ করে ২-৩ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সুদহার বেড়ে ৯ শতাংশের ওপরে ওঠে। অথচ বাংলাদেশে গত বছরের সেপ্টেম্বরের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
এর মানে টাকার তুলনায় ডলার অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে যায়। এতে করে বিনিয়োগ চলে যায় ডলারে। আবার ওই সময়ে তদারকি ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। অনেকেই তখন কম সুদের ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করলেও তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। এভাবে টাকা ও ডলারের সংকট তৈরি সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়ার ফলে এখন আমানতেও সুদহার বাড়ানোর চাপ তৈরি হবে। এর মানে ঋণের সুদ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’ তিনি বলেন, ‘মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এখনও সুদহার ১৩ শতাংশের মধ্যে রাখতে পেরেছে। তবে কোনো কোনো ব্যাংকে তা ১৪ শতাংশের বেশি রয়েছে।’ এভাবে সুদহার বাড়লে ব্যবসার খরচ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর গত বছরের জুলাই থেকে সুদহার নির্ধারণে প্রথমে ‘স্মার্ট’ নামে নতুন পদ্ধতি চালু হয়। এর পর গত ৮ মে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেও মৌখিকভাবে ১৪ শতাংশের নিচে রাখতে বলা হয়। এ ছাড়া নতুন করে টাকা না ছাপানোর ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ব্যয় সংকোচন নীতিতে চলছে অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৮৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। অনেক প্রকল্প কাটছাঁট হচ্ছে।
সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি না থাকায় এসব খাতে ব্যয় হচ্ছে না। ফলে পরিচালন ব্যয় অনেক কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইছে, এই সময়ে সুদহার আরও বাড়িয়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। তবে বিনিয়োগসহ সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা।
Posted ১:৩১ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta