বিশেষ প্রতিবেদক :: মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা দীর্ঘ ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত দখল করে নেয়ায় রোহিঙ্গা সংকটে নতুন মাত্রার সৃষ্টি হয়েছে। এতে পরিস্থিতি যেমন আরো জটিল হয়েছে, তেমনি প্রত্যাবাসন নিয়ে সংকট আরো গভীর হয়েছে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে- বাংলাদেশ সহসাই রোহিঙ্গা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে না। কদিন পরপর প্রত্যাবাসনের নাম করে শুধু আলোচনা হতে পারে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের তিনটি প্রধান শহর মংডু, রাখাইনের বুথিডং এবং শিন এলাকা পালেতাওয়ার এখন আরাকান আর্মির দখলে।
মিায়ানমার সীমান্ত অশান্ত হয়ে ওঠার কারণে চলতি বছরের শুরুর দিকে ফেব্রুয়ারি মাসে বেশ কিছুদিন টেকনাফ সেন্ট মার্টিন রুটে জাহাজ চলাচলও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ সরকার।
তবে এ নৌরুটে দুদিন বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে জরুরি খাদ্যপণ্য ও সেন্টমার্টিনের কিছু বাসিন্দাকে নিয়ে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় দুটি ট্রলার।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে ট্রলার চলাচল বন্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় জরুরি খাদ্যপণ্যসহ দ্বীপের বাসিন্দারা সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন।
সব মিলিয়ে রাখাইন এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভরসা করতে হবে নেপিডোর ওপর।
কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়। কিন্ত বর্তমান অবস্থায় এই সংকট আরো দীর্ঘায়িত হবে। কারণ একদিকে বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে।
এমন অবস্থায় প্রতিবেশী মিয়ানমার সীমান্তেও যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তাতে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যেও প্রভাব পড়তে পারে।
রাখাইনে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী একজন সামরিক বিশ্লেষক মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম ‘ইরাবতী’কে বলেছেন, আরাকান আর্মি দখলে নেয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য পুনঃস্থাপন পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যে বসবাসকারী মানুষের দুর্দশা কমাতে সাহায্য করবে।
প্রসঙ্গত, গত মাসে জাতিসংঘ জানিয়েছে রাখাইনে ২০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা গতকাল ভোরের কাগজকে বলেছেন, বুথিডং এবং মংডু শহরে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে।
আর পুরো রাখাইন রাজ্যে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে- যার মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার আটক রয়েছে। অনেকটা না খেয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের টাকার বিনিময়ে আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশের তমব্রু সীমান্তে জড়ো করাচ্ছেন। সুযোগ পেলেই নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করাবেন।
তারমতে, যেখানে প্রত্যাবাসন হওয়ার বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনার দাবি রাখছিল; সেখানে এখন স্থানীয় প্রশাসনকে নজর রাখতে হচ্ছে- কখন রোহিঙ্গা ঢল নামে বাংলাদেশে। এজন্য বিজিবিকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। তারা শুধু তমব্রু নয়, টেকনাফ এবং নাফনদীতেও সতর্ক রয়েছে। নাফ নদীতে টহলও জোরদার করেছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকারের
বিদ্রোহী গোষ্ঠী হচ্ছে আরাকান আর্মি। বাংলাদেশ এখন এমন এক অবস্থায় পড়েছে, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে না আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা করবে? সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে।
তবে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, বুথিডংসহ সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে থাকায় তারা সেখানকার রোহিঙ্গাদের কল্যাণে কাজ করবে, যাতে পুরো এলাকায় শান্তি ফিরে আসে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত দুটি প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন জানান, মিয়ানমারে এখন যা হচ্ছে তা এক অন্যরকম পরিস্থিতি। এটা বলতে পারি, এই পরিস্থিতিতে সেখানে আমরা নজর রাখছি।
আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যোগাযোগ রাখছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে যা করণীয় সেটিই করব। মূলত বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন সেই কাজই সরকার করবে। কিন্তু এর কৌশল কী হবে তা তিনি খোলাসা করেননি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তারা কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেবে না। সেখানে বিদ্রোহী এবং বৌদ্ধ ধর্মাবিলম্বী আরাকানরা তো রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতিই দেয় না। এর মধ্যে মিায়ানমার সেনার কাছ থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মংডু শহরেরও দখল নেয় আরাকান আর্মি। এর ফলে বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর ২৭১ কিলোমিটার এলাকার পুরোটাই তাদের দখলে চলে গেল।
দেশের সীমান্তে এই অস্থিরতায় চিন্তা আরো বাড়ছে। কারণ ২০১৫ সালে এই আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিবির দুবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এই আরাকান বাহিনী অতীতে একাধিকবার টেকনাফ অঞ্চলের সমুদ্র পথ থেকে বাংলাদেশি জেলেসহ ট্রলারও অপহরণ করে নিয়ে গেছে।
এদিকে, আরাকান আর্মি দখলে নেয়ার পর রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। কারণ রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করে না, আরাকান আর্মি তাদের প্রত্যাবাসন করবে। তাদের মতে, আরাকান আর্মির অধিকাংশ সদস্য বৌদ্ধ। বৌদ্ধরা প্রকৃতপক্ষে রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে নয়। তবু তারা যদি আমাদের নাগরিকত্ব নিয়ে ফেরত নেয় তাহলে আমরা যেতে রাজি।
দখলে নেয়ার পর আরাকান আর্মি একটি বিবৃতিতে দাবি করেছে তুমুল লড়াইয়ের মুখে জান্তা বাহিনীর মিত্র হিসেবে পরিচিত আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির রোহিঙ্গা মিলিশিয়া, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) বিরুদ্ধেও তারা হামলা চালিয়েছে। অব্যাহত হামলার মুখে তারাও ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়েছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে হামলার মুখে কয়েকটি রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতারা অস্ত্রসহ বাংলাদেশে আশ্রয়ের পর তাদের আটকও করেছিল পুলিশ।
কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এমন অবস্থায় নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের এক ধরনের শঙ্কা রয়েছে।
কক্সাজারের টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ বর্ডার যাতে কেউ ক্রস না করে। কোনো অবস্থাতেই যাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ না ঘটে সেদিক বিবেচনায় টহল জোরদার করেছি।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ সালে। দ্বিতীয় দফায় অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৯১-৯২ সালে। তৃতীয় দফা প্রবেশ করে ২০১৬ সালে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে। ওই সময় দুই মাসে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে দেশে। তখন আগের রোহিঙ্গা এবং নতুন করে আসা রোহিঙ্গা মিলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লক্ষাধিক। বিগত সাত বছরে নতুন করে জন্ম নিয়েছে আরও দেড় থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু। চলতি আগস্টের আগে-পরে নতুন করে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সাড়ে ১৩ লক্ষাধিক।
Posted ১:৫৩ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta