বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ‘আরসা’ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছে আরসার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে জান্তা সরকারের পক্ষ হয়ে লড়াই করেছে। তবে আরাকান আর্মির কাছে জান্তার পাশাপাশি আরসাও পরাস্ত হয়।
এর পর থেকে কোণঠাসা আরসা নেতারা গা-ঢাকা দিতে খুঁজছেন নতুন আশ্রয়। আরাকানে সশস্ত্র যুদ্ধের অনেক আগে থেকে তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থিতু হওয়ার চেষ্টা করেন।
আবার আরসার একটি অংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক অপহরণ, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই করছে। এ কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের নিয়ে আতঙ্কিত।
রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা মহিবুল্লাহকে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার কুতুপালংয়ে গুলি করে হত্যার পর আরসার নাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
তখন ক্যাম্পে আরও চাপের মধ্যে পড়েন সংগঠনটির সদস্যরা।
এরই মধ্যে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ ও তাঁর সহযোগীদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আতাউল্লাহ পুলিশের কাছে দাবি করেন, এর আগেও কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি।
জানা যায়,মিয়ানমারের রাখাইন ভিত্তিক বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)-এর আত্মপ্রকাশ করেছিল রোহিঙ্গা জাতির মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, মুক্তির স্বপ্ন দেখানো সেই সংগঠনই পরে পরিণত হয় রোহিঙ্গা জাতির গলার কাঁটায়।
গত আট বছরে আরসার হাতে খুন হয়েছেন রোহিঙ্গা কমিউনিটির বিভিন্ন পর্যায়ের কমপক্ষে ২৯০ জন নেতা।
শুধু খুন নয়, বাংলাদেশে অবস্থিত ৩৪ শরণার্থী ক্যাম্পে আরসা যেন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।
ছিনতাই থেকে ডাকাতি, অস্ত্র-মাদক ব্যবসাসহ হরেক রকমের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে আরসা সদস্যরা।
এদিকে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ বা আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্মার জুনুনীসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করার খবরে কক্সবাজারে আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
ওই খবর শোনার পর গত মঙ্গলবার রাতে তাঁরা উল্লাস প্রকাশ করেন। তারাবিহর নামাজ শেষে আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন মসজিদে রোহিঙ্গারা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন।
আরসার কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, আরসা নেতা আতাউল্লাহ ও তাঁর সহযোগীরা বাংলাদেশ হয়ে অন্য কোনো দেশে পালানোর ছক কষছিলেন কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আরসার শূরা বোর্ড (নীতিনির্ধারণী পর্ষদ) ৫৪ সদস্যের।
তবে মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর শূরা বোর্ডে ভাঙন ধরে। এ ধরনের খুনোখুনিতে সংগঠনের সম্পৃক্ত হওয়ার প্রতিবাদে ৩২ সদস্য বেরিয়ে যান।
যারা তখন আতাউল্লাহর কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতা করছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন মৌলভী সোয়েব। তিনি অনেক দিন আরসার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন।
‘জিজ্ঞাসাবাদে আতাউল্লাহ দাবি করেন, মিয়ানমারে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। তবে তাঁর এই দাবি আমরা বিশ্বাস করছি না।
তারা কেন বাংলাদেশে ঢুকেছেন, তা আরও জিজ্ঞাসাবাদ করলে বের হবে।’ আতাউল্লাহ আরও কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন বলে দাবি করছেন।
একবার কিছুদিন চট্টগ্রামে ছিলেন বলে জানান। আবার সৌদি আরবও গিয়েছিলেন। এবার আতাউল্লাহর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছেন। তারা বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন কিনা, এটাও জানার চেষ্টা চলছে।
আরেকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৩০টি চৌকিতে হামলা চালানোর জন্য দেশটির কর্তৃপক্ষ আরসাকে দায়ী করেছিল।
তখন সেনাবাহিনী ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। হত্যা, ধর্ষণ এবং নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা।
ওই বছর রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে প্রথম এই সংগঠনটিরই নাম শোনা গিয়েছিল।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আগে ইংরেজিতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তৎপরতা চালাত। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে। মিয়ানমার সরকার আরসাকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করেছে।
অভিযোগ আছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে আর্মির চেকপোস্টে হামলা করায় আরসা।
এর পর আরাকার আর্মির সঙ্গে রাখাইনে সংঘাত শুরু হলে আরসাকে প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবহার করতে শুরু করে জান্তা সরকার। রোহিঙ্গারা জান্তা সরকারের পক্ষ হয়ে লড়তে থাকে।
তাদের বলা হয়, আরাকান আর্মিকে পরাজিত করতে পারলে নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে আনা হবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের। তবে জান্তা সরকার পরাজিত হওয়ার পর সেখানে বেকায়দায় পড়ে আরসা ও সাধারণ রোহিঙ্গারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, আতাউল্লাহর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের সিকদারপাড়ায়। ১৯৬০ সালের দিকে তাঁর বাবা পাকিস্তানের করাচি চলে যান। সেখানেই জন্ম আতাউল্লাহর। তিনি পড়াশোনা করেন সৌদি আরবের মক্কায়। ২০১২ সালে আতাউল্লাহ সৌদি আরব যান। ২০১৬ সালের দিকে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি।
ওই বছর অক্টোবরের শুরুতে আরাকান রাজ্যে সে দেশের সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালান। এতে দেশটির বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ওই সময় হামলার দায় স্বীকার করে আরসার কমান্ডার আতাউল্লাহ অনলাইনে ভিডিও বার্তা প্রচার করেন।
এর পর থেকে আরসা ও আতাউল্লাহকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। তবে প্রথমে আরসার শীর্ষ নেতা ছিলেন মৌলভী হাশেম। ২০২২ সালে তিনি মারা যান। হাশেম জীবিত থাকা অবস্থায় আরসার নেতৃত্বে চলে আসেন আতাউল্লাহ। আরসায় কট্টর ও মধ্যপন্থি এ দুটি ধারা রয়েছে। মূলত কট্টরপন্থিদের কাছে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আতাউল্লাহ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক খুনোখুনি ও নানা অপরাধে আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি মামলা রয়েছে। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার রিজওয়ান রুশদী। ওই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আতাউল্লাহ।
এর আগে গত এক বছরে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী, সামরিক কমান্ডারসহ ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, দুই বছর আগেও আরসাপ্রধান আতাউল্লাহর অবস্থান ছিল পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের শূন্যরেখায়। সেখান থেকে মাঝেমধ্যে উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে এসে খুনখারাবিতে লিপ্ত থাকতেন। এক বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সংঘাত-লড়াই শুরু হলে তিনি দলবল নিয়ে রাখাইন রাজ্যে গিয়ে আস্তানা গাড়েন। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে জোট বেঁধে আরসার সদস্যরা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়তে থাকেন। দীর্ঘ ১১ মাসের লড়াই সংঘাতের পর ২০২৪ সালের ৭ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যে মংডু টাউনশিপসহ ৮০ শতাংশ এলাকা (২৭০ কিলোমিটার) দখলে নেয় আরাকান আর্মি। কিন্তু আরসার সঙ্গে আরাকান আর্মির লড়াই বন্ধ হয়নি। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিদ্রোহী গোষ্ঠী ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য আরাকান আর্মি। গত বছরের নভেম্বর থেকে হামলা চালিয়ে রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৪টির নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি।
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, ২০১৮ সালের দিকে পুরো আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ ছিল আরসার হাতে। সাধারণ রোহিঙ্গারাও আরসাকে নানাভাবে সহযোগিতা দিত। কিন্তু রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে বিপাকে পড়ে আরসা। এর ফলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সমর্থন হারাতে থাকে তারা। এখন আরসা আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছিল। আতাউল্লাহসহ আরসার কয়েকজন শীর্ষনেতা গ্রেপ্তারের খবরে আশ্রয়শিবিরে থাকা আরসা সন্ত্রাসীদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁরা পালানোর চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে আরএসওসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীরা আরসার সন্ত্রাসীদের পালানো ঠেকাতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। তাতে আশ্রয়শিবিরে নতুন করে সংঘাত-হানাহানি দেখা দিতে পারে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আতাউল্লাহসহ আরসার ছয়জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পরে কক্সবাজারে করা মামলায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
Posted ১২:৫৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta