কক্সবংলা ডটকম(৪ ফেব্রুয়ারি) :: ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত অং সান সু চিকে ভোট কারচুপির অভিযোগে সরিয়ে সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করার আগে থেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে প্রভাবশালী। এ এক আজব দেশ, যেখানে সংসদের ২৫ শতাংশ সিট সেনাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত। সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মিয়ানমারের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। অবশ্য, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ এবারই প্রথম না। তবে পার্থক্য হচ্ছে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন।
এবার সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহীরা ছায়া সরকার গঠন করেছে। সে ছায়া সরকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে নিজেদের অফিস খোলার অনুমতি পেয়েছে এবং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যদিকে দেশটিতে বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোতে সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই লড়াই বেশ উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। যার আঁচ ইতিমধ্যে আমাদের সীমান্তেও এসে লেগেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশটির ওপর নজর রাখছে বলে ধারণা করা যায়।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ৭৫ বছর ধরে দেশটির কোথাও না কোথাও নিজ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নির্যাতন শুরুর পর বাংলাদেশে তাদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এর আগেও কয়েক দফায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। এমনকি, ২০২২ সালে মিয়ানমারের জান্তাবাহিনী বাংলাদেশের দিকেও মর্টার ও গুলি ছুড়েছে। নিকট অতীতে অপর দেশ থেকে বাংলাদেশে মর্টার ছোড়ার নজির নেই। এ কারণে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে সীমান্ত নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বাস্তব কারণ আছে। এখানে বাংলাদেশের প্রধানতম স্বার্থ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশ মিয়ানমারে এমন পরিস্থিতি আশা করে যেখানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সফল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব।
আরাকান রাজ্যের পরিস্থিতি
মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্য আরাকান। সে রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে আরাকান আর্মি। রাজ্যটির কেন্দ্রীয় শহর ব্যতীত বাদবাকি এলাকা মোটামুটি আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করছে। রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি যেভাবে শক্তি বাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে, তাতে করে বিচলিত হয়ে পড়েছে মিয়ানমার সরকার।
রোহিঙ্গারা সে আরাকান অঞ্চলের জনগোষ্ঠী। সার্বিক পরিস্থিতিতে ফের বাংলাদেশ অভিমুখে শরণার্থী ঢল নামে কিনা সেই উদ্বেগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরাও সতর্ক অবস্থানে আছে। এই রাজ্যে চীনের বিনিয়োগ একটি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অন্যদিকে রাজ্যটির মধ্যে দিয়ে ভারত তার উত্তরাঞ্চলের সাত রাজ্যের সঙ্গে কলকাতা বন্দরের সংযোগ তৈরিতে মরিয়া। ফলে এখানে কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে চীন, ভারত ও বাংলাদেশের আগ্রহ ও নজর রয়েছে।
ওয়াং ম্রা নাইং নামে আরাকান আর্মির এক প্রভাবশালী সামরিক নেতার একটি ইন্টারভিউ থেকে জানা যায়, চীন ও ভারতের সঙ্গে আরাকান আর্মির যোগাযোগ আছে। তবে চেষ্টা করেও তারা বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। চীন, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকাটা স্বাভাবিক। এই দুই দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে রাখাইন প্রদেশে। সে প্রদেশে স্বাধিকারের জন্য লড়াই করা একটি গোষ্ঠী সম্পর্কে তারা অন্ধকারে থাকবে তা হতে পারে না।
তবে আরাকান আর্মি একটি বিষয় পরিষ্কার করেছে, তারা রাখাইন প্রদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে না। ওয়াং ম্রা নাইংয়ের মতে, ‘১৯৭১ সালে এই অঞ্চলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু ৫০ বছর পর পরিস্থিতি ভিন্ন। আশপাশের শক্তিশালী দেশগুলো কেউ চাইছে না এ অঞ্চলে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হোক (ভারত ও চীনকে বুঝিয়েছেন)। এ রকম রাষ্ট্র বেরিয়ে এলে শক্তিশালী দেশগুলোর ভয় হলো তাদের নিজেদের দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উৎসাহিত হবে।’
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার স্বীকার করি। রোহিঙ্গাদের ফিরে আসা স্বাগত জানানোর মতো বিষয়। কিন্তু বার্মিজ মিলিটারিকে বিশ্বাস করা যায় না। তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত বদল করে।’ রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারত, চীন সবাই আমাদের জিজ্ঞাসা করে, তোমরা আরসাকে সাহায্য করছ কিনা। তাদের দিক থেকে সতর্কতা আছে এ বিষয়ে।’ প্রতিবেশী বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মন্তব্য, ‘এটা তো খুবই সত্য যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। এটা আমাদের একটা অগ্রাধিকার।’
রোহিঙ্গারা নিজেদের মিয়ানমারের নাগরিক দাবি করে। তারা দাবি করে, তাদের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় রোহিঙ্গা। এই অধিকারটুকু মেনে নিলেই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হয়ে যায়। আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা না করে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো কঠিন। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। বাংলাদেশের প্রতিও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক।
আরাকান আর্মি রাখাইনে একটি রাজনৈতিক শক্তি। রোহিঙ্গারা যেসব এলাকায় বসবাস করত এবং এখনো যেসব এলাকায় তারা বসবাস করে সেখানে আরাকান আর্মি তাদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, সার্বিক পরিস্থিতিতে যদি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজতে যাই তাহলে সেখানে দুটি গ্রুপ কেন্দ্রীয় সরকার বা সেনাবাহিনী এবং আরাকান আমি উভয়কেই বিবেচনায় রাখতে হবে। ফলে চীন ও ভারতের মতো আরাকান আর্মির সঙ্গে ‘ব্যাক ডোর’ হলেও বাংলাদেশের যোগাযোগ থাকা উচিত।
মিয়ানমারে চীনা ফ্যাক্টর
মিয়ানমার পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে গেলে দেখতে হবে চীন কী চায়! চীনকে এড়িয়ে দেশটিতে এখন কিছু করা অসম্ভব পর্যায়ে গিয়ে পড়েছে। চীন মিয়ানমারকে বহু বছর ধরে একচেটিয়া সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে। সেখানে যুক্ত হয়েছে রাশিয়াও। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে চীন ও রাশিয়া বারবার মিয়ানমারের পক্ষে ভেটো দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে নতুন আলোচনা এসেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ওপরও চীনের প্রভাব আছে। মিয়ানমারের কোনো অংশের প্রভাবই চীন হারাতে চায় না। ফলে চীন সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গ্রুপ উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখার কৌশল নিয়েছে। মিয়ানমার সামরিক জান্তা সরকার ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একমাত্র মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে চীনের মধ্যস্থতায় তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও জান্তা সরকারের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সেটির কোনো ফল দেয়নি।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সেনাবাহিনীবিরোধী এবং পশ্চিমাপন্থি হলেও তারা পশ্চিম থেকে কিছু মানবিক সহায়তা ছাড়া তেমন কিছু পাচ্ছে না। চীন, কারেন ও কাচিন অঞ্চলে ইউরোপ-আমেরিকার কিছু চার্চকেন্দ্রিক মানবিক সহায়তা থাকলেও বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর প্রতি কোনো সামরিক সহায়তা তারা নিশ্চিত করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্টের আওতায় মিয়ানমারের ছায়া সরকারের সশস্ত্র বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স, জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন এবং গণতন্ত্রপন্থি গ্রুপগুলোকে ‘নন- লেথাল এইড’ বা ‘প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র সরঞ্জাম’ দিতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু সে অস্ত্র আসলে বিদ্রোহীরা পাচ্ছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ফলে এই গোষ্ঠীগুলোর কাছেও চীন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রচলিত ভাষায় মিয়ানমারে চীনের ভূমিকার কথা বলতে গেলে বলা যায়, এখানে ‘চীন বরেরও বাবা ও কন্যারও বাবা’।
বর্তমানে সংঘাত যখন বেশ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গিয়েছে, মিয়ানমার ভেঙে যাবে কিনা এই প্রশ্নও উঠেছে। আপাত দৃষ্টিতে সেটার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ভৌগোলিক হিসেবে দেশটির ৬০-৭০ ভাগ এলাকায় সংঘাত ছড়িয়েছে পড়লেও কেন্দ্রীয় শহর ও রাজধানীতে এখনো সেনাবাহিনীর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই শহরগুলো বামার জনগোষ্ঠী, সেনাবাহিনীতে এই জনগোষ্ঠীর প্রভাব যথেষ্ট। ফলে সেখানে সেনাবাহিনীর হাত থেকে ক্ষমতা যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। দেশটির রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা একচেটিয়াভাবে সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে সেনাবাহিনী দেশ ভেঙে যাওয়ার যে আশঙ্কা প্রকাশ করছে তা মূলত নিজেদের গুরুত্বকে অপরিহার্য করতে ও বামার জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করার একটি প্রয়াস।
ভারতের উদ্বেগ
মিয়ানমারে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর বাংলাদেশে যেমন শরণার্থীর ঢল আসার উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তেমনি ভারত-লাওস-থাইল্যান্ডেও একই ধরনের উদ্বেগ চলছে। ভারত ও থাইল্যান্ডে ইতিমধ্যে অনেক শরণার্থী ঢুকেছে। সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কথাও ভাবছে। যা প্রায় অসম্ভব একটি প্রস্তাব। অন্তত নাগারা এটা হতে দেবে না। কারণ, নাগা জাতি ভারত ও মিয়ানমারে বিভডক্ত হয়ে আছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মতো ভারত মিয়ানমারের জান্তাবিরোধীদের ছায়া সরকারকে স্বাগত জানায়নি। মিয়ানমার ইস্যুতে ভারতের অবস্থান ও বাস্তবতা ভিন্ন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা নয়াদিল্লির জন্য অপরিহার্য।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলেও ‘বার্মা অ্যাক্ট’ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নয়াদিল্লিকে প্রায় অন্ধকারেই রেখেছে। যেভাবে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুল ত্যাগ নিয়েও নয়াদিল্লিকে ওয়াশিংটন কিছুই জানায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্কের যে গতিবেগ তাতে মিয়ানমার সম্পর্কিত নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ করা উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন একেবারেই নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের অবস্থান একেবারে নিজ নিজ স্বার্থে ভিন্ন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ঠিক করতে হবে এমন ভূ-রাজনৈতিক দাবার চালে বাংলাদেশ কীভাবে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে পারে।
লেখক-শাহাদাৎ হোসাইন : আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক রিসার্চ স্কলার ও কলামিস্ট
Posted ১২:১৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta