কক্সবাংলা ডটকম (৩১ মে) :: জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। সব পক্ষই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। একইসঙ্গে দুর্নীতিবাজদের অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগ আলোচিত হচ্ছে সর্বত্র।
এরই মাঝে অনেকটা ঝিমিয়ে থাকার পর ফের সক্রিয় হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাঘববোয়াল হিসেবে পরিচিত বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে বড় ঝাঁকুনি দিতে চায় সংস্থাটি। সেজন্য কৌশল নির্ধারণের পাশাপাশি অভিযানের কাঠামোও চূড়ান্ত করেছে সংস্থাটি।
দুর্নীতি ঠেকাতে ও রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গত সোমবার উচ্চপর্যায়ের স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করার কথা জানিয়েছে দুদক। এই স্ট্রাইকিং ফোর্স দুর্নীতিবাজদের তাৎক্ষণিকভাবে আইনের আওতায় আনতে কাজ করবে।
দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন বলে একটি কথা আছে। স্ট্রাইকিং ফোর্সের মাধ্যমে সেই রকম একটি সেন্স তৈরি করতে চাচ্ছি। দুর্নীতি হলে সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে দুর্নীতিবাজদের ধরতে এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স নামটা আকর্ষণীয় ও আগ্রহজাগানিয়া। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বড় দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে এটা নামসর্বস্ব বিষয় হিসেবেই থেকে যাবে। এখন এই ফোর্সের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড দেখার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই।’
দুদক সূত্র জানায়, স্ট্রাইকিং ফোর্সের কমিশনের রুটিন বা দৈনন্দিন কার্যক্রমের বাইরে থাকবেন। তারা শুধু বিশেষ বা বড় ধরনের দুর্নীতির অনুসন্ধানের তথ্য সংগ্রহের কাজ করবেন। অর্থ পাচারে জড়িতদের বিষয়ে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করবেন।
এ ছাড়া তাদের নজরদারি থাকবে জনগুরুত্বপূর্ণ, বহুল আলোচিত এবং স্পর্শকাতর দুর্নীতির ঘটনা। সরকারি দপ্তরে এবং সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অনৈতিক লেনদেনের ঘটনা হাতেনাতে ধরতে ছদ্মবেশে কাজ করবেন স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্যরা।
দুদক সূত্র জানায়, এবারের স্ট্রাইকিং ফোর্সের ধরন এক-এগারোর সময় গঠন করা টাস্কফোর্সের মতো। তবে ওই টাস্কফোর্সের কাজ নিয়ে সমালোচনাও ছিল।
২০০৪ সালে ব্যুরো থেকে কমিশন হিসেবে যাত্রা করার পর এক-এগারোর সময়ই দুদকের অভিযান ব্যাপক আলোচনায় আসে। এরপর গোলাম রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ধরতে কয়েকটি বিশেষ দল গঠন করার উদ্যোগ নেয়। ইকবাল মাহমুদ কমিশন ১১টি প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করে।
দলগুলো তিতাস, ওয়াসা, ডেসা, বিটিসিএল, রাজউক, ডাক বিভাগ, সিভিল এভিয়েশন ও বিমান, বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএ, বিআরটিসি, সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত, স্থানীয় সরকার বিভাগসহ ২৫টি দপ্তরে দুর্নীতির বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করে। সেসব প্রতিবেদন ওই সব দপ্তরে জমা দেয়া হলেও সেগুলো সেভাবে গুরুত্ব পায়নি।
ইকবাল মাহমুদের আমলে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধে ওই সব দল গঠনের পাশাপাশি গ্রেপ্তার অভিযানে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়। ওই সময় দুর্নীতিবাজদের বড় ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয় সংস্থাটি। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকটাই দিশেহারা ছিল দুর্নীতিবাজরা।
ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন তাদের পাঁচ বছরের মেয়াদকালে গ্রেপ্তার করেছে সাড়ে সাত শতাধিক অভিযুক্তকে। ১০০টির বেশি ফাঁদ পরিচালনা করে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছে শতাধিক ব্যক্তিকে। ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানও পরিচালিত হয় ওই মেয়াদে।
২০২১ সালে মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আব্দুল্লার নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর ইকবাল মাহমুদ কমিশনের আমলে নেয়া গ্রেপ্তার অভিযানের গতি একেবারেই থেমে যায়। অবশ্য ইকবাল মাহমুদ কমিশনের মেয়াদের শেষ বছর ছিল করোনার সংক্রমণের বছর। করোনা মহামারির প্রথম বছরের শেষে ২০২১ সালের মার্চে দায়িত্ব নেয় মঈনউদ্দিন আব্দুল্লার নেতৃত্বাধীন কমিশন। তাদের দায়িত্ব নেয়ার পর বড় একটি সময় গেছে মহামারির ভেতরে। কমিশন অনেকটা গুছিয়ে উঠে ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে।
দুদকের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ধরতে ও ঠেকাতে কমিশন নীতিগতভাবে একমত। তারই ধারাবাহিকতায় রাঘববোয়ালদের ধরতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
গত ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দুর্নীতিবাজদের তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় আনার জন্য কমিশনে সার্বক্ষণিক স্ট্রাইকিং ফোর্স প্রস্তুত রাখা দরকার। কমিশনের বিশেষ তদন্ত বিভাগের অধীন দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ টিম এ লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে কাজ করবে। ওই টিমের কর্মকর্তাদের সাধারণ অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে নিয়োজিত রাখা হবে না।
বর্তমান কমিশন যে স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করেছে তাতে নেয়া হয়েছে দুদকের চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতদের। ফোর্সের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সংস্থার গোয়েন্দা শাখার পরিচালক আব্দুল্লা আল জাহিদ। মানি লন্ডারিং শাখার পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরীকে দেয়া হয়েছে স্ট্রাইকিং ফোর্সের সমন্বয়কের দায়িত্ব।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- উপপরিচালক ফারুক আহমেদ (বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান) উপপরিচালক সেলিনা আখতার মনি (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-৩), উপপরিচালক নাজমুল হোসাইন (মানি লন্ডারিং), উপপরিচালক মো. তানজির হাসিব সরকার, সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামূল আহসান গাজী (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখা-২) এবং সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকী (মানি লন্ডারিং)। দুদক জানিয়েছে, প্রয়োজনে স্ট্রাইকিং ফোর্স আরও কর্মকর্তাকে নিজেদের দলে যুক্ত করতে পারবে।
দুদকের একাধিক সূত্র জানায়, সংস্থার গোয়েন্দা শাখার প্রধানের নেতৃত্বে স্ট্রাইকিং ফোর্সটি গঠন হওয়ার কারণে তারা দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে সক্ষম হবেন। গোয়েন্দা শাখা ও দুদকের তথ্য-প্রযুক্তি শাখার হাতে থাকা আধুনিক প্রযুক্তির গোয়েন্দা নজরদারি সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে দুর্নীতিবাজদের ধরতে। পাশাপাশি নানা উৎস থেকে তথ্য নেয়া হবে।
দুদক সূত্র বলছে, স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্যরা দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি বড় দুর্নীতিবাজদের ধরতে তৎপর থাকবে। প্রয়োজনে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার করবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুদকের বর্তমান নেতৃত্ব অনেকটাই রক্ষণশীল। তারা যেন একটি বৃত্তের মধ্যেই আছে। টাস্কফোর্স হোক, আর স্ট্রাইকিং ফোর্স হোক, যেকোনোভাবেই কমিশনকে তার স্বআরোপিত সীমারেখা থেকে বের হতে হবে, যে সীমারেখার কারণে তার পক্ষে প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতির ক্ষেত্রে কার্যকর জবাবদিহিমূলক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। আইনের চোখে সবাই সমান—এই ভিত্তি থেকে ব্যক্তির পরিচয় বা অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কমিশন কাজ করবে, এটিই তার আইনগত বাধ্যবাধকতা এবং জনগণের প্রত্যাশা।
নতুন এই স্ট্রাইকিং ফোর্স রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হতে পারে বলে নানা মহল থেকে আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। এটাও দূর করতে পারে কমিশন। ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতি বিবেচনায় কমিশন ব্যবস্থা নিলে তাদের পদক্ষেপের সুফল পাওয়া যাবে।
Posted ৩:৪৪ অপরাহ্ণ | বুধবার, ৩১ মে ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta