কক্সবাংলা ডটকম(১৬ জুলাই) :: ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে যাচাই-বাছাই শেষে ১২ রাজনৈতিক দলের ছোট তালিকা করা হয়েছিল। শেষমেশ নিবন্ধন দেওয়ার ব্যাপারে ‘অখ্যাত’ দল দুটিকে বেছে নিল ইসি। যারা রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে আলোচিত হয়েছে, তারা নিবন্ধন না পেয়ে নিরাশ, নাখোশ। নিবন্ধনের দৌড় থেকে ছিটকে পড়াদের তালিকায় সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, ভিপি নুরের গণঅধিকার পরিষদ এবং জামায়াতে ইসলামী থেকে বেরিয়ে আসা নেতাদের নিয়ে গঠিত এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টি এবং বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি(বিএমজেপি)ও রয়েছে।
এনিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাদ পড়া ১০টি দলের নের্তৃবৃন্দরা। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোমবার সংবাদ সম্মেলন করার পাশাপাশি উচ্চ আদালতে আপিল করবে বলছেন তারা। তাদের দাবী দীর্ঘ এবছর যাবৎ তাদের সকল তথ্য ঠিক থাকলেও রহস্যজনক কারণে শেষ মুহুর্ত তাদের বাদ দেয়া হলো।
১৭ জুলাই সোমবার, বেলা ১২ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলের ২য় তলায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সহ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নিবন্ধন বঞ্চিত করা দল সমূহের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন।
তারা বলেন, নিবন্ধন প্রক্রিয়ার নামে গত ১ বছরে প্রহসনমূলক তৎপরতা চালিয়ে সর্বশেষ অশ্বডিম্ব প্রসবের মত করে ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রেসক্রিপশনে অখ্যাত অপরিচিত ভূঁইফোড় দুটি দলকে নিবন্ধন প্রদানের প্রতিবাদে, যৌথ সংবাদ সম্মেলন করা হবে।এর পর উচ্চ আদালতে তাদের আইনী কার্যক্রম চালানো হবে।
গণ অধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক (নুর) দাবি করেন,নিবন্ধন–সংক্রান্ত কিছু নথি নিয়ে আজ সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) গিয়েছিলেন। সাক্ষাতে সিইসির কথাবার্তায় একটু অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে উঠেছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভালো কিছু করার চিন্তাভাবনা করলেও পরিস্থিতির কারণে করতে পারছেন না। তাঁর হাত-পা বাধা। সিইসির কথাবার্তা ও কার্যক্রমে সেটা তাঁরা বুঝতে পেরেছেন। সিইসি এক প্রকার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তিনি যেটি বলেছেন সেটি হলো, সব কিছু আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাঁর কিছু করার নেই।
অপরদিকে এবি পার্টির নিবন্ধন না দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রবিবার বিকাল ৫টায় বিজয় নগরস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ ব্রিফিংয়ে দলের সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন,নিবন্ধন প্রক্রিয়ার নামে ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রহসনমূলক নাটক করে নির্বাচন কমিশন সবশেষে সরকারের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে । সকল শর্ত পূরণ সত্ত্বেও এবি পার্টিকে নিবন্ধন না দিয়ে নির্বাচন কমিশন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নিয়ম-নীতি, আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করে এই অন্যায় ও প্রহসনকে রাজনৈতিক এবং আইনগতভাবে মোকাবিলা করবে।
জানা যায়,রোববার ইসির সভায় আলোচনার জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় ১২টি দলকে রাখা হয়েছিল। মাত্র দুটি দলকে ইসি নিবন্ধন দিচ্ছে। দল দুটি হলো— বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)।
নতুন দুটি দলের বিষয়ে আগামীকাল সোমবার (১৭ জুলাই) পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে ইসি।কিন্তু ১০টি দলের নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মাঠের তথ্যের মিল পায়নি নির্বাচন কমিশন। ফলে দলগুলোকে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে ইসি।
কমিশনসভা শেষে সংবাদমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম।
তিনি বলেন, যাচাই-বাছাই শেষে বিএনএম ও বিএসপি নিবন্ধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। বিষয়টি নিয়ে আগামীকাল সোমবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। তবে কারও কোনো আপত্তি থাকলে তা ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করে কমিশনপরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। আপত্তি নিষ্পত্তির পর কমিশন সন্তুষ্ট হলে দল দুটিকে নিবন্ধন দেওয়া হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ধাপে ধাপে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে অফিস থাকার কথা, কমিটি থাকার কথা, জনবল থাকার কথা… এগুলো সব যাচাই করেছি। পুনরায় যাচাই করে এই দুটি দলের আইন অনুযায়ী সবকিছু থাকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এর পরই চূড়ান্ত হবে যে, কারা কারা নিবন্ধন পাবে। বাকি ১০টি দল যে তথ্য দিয়েছে মাঠপর্যায়ে যাচাই করে গরমিল পাওয়ায় তাদের আবেদন বাতিল করা হয়েছে।
জানা গেছে, নতুন দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ার সংক্ষিপ্ত তালিকায় ১২টি রাজনৈতিক দল ছিল। সেগুলো হচ্ছে— আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি),গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য,বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি (বিএইচপি), বাংলাদেশ সনাতন পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), ডেমোক্রেটিক পার্টি ও বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডি)।
ওইসব রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও মাঠপর্যায়ের কার্যালয় সক্রিয় রয়েছে কিনা তা দুই দফা যাচাই করেছে ইসি। ওই দুই দফার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নতুন দল নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে।
আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন পেতে ২১ জেলা ও ১০০ উপজেলা বা থানায় কার্যকর কমিটি ও কার্যালয় এবং প্রতিটি উপজেলায় দলের অন্তত ২০০ জন ভোটার থাকার নিয়ম রয়েছে। দুই দফায় এসব দলের মাঠ কার্যালয় ও কমিটি যাচাই করেছে ইসি। ওই দুই ধাপে পাওয়া প্রতিবেদন আজ রোববার কমিশনসভায় তোলা হয়। এতে যারা শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে, নিয়মানুযায়ী তারা নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইসি’র নিবন্ধ পেতে যাওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুর রহমান। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-১ আসনের বিএনপি’র নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। বর্তমানে ড. আব্দুর রহমান প্রাইম ইউনির্ভাসিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রধান ও ডিন। নতুন রাজনৈতিক দল বিএনএম গঠনের আগে তিনি বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষা জীবনে তিনি ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। দলটির ৩৩ সদস্যাবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটিতে রয়েছেন ৮ জন সামরিক কর্মকর্তা। অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিবন্ধন পাওয়া আরেক দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান মাইজভাণ্ডারী দরবার শরীফের ইমাম হযরত সাইয়্যিদ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী মাইজভাণ্ডারী।
এদিকে বিএনএমের আহ্বায়ক আবদুর রহমান খোকন জানান, চূড়ান্ত নিবন্ধন পাওয়ার পরই আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তাঁর দল। তিনি বলেন, আমরা কোনো দল ভাঙাগড়ার সঙ্গে জড়িত নই। ১৯৭৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জাগদল, ছাত্রদল ও বিএনপির রাজনীতি করে এসেছি।আব্দুর রহমান দাবি করেন, ইসিতে দেওয়া তাঁর দলের জেলা, থানা ও উপজেলা কার্যালয়ের ঠিকানা শতভাগ সঠিক। তাদের নেতাকর্মীরা সেখানে নিয়মিত বসেন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান।
এদিকে বিএসপির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত তাঁর পরিবার। সাত-আটটি সামাজিক সংগঠন রয়েছে। ২০১৯ সালের ১১ মে রাজনৈতিক সংগঠন বিএসপি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদে ১২১ জন সদস্য। ৪০টি জেলা, ২৫০টি উপজেলা ও এক হাজার ইউনিয়নে দলের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এমন ‘অখ্যাত’ দলের নিবন্ধনের সিদ্ধান্তে হতাশ ও ক্ষুব্ধ বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বর্তমান কমিশনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসি হারিয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি উদ্ধারে কাজ করবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। তবে তাদের এই সিদ্ধান্তে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অতীতেও ইসি দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে অখ্যাত দলকে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করেছে। তাতে রাজনীতি বা গণতন্ত্রের কোনো উপকার হয়নি। সরকারের উদ্দেশ্যও সফল হয়নি।
বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, ইসির সিদ্ধান্তে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে নামসর্বস্ব সংগঠন নিয়ে সরকার আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। ইসি তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে সরকারের ‘বি-টিম’ হয়ে কাজ করছে বলেই মনে হচ্ছে।
Posted ৩:২১ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৬ জুলাই ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta